দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল। বন্দরটিকে ঘিরে প্রতিনিয়ত চলছে আমদানি-রপ্তানির মহাযজ্ঞ। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে এলাকাটির রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। সীমান্তবর্তী এলাকা হলেও এখানে আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। অবকাঠামোগতভাবে উন্নত হওয়ায় নির্মাণপণ্যের চাহিদাও বেশি। ব্যবসাটিও এখানে বেশ লাভজনক। বেনাপোলের কলেজ রোডের মেসার্স ইত্যাদি ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারী মো. মসিউর রহমান ও মো. মিজানুর রহমান নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসায়ী। এই ব্যবসাই এলাকায় তাঁদের এনে দিয়েছে সাফল্য ও সুনাম। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের আঞ্চলিক বিক্রয় কর্মকর্তা রাজীব কুমার সাহার সহায়তায় এবার জানাব তাঁদেরই সাফল্যকথন।
ব্যবসায়ী মো. মসিউর রহমান ও মো. মিজানুর রহমান দুই সহোদর। বাবা মৃত মো. রহমত উল্লাহ ও মা মোছা. রাবেয়া খাতুন। দুই ভাই ছাড়াও পরিবারে আছে চার বোন। এলাকার ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী পারিবার। ব্রিটিশ আমল থেকেই করছেন রাইস ও স মিলের ব্যবসা। বেনাপোলের প্রথম লাইসেন্সকৃত রাইস মিলটাই তাঁদের। ব্যবসার শুরু দাদার হাত ধরে। তারপর হাল ধরেন বাবা। বংশপরম্পরায় ব্যবসার হাল ধরতে হয় বড় ছেলে মো. মসিউর রহমানকে। আর তাই শেষ করা হয়ে ওঠেনি পড়ালেখা। ব্যবসার একপর্যায়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ছোট ভাই মো. মিজানুর রহমান। পাশাপাশি চলতে থাকে লেখাপড়া। কিন্তু ব্যবসায়িক পরিসর বেড়ে গেলে শিক্ষাজীবনের ইতি টেনে পুরোপুরিভাবে মনোনিবেশ করেন ব্যবসায়। এ ব্যবসার পাশাপাশি যুক্ত হন পরিবহন ব্যবসায়ও। নিজেদের ব্যবসায়িক সমৃৃদ্ধির কারণে এলাকায় যশ ও খ্যাতি রয়েছে ব্যবসায়ী পরিবার হিসেবে।
পুরোনো ব্যবসার পাশাপাশি ১৯৮৮ সালে টালি, ইট, স্যানেটারি ইত্যাদি পণ্যসামগ্রী নিয়ে নির্মাণপণ্যের ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ব্যবসাটি যখন বেশ ভালো অবস্থানে তখন ক্রমেই এতে যোগ হয় সিমেন্ট, রড, ঢেউটিন, এলপি গ্যাসসহ নির্মাণসংশ্লিষ্ট নানা পণ্যসম্ভার। এতে বাড়ে ব্যবসার পরিসর। সাফল্য ও মুনাফা উভয়ই আসতে থাকলে শুরু থেকেই জোর দেন ভালো মানের পণ্য বিক্রিতে। ফ্লাই অ্যাশবিহীন আকিজ সিমেন্ট বাজারজাতকরণের পর থেকেই পণ্যটি বিক্রি শুরু করেন। গত বছর নাভারন টেরিটরিতে আকিজ সিমেন্ট বিক্রির তালিকায় সর্বোচ্চ বিক্রেতার গৌরব অর্জন করেন। অন্যান্য নির্মাণপণ্য বিক্রিতেও রয়েছে অভাবনীয় সাফল্য। বিগত এক যুগ ধরে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ঢেউটিন বিক্রিতে পেয়ে আসছেন প্রথম পুরস্কার। এ সাফল্যে কোম্পানিগুলোও তাঁদের যথাযোগ্য সম্মানে সম্মানিত করে। গরু মার্কা ঢেউটিনসহ এলাকায় যমুনা, বসুন্ধরা, ক্লিন হিট, টোটাল গ্যাসের গর্বিত ডিলার হওয়ার গৌরব লাভ করেন। সেরা বিক্রেতার স্বীকৃতিসরূপ বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন টেলিভিশন, ফ্রিজ, ডিজিটাল ক্যামেরা, মাইক্রো ওভেন, ওয়াটার ফিল্টার, আইপিএস, ওয়াশিং মেশিন, ডিভিডি, মোবাইল, নগদ টাকাসহ নানা উপহারসামগ্রী ও সম্মাননা।
