সৃষ্টিশীল কিছু করার ইচ্ছেটা ছিল ছোট থেকেই। পেশা হিসেবে তাই চাকরি নয়, বরং ব্যবসা ছিল রোমাঞ্চকর; চ্যালেঞ্জিং। বাবাও ছিলেন ব্যবসায়ী। সুন্দরবনসংলগ্ন জনপদে ছিল ধান-চালের ব্যবসা। পলোয়ার (বড় নৌকা) নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ধান সংগ্রহে। দিন শেষে খালি নৌকাটি ভরে উঠবে, মনের কোণে থাকত এমনই আশা। বাবার মতো নিজেকে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল তাঁর। কিন্তু ব্যস্ত এলাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই প্রচুর মূলধন, যা ছিল না তাঁর। শহরের উপকণ্ঠে নিজের প্লটে গড়ে তোলেন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তাতে অবশ্য লোকে কম হাসি-ঠাট্টা করেনি। কারণ, দিন-দুপুরে সেখানে ছিল শিয়ালের আনাগোনা। ক্রেতা দূরে থাক, কোনো দিন হয়তো ওপথে চলাচলকারী পথচারীর সংখ্যাও হাতে গুনে বলা যেত। তবে লোকে যা-ই বলুক, তিনি বিশ্বাস করতেন ভবিষ্যতে এলাকাটি উন্নত হবেই! খুলনা শহরের সোনাডাঙ্গার বাণিজ্যিক গুরুত্বের কথা আজ কাউকে বোঝানোর দরকার নেই। ব্যস্ততম এ শহরের সেই স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষটিই এস এম আলমগীর হোসেন; একজন সফল নির্মাণপণ্য ব্যবসায়ী। সবুজবাগ, সোনাডাঙ্গার ‘এস এ ট্রেডার্স’-এর স্বত্বাধিকারী তিনি। বন্ধন-এর ‘সফল যাঁরা কেমন তাঁরা’ পর্বে সফল এ ব্যবসায়ীর সাফল্যকথন জানতে হাজির হয়েছি বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনঘেঁষা জনপদ খুলনায়। সহযোগী আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের কনিষ্ঠ বিক্রয় কর্মকর্তা মো. বুলবুল খান।
ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেনের জন্ম ১৯৬৯ সালের ৪ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলার আড়পাড়ায়। বাবা মরহুম ইয়াকুব আলী ও মা মরহুমা আয়েশা বেগম। চার ভাই এক বোনের মধ্যে পঞ্চম। ১৯৮৫ সালে বাইককান্দি উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৮৮ সালে দৌলতপুর মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৯২ সালে একই কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ছাত্রাবস্থাতেই যুক্ত হন চাকরিতে। পড়ালেখা শেষে বন্ধু শিহাবের মাধ্যমে কাঁকড়া রপ্তানির সূত্রে ব্যবসায় হাতেখড়ি। পরে ২০০৫ সালে ব্যবসাটি ছেড়ে নির্মাণপণ্য ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসাটি আঁকড়ে আছেন আজও। তবে একজন ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার পথে দিশারী সেই বন্ধুটির প্রতি সমান কৃতজ্ঞতা রয়েছে আজও ।
সোনাডাঙ্গার মতো জনাকীর্ণ স্থানে নির্মাণপণ্য ব্যবসা শুরু করাটাই ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জিং। আসলে তিনি একটি গাছের চারা রোপণ করেছিলেন। জানতেন এর সঠিক পরিচর্চা নিলে গাছটি তরতর করে বেড়ে উঠবে; ফুল দেবে, ফল দেবে। সে লক্ষ্যে উপযুক্ত পরিবেশও গড়ে তোলেন। যেমন, গুণগতমানের পণ্য বিক্রি, সুলভ মূল্য, সঠিক ওজন প্রভৃতি। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, সততা, বিচক্ষণতা, কৌশল এবং ক্রেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় কয়েক বছরের মধ্যে তিনি শহরের অন্যতম একজন নির্মাণপণ্য ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। পরপর চারবার আকিজ সিমেন্ট বিক্রিতে খুলনার সেরা বিক্রেতা নির্বাচিত হন। এমন ঈর্ষণীয় সাফল্যে পান প্রতিষ্ঠানটির ডিলারশিপ। শুধু তা-ই নয়, সিমেন্ট বিক্রিতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় কোম্পানিটির ডিস্ট্রিবিউটর হচ্ছেন শিগগিরই। এ ছাড়া তিনি বিএসআরএম স্টিলেরও স্থানীয় ডিলার। সেরা বিক্রেতার সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ কোম্পানির পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছেন মোটরসাইকেল, এসি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোনসেট, নগদ টাকাসহ নানা সামগ্রী। এ ছাড়া ভ্রমণ করেছেন চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও নেপাল। খুব শিগগির যাবেন ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ও ইস্তাম্বুল।

ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বিয়ে করেন ১৯৯২ সালে। সহধর্মিণী শারমিন আলম। এ দম্পতির চার ছেলেমেয়ে। বড় ছেলে সাকিব সালমান নর্দান ইউনিভার্সিটির বিবিএ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী, মেজো মেয়ে আদ্রিতা নওমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশনে প্রথম বর্ষে পড়ছে, সেজো ছেলে আকিব আবদুল্লাহ খুলনা পাবলিক কলেজে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ও ছোট মেয়ে আফিয়া তাসনিম স্কুল অব মিউজিকে প্লেতে পড়ছে। ব্যবসা আর পরিবার নিয়ে বেশ আনন্দেই থাকেন তিনি। সংস্কৃতিমনা পরিবার। দুই ছেলের গানের গলা দারুণ। তিনিও ছেলেবেলায় খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত থেকে জিতেছেন নানা পুরস্কার। সময় পেলেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘুরতে যান। এ ছাড়া নানা সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গেও জড়িয়েছেন নিজেকে। তিনি মেট্রোপলিটন সিমেন্ট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি, গোপালগঞ্জ পশ্চিম আড়পাড়া জামে মসজিদের সভাপতি, সবুজবাগ জামে মসজিদের উপদেষ্টা, খুলনাস্থ গোপালগঞ্জ কল্যাণ সমিতির যুগ্ম সম্পাদক এবং ডা. কাজী মিজানুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সদস্য। শীতবস্ত্র বিতরণ, দুর্যোগকবলিত মানুষকে সহায়তা করাসহ অসহায় মানুষের পাশে থাকতে চেষ্টা করেন সব সময়।
উন্নত সড়ক, নৌ ও রেল যোগাযোগের কারণে স্বাধীনতার আগেই একের পর এক শিল্প-কলকারখানা গড়ে ওঠে শিল্পনগরী খুলনায়। পাট, জাহাজশিল্প, চিংড়ি ও মাছ রপ্তানিতে অর্জিত হয় নজরকাড়া সাফল্য। অথচ কয়েক বছর যেতে না-যেতেই নানা অব্যস্থাপনায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে পতিত হয়। বন্ধ হয়ে যায় অনেক শিল্পকারখানা। তবে কিছু উদ্যমী মানুষের প্রচেষ্টায় আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে প্রাচীন এ শিল্পনগরী। ব্যবসায়ী আলমগীরের ইচ্ছে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই অগ্রযাত্রায় নিজেকে শামিল করার। তাঁর শুভ প্রত্যাশা পূরণ হোক, বন্ধন পরিবারের এটাই চাওয়া।
মাহফুজ ফারুক
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৪ তম সংখ্যা, জুন ২০১৬