ঊনবিংশ শতাব্দীতে রেললাইন স্থাপনে মাটি খননকালে লাল পাথর পায় বেঙ্গল ডুয়ার্স। সেই থেকে এলাকাটির নাম ‘লালমনি’। মতান্তরে ১৭৮৩ সালে কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কৃষকনেতা বিপ্লবী নুরুলদিনের সঙ্গে লালমনি নামে এক মহিলা ব্রিটিশ সেনা ও জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জীবন উৎসর্গ করেন। আত্ম উৎসর্গ করা নারীর নামে জায়গাটির নাম ‘লালমনি’। কালের বিবর্তনে ‘হাট’ শব্দটি ‘লালমনি’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে হয়েছে ‘লালমনিরহাট’। জেলা সদরটির পুরান বাজারের মেসার্স তানজিম অ্যান্ড প্রগতি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোড়ল হুমায়ন কবির এলাকার একজন সফল নির্মাণপণ্য ব্যবসায়ী। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের আঞ্চলিক বিপণন কর্মকর্তা মো. জামাল মিয়ার সহায়তায় সফল এ ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপচারিতার পর ‘সফল যাঁরা কেমন তাঁরা’ পর্বে জানাব তাঁরই সাফল্যকাহিনি।
ব্যবসায়ী কবিরের জন্ম ১৯৬৯ সালের ১১ অক্টোবর লালমনিরহাটের কালীবাড়িতে। বাবা মরহুম আফছার উদ্দীন মোড়ল আর মা মৃত. হাজেরা বেগম। বাবা ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী। অত্যন্ত শৌখিন মানুষ। পণ্য বিক্রির বকেয়া টাকা আদায় করতে না পারায় বড় কলেবরের ব্যবসা হওয়া সত্ত্বেও টিকিয়ে রাখতে পারেননি তা। দুই ভাই ও দুই বোনের সংসারে কবির তৃতীয়। লালমনিরহাট সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৮৪ সালে এসএসসি পাস করেন। এ সময়ে পরিবারিক অবস্থা সংকটাপন্ন হলে পড়ালেখা ছেড়ে সংসারের হাল ধরতে যুক্ত হন ব্যবসায়। স্থানীয় পুরান বাজারে মাত্র ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ছোট্ট একটি দোকানে শুরু করেন ক্রোকারিজ সামগ্রীর ব্যবসা। ছোট পরিসরের ব্যবসা হলেও সুপরিচিতির কারণে ব্যবসায় উন্নতি ঘটে দ্রুতই। ব্যবসায়িক এ সাফল্য তাঁকে আরও বড় পরিসরের ব্যবসার অনুপ্রেরণা জোগায়। এক বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে শুরু করেন নির্মাণপণ্যের ব্যবসা। কিন্তু এক বছর না যেতেই বন্ধু ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। ফলে একাই পুরো ব্যবসার হাল ধরতে হয় নিজেকে। ভালোভাবেই সামলে নেন সে ধাক্কা। কয়েক বছরের মধ্যেই নির্মাণপণ্য ব্যবসায় যুক্ত হয় সিমেন্ট, রড আর ঢেউটিন। এ ছাড়া গড়ে তোলেন উত্তরা স্টিল জোন নামে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান।
কবিরের একজন সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে নিরলস পরিশ্রম আর সততা। প্রতিদিন সবার আগে দোকান খুলে বন্ধ করতেন সবার শেষে। ব্যবসার প্রতি বরাবরই থেকেছেন সৎ। মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের পাশাপাশি গুণগতমানের পণ্য বিক্রি করায় সহজেই জয় করেন ক্রেতাদের মন। এভাবে বাড়তে থাকে পণ্য বেচাকেনার পরিমাণও। এরই ধারাবাহিকতায় আরএসআরএম স্টিলসহ আর কয়েকটি সিমেন্ট কোম্পানির ডিলার হন। পণ্য বিক্রেতার তালিকায় সেরা হওয়ায় কোম্পানির পক্ষ থেকে ভ্রমণ করেছেন নেপাল। এ ছাড়া নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণ করায় আকিজ সিমেন্ট কোম্পানির পক্ষ থেকে এবার যাচ্ছেন থাইল্যান্ডে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পণ্য বিক্রির স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন কোম্পানির তরফ থেকে পেয়েছেন হোম থিয়েটার, ক্রেস্ট, নগদ টাকাসহ নানা উপহার ও সম্মাননা। পুরান বাজারে এখন তাঁর দুটি শোরুম ও দুটি গোডাউন। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে প্রায় ১০-১২ জন কর্মচারী ও শ্রমিক।