অন্য ব্যবসার পাশাপাশি স্বল্প পুঁজি নিয়ে সম্ভাবনাময় এ ব্যবসাটি শুরু করেছিলেন ২০০০ সালে। বেনাপোলে তখন প্রায় সমধর্মী ১২টা দোকান ছিল। কিন্তু সুষ্ঠু পরিচালনার অভাবে ১০টি দোকানই বন্ধ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে ক্রমেই তাঁদের ব্যবসার উন্নতি হচ্ছিল। এই উন্নতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ব্যবসাটির প্রতি তাঁদের একাগ্রতা। উভয়ের বুদ্ধি, পরামর্শ, সিদ্ধান্ত, সমঝোতা অর্থাৎ যৌথ প্রয়াসেই রচিত হয়েছে সাফল্যের ভিত। কেউ কোনো সিদ্ধান্ত নিলে উভয়ের সম্মতিতেই তা চূড়ান্ত হয়। একজনের অবর্তমানে অন্যজন ব্যবসা দেখেন। কোনো ক্রেতা যখন কিছু কিনতে আসেন তখন তাঁর সঙ্গে তাঁরা সুআলাপের মাধ্যমে ভালো ও খারাপ পণ্যের ব্যাপারে তাঁদের বোঝান। মুনাফাও করেন সীমিত। প্রয়োজনে বাকিতেও পণ্য বিক্রি করেন। এতে ক্রেতারাও কিছুটা উপকৃত হন। এভাবেই ক্রেতাদের সঙ্গে গড়ে ওঠে তাঁদের ব্যবসায়িক সুসম্পর্ক। একজন থেকে সৃষ্টি হয় আরেকজন ক্রেতা, যা ব্যবসার বড় মূলধন হয়ে ওঠে। তবে তাঁদের সাফল্যের পেছেনে রয়েছে বাবা-মায়ের দোয়া, নিজেদের প্রচেষ্টা ও সবার সঙ্গে সদ্ভাব। বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসা ছাড়াও বর্তমানে কলেজ রোড বাজারে তাঁদের রয়েছে একটা শোরুম, চারটা গোডাউন ও একটি ট্রাক। তাঁদের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে প্রায় ২০-২৫ জন কর্মচারী।

দুই ভাইয়ের যে শুধু যৌথ ব্যবসা তা কিন্তু নয়, তাঁরা যৌথ পরিবারেও বাস করেন। বিশাল এলাকাজুড়ে তাঁদের বাড়ি। পুরোনো বাড়ি হলেও ইন্টেরিয়রে রয়েছে নতুনত্বের ছাপ। বাড়ির সামনে খেলার মাঠ আর ঠিক পেছনেই রয়েছে পুকুর। পুকুরে নানা জাতের মাছ। বাড়ির চারদিক ঘিরে রয়েছে অসংখ্য নারিকেল গাছ। এ ছাড়া আম, জামসহ রয়েছে বিভিন্ন ফলদ গাছ। এই বাড়িতেই বিভিন্ন উৎসব-আনন্দে আত্মীয়-স্বজনেরা বেড়াতে আসেন; মেতে ওঠে আনন্দে। সময় পেলে দুই ভাইও বেড়াতে যান তাঁদের বাড়িতে; কখনো বা পিকনিকে। ব্যবসা ও পারিবারিক ব্যস্ততা সত্ত্বে¡ও সামাজিক কাজেও নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন তাঁরা। দুজনই ‘জাগো সমাজকল্যাণ সংস্থা’র সদস্য। এলাকার দরিদ্র মানুষদের পরীক্ষার ফিস, বিবাহ, চিকিৎসা ইত্যাদি সমস্যায় নানাভাবে সহায়তা করেন। এতিমখানা, মাদ্রাসা ও মসজিদের কাজেও সহায়তা করেন। ব্যবসার প্রতি রয়েছে তাঁদের অন্তহীন ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। তাই ভবিষ্যতে যদি অন্য কোনো কিছু করেন তবে ব্যবসাকে বাদ দিয়ে নয় বরং এটাকে আরও উন্নত করে, এমনটাই প্রত্যাশা তাঁদের।
মো. মসিউর রহমান। জন্ম ১৯৬০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার শার্শা উপজেলার বেনাপোলে। বেনাপোল বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৮ সালে এসএসসি ও যশোর মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজ থেকে ১৯৮০ সালে এইচএসসি পাস করেন। বিয়ে করেন ১৯৯৪ সালে। স্ত্রী মৌসুমী রহমান। এ দম্পতির একমাত্র সন্তান মো. মুশফিকুর রহমান হামীম দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ছে।
মো. মিজানুর রহমান। জন্ম ১৯৭০ সালের ২৭ জুন যশোর জেলার শার্শা উপজেলার বেনাপোলে। বেনাপোল বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে এসএসসি ও নাভারন ডিগ্রি কলেজ থেকে ১৯৯০ সালে এইচএসসি পাস করেন। বিয়ে করেন ২০০৩ সালে। স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন জিপু। তাঁদের দুটি সন্তান। বড় ছেলে ইমামুর রহমান তামিম পড়ে নার্সারিতে, ছোট ছেলে তাজিম রহমানের বয়স মাত্র মাত্র তিন মাস।
মাহফুজ ফারুক
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৩ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৩