পয়লা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা সনের প্রথম দিন, যা বাংলা নববর্ষের প্রারম্ভকাল। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। এসো, এসো, এসো, হে বৈশাখ।’ সকল না-পাওয়ার বেদনাকে ধুয়ে-মুছে, আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে অগ্নিস্নানে শুচি করে তুলতে আবারও এসেছে পয়লা বৈশাখ। নতুন স্বপ্ন, উদ্যম ও প্রত্যাশার আলোয় রাঙানো বাংলা নতুন এ বছর। স্বাগত ১৪২৩। ‘এসো বাঙালির সাজে, হাতে যেন চুড়ি বাজে, খোঁপায় যেন থাকে বেলি ফুল, দেখা হবে পয়লা বৈশাখে।’ পয়লা বৈশাখের দৃশ্য মনে পড়লেই যেন এমনই দৃশ্য ভেসে ওঠে। লাল পাড়ের সাদা শাড়িতে হাতভর্তি কাচের চুড়ি নিয়ে বাঙালি নারীদের বর্ষবরণ সত্যিই বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য। বৈশাখের নবপ্রভাতেই বাঙালির তাই কায়মনো প্রার্থনা, যা কিছু ক্লেদাক্ত, গ্লানিময়, যা কিছু জীর্ণ, বিশীর্ণ, দীর্ণ, যা কিছু পুরোনো, তা বৈশাখের রুদ্র দহনে পুড়ে হোক ছাই। গ্রীষ্মের এই তাপস-নিশ্বাস বায়ে পুরোনো বছরের সব নিষ্ফল সঞ্চয় উড়ে যাক দূরে যাক, যাক দূর-দিগন্তে মিলিয়ে।
বৈশাখের সঙ্গে বাঙালিজীবনের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। নবান্নের পর এ মাসেই মানুষ কর্মক্লান্ত জীবনের মাঝে ফিরে পায় অনাবিল স্বস্তি। কাজের চাপ নেই। যেতে হয় না খেতখামারে। অনেকটাই অবসরজীবন। আগে গ্রামে বেলাশেষে সন্ধ্যাবেলায় বসত গানের আসর। আসরে পালাগান হতো, হতো পুঁথিপাঠ। এখন সেদিন নেই। ‘হালখাতা’র চল এখন নেই বলেই চলে। কিন্তু পয়লা বৈশাখ আপামর বাঙালির মনের উৎসবে আনে বাড়তি আমেজ। এরই মাঝে এ দেশের মানুষ খুঁজে পায় নতুনের আস্বাদ, নতুন করে জীবন চলার পথের প্রেরণা আর উদ্দীপনা। তাই বাঙালির জীবনে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দিতে পল্লী মানুষের জীবনে এ মাসে, এ ঋতুতে নেমে আসে নব এক আনন্দধারা। এ ধারায় সিঞ্চিত হয়ে মানুষ নব উদ্যমে পরবর্তী মাসের কর্মমুখর জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে এটাই বাঙালির জীবনে বৈশাখের অনন্য বৈশিষ্ট্য।
বাঙালির বৈশাখ উদ্যাপনের সংস্কৃতির সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিতি। বাঙালির প্রাণের উৎসব বৈশাখের আগমন ঘটে বাংলার প্রকৃতি ও জীবনে আপন নিয়মে। পয়লা বৈশাখ বর্ষবরণ এই দিনটিতে বাঙালি মেতে ওঠে নানা আয়োজনে উৎসবমুখর এক পরিবেশে। উৎসবমুখর এ দিনে শুধু নিজেকে সাজাতেই নয়, প্রাণের উৎসবের বর্ণিল এই দিনটায় অন্দরমহলে চাই বিশেষ সাজসজ্জা।

