দুর্দিনেও সাহসী যিনি

স্বাধীন পেশা বলে অনেকেরই পছন্দ ব্যবসা। তবে ব্যবসা আদতে সহজ নয়। প্রতিনিয়ত তীব্র প্রতিযোগিতা করেই টিকতে হয় ব্যবসায়। আবার টিকে থাকা আর সফল হওয়ার সমীকরণটাও এক নয়। একজন ব্যবসায়ীকে সফল হতে থাকা চাই বেশকিছু গুণ। সততা, পরিশ্রম, ব্যবসায়িক কৌশল, বিনয়, ধৈর্যের মতো গুণাবলির সমন্বয়ে সফল হন একজন ব্যবসায়ী। এমনই একজন সফল ব্যবসায়ীর সন্ধানে হাজির হই ঝিনাইদহে। এ জনপদের সফল নির্মাণপণ্য ব্যবসায়ী মো. আফাঙ্গির আলম। ভাটই বাজার, শৈলকুপার ‘মেসার্স ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ’-এর স্বত্বাধিকারী। ছোট্ট পরিসরে ব্যবসা শুরু করলেও ক্রমেই নিজেকে একজন বড় ব্যবসায়ী হিসেবে করেছেন প্রতিষ্ঠিত। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের আঞ্চলিক বিক্রয় কর্মকর্তা মো. মোহন রায়হানের সহযোগিতায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানা যায় তাঁর ব্যবসায়িক জীবনের নানা গল্প। বন্ধন-এর ‘সফল যাঁরা কেমন তাঁরা’ পর্বে থাকছে সফল এ ব্যবসায়ীর সেসব কথোপকথন।

ব্যবসায়ী মো. আফাঙ্গির জীবনে সাফল্য এলেও ব্যবসায়িক শুরুটা ছিল দারুণ সংগ্রামের। প্রাথমিকের গন্ডি পেরোনোর আগেই জড়িয়ে পড়েন ব্যবসায়। পেশায় বাবা ছিলেন কৃষক। একার আয়ে সংসার সচ্ছলভাবে চলত না; লেগেই থাকত অভাব-অনটন। সংসারের অন্যান্য খরচ মিটিয়ে সন্তানদের পড়ালেখার ব্যয়ভার বহন করা ছিল দুঃসাধ্য। তবে পরিবারের বড় ছেলে জাহাঙ্গীর আলম জনি ছিলেন বরাবরই মেধাবী। সংসারের এমন টানাপোড়েনে কিশোর আফাঙ্গির লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে সংসারের দায়ভার কিছুটা তুলে নেন নিজের কাঁধে। তবে নিজে বিদ্যালয় ছাড়লেও কোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটতে দেননি বড় ভাই জনির পড়ালেখায়। বাড়ির অদূরে ভাটই বাজারে শুরু করেন বিড়ি-সিগারেট, বাদাম ও রকমারি পণ্যের ব্যবসা। পরিশ্রম, মেধা আর ব্যবসার প্রতি সীমাহীন ভালোবাসার কারণে ধীরে ধীরে ব্যবসাটি দ্রুত প্রসার লাভ করে। মাত্র বছর দশেকের ব্যবধানে ছোট্ট সেই ব্যবসাটি রূপ নেয় বিশাল পরিসরে, হয়ে ওঠে বাজারের সবচেয়ে বড় মুদির দোকান। অন্যদিকে সম্পন্ন হয় বড় ভাই জনির বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া। সব মিলিয়ে অভাবের সংসারে আসে সচ্ছলতা। ব্যবসায় পরিসরও বাড়ে বহুগুণে। ভালোই চলছিল ব্যবসা। কিন্তু হঠাৎই ছন্দপতন। ডাকাতের হাতে লুট হয় দোকানের সব মালামাল। আকস্মিক এমন ঘটনায় বিহŸল হলেও ভেঙে পড়েননি। চরম আর্থিক ক্ষতি সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়ান নতুনভাবে। আবারও মূলধন জোগাড় করে শুরু করেন ব্যবসা। তবে এবার আর মুদি নয়, নির্মাণপণ্যের ব্যবসা।