সফল ব্যবসায়ীর বাইরেও তাঁর অন্যতম পরিচয় একজন আদর্শ সংগঠক হিসেবে। লালমনিরহাট জেলা চেম্বার অব কমার্সের তিনবারের নির্বাচিত পরিচালক এবং রড, সিমেন্ট ও টিন ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচিত সভাপতি। পুরান বাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্বে আছেন প্রায় এক যুগ। এ ছাড়া বাজার মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান ও জেলা আইন ও বিচার সালিশ কমিটির কো-চেয়ারম্যান। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহসভাপতি এবং ফুটবল লীগের সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলেরও গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এলাকার একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে সামাজিক, ধর্মীয় ও উন্নয়নমূলক কাজেও সদা তৎপর এ ব্যবসায়ী। তিনি পুরান বাজার মসজিদুল আকসার প্রতিষ্ঠাতা ও আবদুল কাদের স্মৃতি মাদ্রাসার সভাপতি। ঐতিহ্যবাহী রংধনু নাট্যগোষ্ঠীর সভাপতি, যেখান থেকে কয়েকজন গরিব মেয়েকে বিয়ের ব্যাপারে যাবতীয় সহায়তা করার পাশাপাশি তাদের জামাইকে রিকশা কিনে দিয়েছেন। দুস্থদের চিকিৎসাসহ নানা কাজে সাধ্যমতো সহায়তা করেন। খেলাধুলার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছেলেবেলা থেকেই। ব্যাডমিন্টন খেলায় লালমনিরহাট জেলা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন কয়েকবার। হাডুডু খেলায়ও ছিলেন ওস্তাদ। এখন অবসরে খেলেন ভলিবল। তাঁর প্রিয় খেলা ফুটবল কিন্তু ভালো লাগে ব্যাডমিন্টন খেলতে। তাই খেলাধুলায় তিনি একজন সফল অলরাউন্ডার।

ব্যবসায় ও সংগঠকের পাশাপাশি পারিবারিক জীবনেও সুখী মানুষের প্রতিকৃত এ ব্যবসায়ী। স্ত্রী মোছা. সামশাদ বেগম, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। বড় মেয়ে হোমাইরা ইসলাম করবী নবম শ্রেণীতে ও ছোট ছেলে শাহরিয়ার ইসলাম শাওন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। কাজে শত ব্যস্ততা থাকলেও রাত ১০টার মধ্যে বাসায় ফেরেন। চেষ্টা করেন পরিবারকে যথেষ্ট সময় দিতে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মাঝে মাঝে বেড়াতে যান সপরিবারে। ব্যবসায় সম্পৃক্ত কর্মচারী ও শ্রমিকদের সঙ্গে রয়েছে তাঁর সুসম্পর্ক। তাদের যেকোনো ধরনের সমস্যায় তিনি সাধ্যমতো সহায়তা করেন।
ব্যবসায়ী কবির যা কিছুতে হাত দিয়েছেন, পেয়েছেন সফলতা। কেননা সময়ের মূল্য দিয়ে জীবনকে বেঁধেছেন সময়ের ফ্রেমে। তাঁর বিশ্বাস সততা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম থাকলে যে কেউ জীবনে সফল হবেই। তাঁর এখনকার স্বপ্ন লালমনিরহাটে ভালো মানের একটি স্কুল ও কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যার সুফল পাবে নিজ এলাকার হাজারো মানুষ।
মাহফুজ ফারুক
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫১ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১৪