ঢাকার বৈশাখী উৎসবের আবশ্যিক অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে, পুনরায় শেষ হয় চারুকলা ইনস্টিটিউটে। এই শোভাযাত্রায় ফুটিয়ে তোলা হয় গ্রামীণজীবন আর আবহমান বাংলাকে। শোভাযাত্রায় সব শ্রেণি-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশ নেয়। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় রংবেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পয়লা বৈশাখের উৎসবের বিশেষ এক আকর্ষণ। বৈশাখ বাঙালির একান্তই নিজস্ব সাংস্কৃৃতিক উৎসব তাই অন্দরের সাজে দেশীয় জিনিসের ব্যবহারে সহজেই আনা যায় বৈশাখের আমেজ। ঘরের দেয়ালে লাগানো যায় বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। দেয়ালে মুখোশের ব্যবহারের কথা ভাবলেই প্রথমে মনে পড়ে মুখোশ নিয়ে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা। তাই ঘরেও সেই আমেজ নিয়ে আসা সম্ভব মুখোশের নান্দনিক ব্যবহারে।
নতুন বছর, নতুন দিন, নতুন স্বপ্ন; পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায় পয়লা বৈশাখ আপামর বাঙালির জীবনে এনেছে অপার এক আনন্দবারতা। সেই উৎসব উদ্যাপনের বৈশিষ্ট্য আজকে কতটুকুই-বা উপস্থিত! তবে আজও মানুষ নতুন দিনের স্বপ্ন নিয়ে পয়লা বৈশাখকে বরণ করে। যেহেতু দিনটিতে থাকে অতিথিদের আনাগোনা, তাই ঘরে নতুন পর্দা অন্দরসজ্জায় যুক্ত করে নান্দনিকতার ছোঁয়া। ইদানীং ঘর সাজাতে পর্দায় অ্যাপ্লিকের নকশার ব্যবহার বেশ চোখে পড়ছে। অ্যাপ্লিকের কাজ করা চাদর ও পর্দা দিয়ে নিমেষেই বদলে ফেলা যায় ঘরের সাজসজ্জা। দেশীয় ঘরানার আসবাব আছে এমন ঘরেই অ্যাপ্লিকের পর্দা বেশি মানাই। কাঠ, বাঁশ, বেত এবং ঐতিহ্যবাহী ও ছিমছাম নকশার আসবাব দিয়ে ঘর সাজালে সে ঘরে রাখতে পারেন অ্যাপ্লিকের কাজ করা পর্দা। সঙ্গে মিল রেখে খাটে বিছাতে পারেন অ্যাপ্লিকের চাদর। পর্দার রং থেকে যেকোনো রং নিয়ে চাদর ও কুশনের রং বেছে নিন। বসার ঘরের পর্দা হওয়া চাই লাল, কমলা, বেগুনির মতো উজ্জ্বল রঙের। সোফা এবং ডিভানের কুশন কভারের রং বাছাই করতে পারেন পর্দার রঙের বিপরীত কোনো রঙে। চাইলে উৎসবভিত্তিক রংও ব্যবহার করা যায়। যেমন পয়লা বৈশাখে লাল-সাদা রঙের সমন্বয়ে অ্যাপ্লিকের কাজ করা কুশন বা পর্দা বসার ঘরে ব্যবহার করতে পারলে দারুণ হয়। খাওয়ার ঘরে সবুজাভ রঙের পর্দা ভালো লাগবে। ডাইনিং টেবিলে রানার-এর রং মেলাতে পারেন পর্দার সঙ্গে। শোবার ঘরে রাখতে পারেন হালকা রঙের পর্দা। কারণ, ক্লান্তি শেষে সেখানে গিয়েই মিলবে একটু প্রশান্তি। বেডরুমের পর্দার জন্য তাই এমন রং বাছাই করা চাই, যা দেখলেই শান্তি লাগে। চাপা সাদা, আকাশি ইত্যাদি রং এ ক্ষেত্রে ভালো লাগবে। বাচ্চাদের ঘরে গোলাপি, হালকা বেগুনি, হলুদ রং মানাবে ভালো। ঘরের আসবাবের রং হালকা হলে পর্দা হবে গাঢ় রঙের। আসবাব গাঢ় হলে পর্দার রং হালকা হলেই বরং ভালো লাগবে। পয়লা বৈশাখের এই দিনে সবকিছুতেই আমরা দেশীয় জিনিস ব্যবহার করি। তাই বিছানার চাদর, পর্দা, কুশন কভার ইত্যাদিতে থাকতে পারে ব্লক, বাটিক, টাইডাই অথবা নকশিকাঁথার কাজ।

