শীত মৌসুম। অবকাঠামো নির্মাণের মোক্ষম সময়। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো নোয়াখালীতেও চলছে অবকাঠামো নির্মাণের তোড়জোড়। স্বভাবতই বেড়েছে নির্মাণ-সংশ্লিষ্ট পণ্যের কেনা-বেচাও। নোয়াখালী শহরের দত্তের হাটের ব্যস্ততম এলাকা পূর্ব দক্ষিণ বাজার। বন্ধনের নিয়মিত আয়োজন ‘সফল যারা কেমন তারা’ পর্বের এবারের সফল ব্যবসায়ী মেসার্স সোনালী ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আবদুুজ জাহের। সিমেন্ট, রড, ইট, বালু, ইটের কণা, পাথর, ভিটি বালুসহ নানাবিধ নির্মাণ সামগ্রী বিক্রি হয় তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। দোকানে সারাক্ষণই লেগে আছে ক্রেতার ব্যস্ততা। ব্যস্ততা কিছুটা কমলেই আকিজ সিমেন্ট কোম্পানির আঞ্চলিক বিক্রয় কর্মকর্তা শামসুর রহমান পরিচয় করিয়ে দিলেন সফল এ ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি শোনালেন তার সফলতার কথা।
জন্ম ১৯৭৪ সালের ২ অক্টোবর নোয়াখালী জেলার দত্ত হাটে। বাবা মৃত হাজী এমএ বাতেন ও মাতা শামসুন্নাহার বেগম। চার বোন তিন ভাইয়ের সংসারে তিনি তৃতীয়। বাবা ছিলেন নৌবাহিনীর অফিসার। সে সূত্রেই ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে কেটেছে তার শৈশব ও কৈশোর। ঢাকার কচুক্ষেত লালা সরাই স্কুলে কেটেছে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন। ১৯৯২ সালে পৌর কল্যাণ হাইস্কুল, মাইজদী থেকে এসএসসি পাস করেন। এ সময় তার বাবা মারা যান। সংসারের দায়িত্ব অনেকটা তার কাঁধেই বর্তায়। ফলে পড়ালেখার ধারাবাহিকতা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। সংসারের প্রয়োজনে জড়িয়ে যেতে হয় ব্যবসায়। ছোট থেকেই বিভিন্ন ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। পারিবারিক ট্যানারির ব্যবসাও ছিল। সেখানে তাকে সময় দিতে হতো। এক পর্যায়ে নিজ বাড়িতেই মুরগির খামার করেছিলেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই আসছিল না আর্থিক সচ্ছলতা। এ সময়টায় বিকল্প কোনো ভালো ব্যবসার সন্ধান করতে থাকেন ব্যবসায়ী জাহের। মামার ছিল নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা। ব্যবসা শেখার উদ্দেশ্যে মামার দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ নেন। সেখানে ছিলেন প্রায় ৪ বছর। নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসার কৌশলটা মূলত সেখান থেকেই রপ্ত করা। এ ব্যবসায়ের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা বুঝতে পেরে নিজেদের কিছু জমি বিক্রি করে সে টাকা দিয়েই এককভাবে নির্মাণ সামগ্রী বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসাটিকে তিনি ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। এখানে তিনি তার নিজস্ব কৌশল, মেধা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য বিক্রি, ক্রেতা সম্পর্ক, কম মুনাফা সব মিলিয়ে খুব দ্রুতই ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকে। তার ব্যবসার অংশীদার ছিল তার অন্য দুই ভাই মোঃ শওকত কামাল ও তরিকুল ইসলাম বাবু। তিন ভাইয়ের মিলিত প্রচেষ্টা ব্যবসাটিকে করে তোলে আরো সফল ও সুদৃঢ়। এই ব্যবসার মাধ্যমেই মেটাতে পেরেছেন পরিবারের বহুমুখী চাহিদা। ভাই-বোনদের লেখাপড়ার ব্যবস্থাও করেছেন। এত কিছুর পরও বেড়েছে ব্যবসার পরিসর। বর্তমানে নোয়াখালীতে রয়েছে তাদের ২টি শো-রুম ও ৫টি গোডাউন। এ ছাড়াও তারা পরিবহন ব্যবসার সাথে যুক্ত। বেশ কয়েকটি পিকআপ ভ্যান রয়েছে তাদের। সময় মতো মালামাল সরবরাহ করতে এগুলো ব্যবসাতে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি এগুলোর ভাড়া থেকেও বাড়তি কিছু আয় হয়। তাদের এই ব্যবসার মাধ্যমে প্রায় ৩০ জন কর্মচারীর কর্মসংস্থান করা সম্ভব হয়েছে।