বাবা মারা যাওয়ার পর চাচা হাজি আবদুল লতিফ ছিলেন তাঁদের অভিভাবক। তিনি নানাভাবে তাঁদের সহযোগিতা করতেন। অন্যদিকে বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম জনি পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সংসারের দেখভাল ও ব্যবসার তদারকিও করতেন সব সময়। নির্মাণপণ্যের ব্যবসার পরামর্শ মূলত তাঁরই দেওয়া। শুরুতে পণ্য তালিকায় সিমেন্ট-রড থাকলেও পর্যায়ক্রমে যুক্ত হয় ঢেউটিন, হার্ডওয়্যার, সিলিন্ডার গ্যাস ও চুলা। তবে সিমেন্ট ব্যবসায় দ্রæতই সাফল্য আসে। আকিজ সিমেন্ট বিক্রিতে ২০১৫ সালে ঝিনাইদহ টেরিটরিতে হন তৃতীয়। এ ছাড়া প্রতিবছরেই তাঁর অবস্থান থাকে প্রথম দিকে। উল্লেখযোগ্য পণ্য বিক্রির সুবাদে উপহারস্বরূপ বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে পেয়েছেন এসি, হ্যান্ডিক্যাম, টেলিভিশন, মোবাইল, স্বর্ণালংকার, নগদ টাকাসহ নানা সামগ্রী। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানির পক্ষ থেকে ভ্রমণের অফার পেয়েছেন থাইল্যান্ড, নেপাল, কক্সবাজার, শ্রীমঙ্গলে। বর্তমানে বাজারে রয়েছে তিনটি শোরুম ও দুটি গোডাউন। নির্মাণপণ্যের ব্যবসা ছাড়াও আছে গার্মেন্টস ব্যবসা, যা দেখেন ছোট ভাই দেলোয়ার হোসেন দুর্লভ। এ ছাড়া আছে স্টক পণ্যের ব্যবসা। বাজারে মার্কেট ও বাড়িভাড়া দিয়ে রেখেছেন। জায়গা-জমিও রয়েছে বাজারে। ঢাকার উত্তরায়ও আছে নিজস্ব ফ্ল্যাট। আর এসবই এসেছে ব্যবসায়িক সফলতার সূত্র ধরে। বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম বর্তমানে কেমিক্যাল আমদানি ও বিপণন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।

পরিবারের সাথে ব্যবসায়ী আফাঙ্গির আলম

ব্যবসায়ী মো. আফাঙ্গির আলমের জন্ম ১৯৭৮ সালের ২৫ জুন ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার আসামনগরে। বাবা মরহুম মো. কুবাদ আলী মিয়া ও মা মরহুমা মোছা. ভানু নেসা। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তৃতীয়। ১৯৯৯ সালে বিয়ে করেন এ ব্যবসায়ী। সহধর্মিণী শাহানাজ আক্তার চায়না। তাঁদের একমাত্র মেয়ে নুসরাত জাহান আফরিন পড়ছে চতুর্থ শ্রেণিতে। ব্যবসায়ী আফাঙ্গির আসামনগর দোকান মালিক সমিতির সদস্য, স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ও ঈদগাহ কমিটির সেক্রেটারি। তাঁর এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ সময়ের ব্যবসায়িক পরিচিত ও সুনাম। তবে সিমেন্ট ব্যবসার হাতেখড়ি ঝিনাইদহের আকিজ সিমেন্টের পরিবেশক মো. মোকলেসুর রহমানের হাতে। তাঁর সহযোগিতার ফলেই এ ব্যবসায় এগিয়ে চলেছেন, রাখছেন সাফল্যের পদচিহ্ন। তিনি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ তাঁর প্রতি। নির্মাণপণ্যের যেসব সামগ্রী তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নেই, সেগুলোকে যুক্ত করে একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠাই তাঁর এখনকার স্বপ্ন।

মাহফুজ ফারুক

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭১ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top