ফ্লোরে বিছাতে পারেন মাদুর, শীতলপাটি অথবা শতরঞ্জি। সেই সঙ্গে নানা দেশীয় শৌখিন উপকরণ দিয়েও ঘর সাজাতে পারেন। এসব সামগ্রী দিয়ে ঘর সাজালে তাতে থাকবে উৎসব ও সৃজনশীলতার পরশ। ঘরের বিভিন্ন কর্নারে রাখতে পারেন মাটির পটারি। বিভিন্ন আকৃতির মাটির পটারিতে নানা ধরনের ফুল এবং ইনডোর প্লান্টাসের সংযোগ সুগন্ধি ও সবুজের ছোয়ায় মনকে ভরিয়ে দেয় প্রশান্তিতে। ছোট-বড় কিছু পটারি দিয়ে সাজাতে পারেন সিঁড়িঘরকে। প্রবেশপথের মুখের দেয়ালে টাঙাতে পারেন মাটির, বেতের অথবা কাঠের কারুকার্য করা আয়না। আজকাল বাজারে মাটির তৈরি অনেক সুন্দর সুন্দর শোপিস পাওয়া যায়, সেগুলো দিয়েও সাজাতে পারেন ঘরের দেয়ালগুলোকে। ঘরের কোণে অথবা সিঁড়িতে মাটির বড় পাত্রে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে তাতে রেখে দিন ফ্লোটিং মোমবাতি অথবা প্রদীপ। সন্ধ্যায় অতিথিদের আগমনের সময় জ্বালিয়ে রাখুন রংবেরঙের মোমবাতি, দেখুন মোমের আলোর মায়াবিকতায় পাল্টে যাবে আপনার সনাতন ঘরের লুক। এ ছাড়া বসার ঘরে দেশীয় আসবাবপত্রের সঙ্গে বিভিন্ন কর্নারে রাখতে পারেন বেত অথবা বাঁশের ল্যাম্পশেড। বৈশাখের দিনে শুধু বসার ঘরেই নয়, বরং খাবারের টেবিলেও থাকা চাই দেশীয় আমেজ। এ ক্ষেত্রে খাবার পরিবেশনে মাটির বাসনের বিকল্প নেই। মাটির থালা, বাটি, গ্লাস, মগ ইত্যাদি দিয়ে সাজাতে পারেন খাবার টেবিলকে। টেবিলের মাঝখানে মাটির ফুলদানিতে রাখতে পারেন কিছু তাজা ফুল। এ ছাড়া দেশীয় টেবিল রানার, ন্যাপকিন এবং টেবিল ম্যাট ব্যবহার করতে পারেন খাবার টেবিলে। অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য বাঁশ ও বেতের ছোট ছোট ডালায় রাখতে পারেন খই, বাতাসা, মুয়া, পিঠা। এ ছাড়া বাঁশ ও বেতের নান্দনিক ট্রের ব্যবহার আপনার বৈশাখের আয়োজনকে বাড়িয়ে দেবে দ্বিগুণ। নতুন করে কিছু না কিনেও বরং ঘরের মধ্যেই থাকা বিভিন্ন ধরনের দেশীয় লোকজ জিনিসকে একটু এদিক-সেদিক করে গুছিয়ে রেখে পয়লা বৈশাখের এই দিনে ঘরে আনতে পারেন শৈল্পিক ছোঁয়া। শৈল্পিকতার এই পরশে বছরের প্রথম দিনেই আপনার মন ভরে উঠবে বাঙালিয়ানার ছোঁয়ায়, যা আপনাকে নিয়ে যাবে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী দেশীয় লোকজ সংস্কৃতির কাছাকাছি।
সময়ের সঙ্গে উৎসবের আমেজে যুক্ত হয়েছে বহুমাত্রিকতা। অনেক সময় আড়ম্বরের আতিশয্যে চাপা পড়ে যায় মূল উদ্দেশ্যটাই। তবু উৎসব উৎসবই। বাঙালির এ উৎসবকে ঘিরে আপনিও মেতে উঠুন বর্ণিল আয়োজনে।
ফারজানা গাজী, চিফ অপারেটিং অফিসার, ইকো ইনোভেটরস
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৬