অনেক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আজকের এই দৃঢ় অবস্থানে আসতে হয়েছে সফল এ ব্যবসায়ীকে। ব্যবসায়ে সফলতা লাভের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে সততা ও পরিশ্রম। খুচরা ও পাইকারি উভয় ক্ষেত্রেই সীমিত লাভে পণ্য সরবরাহ করেন তিনি। পারিবারিক সম্পদ বিক্রি করে অনেক ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করতে এসেছিলেন তাই ব্যবসায়িক পরিসর বৃদ্ধিতে নানান কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিয়ে ভালো পণ্য ক্রয়ে ক্রেতাকে উদ্বুদ্ধ করতে হয়েছে। তাদের সাথে গড়ে তুলতে হয়েছে সুসম্পর্ক। এই সম্পর্কের রেশ ধরেই পেয়েছেন অন্যান্য ক্রেতা। ধীরে ধীরে বেড়েছে পণ্য বিক্রি। এর স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে লাভ করেছেন নানা সম্মাননা ও পুরস্কার। ২০০৮ সালে ছিলেন রুবি সিমেন্টের সেরা খুচরা বিক্রেতা। ২০০৯-এ আকিজ সিমেন্টের নোয়াখালী এলাকার সর্বোচ্চ খুচরা সিমেন্ট বিক্রেতা নির্বাচিত হন। এ ছাড়াও বিভিন্ন কোম্পানির অনুষ্ঠানে তিনি নিমন্ত্রিত হন।
আবদুুজ জাহের বিয়ে করেছেন ২০০৭ সালে। স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তার রনি। মিসেস জাহের নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে মাস্টার্স উত্তীর্ণ। দু’জনের মধ্যে ছিল ভালোলাগার সম্পর্ক। এই সম্পর্কটিই রূপ নেয় বিবাহে। তাদের সুখের সংসারে এখন ২টি সন্তান। বড় মেয়ে জারিন আঞ্জুম আলিশা ও ছোট মেয়ে জারিন আনান মাহিশা। ব্যবসায়িক ব্যস্ততার কারণে তেমনভাবে সময় দিতে পারেন না পরিবারকে। এমনকি পারিবারিক আচার অনুষ্ঠানেও অনেক সময় যোগ দিতে পারেন না। তবে মাঝে মধ্যে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বেড়াতে যান কক্সবাজার। সামাজিক কাজেও তাকে জড়িত থাকতে হয়। এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে অংশ নিতে হয়। তিনি নিয়মিত কর পরিশোধ করেন।

ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন খুবই দুষ্টু প্রকৃতির। মারামারিতে ওস্তাদ। এলাকার ছেলেদের সাথে তার খুনসুটি লেগেই থাকত। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ অভিযোগ নিয়ে আসত বাসায়। দোষ থাক বা না থাক বাবার কাছে শাস্তি তাকে পেতেই হতো। শুধু যে দুষ্টুমি করেছেন তা নয়, খেলাধুলার প্রতিও ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ। হেন খেলা নেই যা তিনি খেলেননি। তবে ফুটবল তার প্রিয় খেলা। দৌড়, লাফ-ঝাঁপ, ব্যাডমিন্টন, ঘুড়ি ওড়ানো সব খেলাতেই ছিল তার সমান দখল। প্রতিটি খেলাতেই তার প্রথম হওয়া চাই। আন্তঃস্কুল ফুটবল খেলেছেন। কলোনিতে মেতে উঠতেন বিভিন্ন খেলায়। বিভিন্ন জায়গাতে টুর্নামেন্ট খেলতে যেতেন। কাপ, মেডেলসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন খেলোয়াড়ী জীবনে।
নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা বেশ জটিল প্রকৃতির। এখানে সফলতা লাভ খুব সহজ নয়। প্রচুর মূলধন লাগে এ ব্যবসায়। প্রায়ই অর্থ সঙ্কট দেখা দিতে পারে। তাই ভালোমতো বুঝে এই ব্যবসায় আসা উচিত বলে মনে করেন সফল ব্যবসায়ী জাহের। তবে ব্যবসা করতে হলে ঝুঁকি নিতেই হয়। এখানে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। থাকতে হবে সততাও। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য বিক্রি করতে হবে। সীমিত লাভে পণ্য বিক্রিও হতে পারে ক্রেতা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এ ব্যবসাতে বাকি বিক্রয়জনিত সমস্যা রয়েছে। যেহেতু বাকি-নগদ মিলিয়েই ব্যবসা, তাই কিছুটা কৌশলেই তার সমন্বয় করার পরামর্শ সফল এই ব্যবসায়ীর।
দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসা করছেন ব্যবসায়ী জাহের। এটাকে আরো সমৃৃদ্ধ অবস্থানে নিয়ে যেতে চান। ভালো কোম্পানির ডিলার হওয়াই এখন তার ইচ্ছা। যোগ্যতার ভিত্তিতে যদি কেউ ডিলারশিপ পায় তবে তিনিই এর অন্যতম দাবিদার। ছোটবেলা থেকেই খেলাসহ সবকিছুতেই ছিল জয়ী হওয়ার মনোভাব। এই মনোভাবই তাকে এনে দিত বিজয়। সেই মনোভাবই এখনো তাকে তাড়িত করে। তিনি চান জয় আর বিজয়ী হয়ে পেতে চান জয়ের আনন্দ।
মাহফুজ ফারুক
প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৩ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৩