আধুনিকায়ন, বিশ্বায়ন, শিল্পায়ন ও গতিশীলতার এই সময়ে কর্মমুখরতা মানুষের নিত্যদিনের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিক মুনাফা লাভের আশায় বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মীদের নির্দিষ্ট সময়ান্তেও অতিরিক্ত সময় কাজ করিয়ে নিচ্ছে, যা কর্মীদের করে তুলছে ক্লান্ত ও অবসন্ন। অথচ কর্মীরা প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধি, পদোন্নতি ও অধিক আয়ের আশায় প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মোতাবেক প্রতিষ্ঠানকে তাঁদের সর্বোচ্চ মেধা ও শ্রমে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করছেন। কিন্তু এতে কি প্রতিষ্ঠানটি সত্যিই খুব বেশি লাভবান হচ্ছে? বাস্তব চিত্র বলে, এতে প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষভাবে লাভবান হলেও লোকসানে পড়ছে পরোক্ষভাবে। কীভাবে? নিঃসন্দেহে এটি বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। প্রত্যক্ষভাবে প্রতিষ্ঠানের লাভ হচ্ছে পণ্য বা সেবার পরিসর বাড়িয়ে। অন্যদিকে কর্মীদের শারীরিক ক্লান্তি ও মানসিক বিষন্নতা প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবার গুণগত মানকে করছে ক্ষুন্ন। যার ফলে ধীরে হলেও প্রতিষ্ঠান তার অর্জিত সুনাম হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরোক্ষভাবে।

উত্তরণের উপায়
বিষয়টি নিয়ে প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে মনোবিদ, গবেষকদের বিস্তর গবেষণা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণের ফলাফল ‘ছোট একটু দিবানিদ্রা’। শুনতে ব্যাপারটা হাস্যকর শোনালেও এটি কিন্তু দারুণ কার্যকর বলে প্রমাণিত। আমেরিকান নভোকাশ গবেষণাকেন্দ্র নাসার এক গবেষণায় দেখা যায়, দুপুরে খাবারের পর ১০ মিনিট থেকে ৩০ মিনিটের একটু দিবানিদ্রা একজন কর্মীকে ১৬ শতাংশ বেশি কর্মোদ্যম, গতিশীল ও সতেজ রাখতে সক্ষম, যা প্রতিষ্ঠানকে তার উৎপাদনশীলতা, গতিশীলতা ও সেবার গুণগত মান অক্ষুন্ন রাখতে সহায়তা করে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ককেন্দ্রিক অনেক প্রতিষ্ঠানই ইতিমধ্যে এর প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা বুঝতে পেরেছে। আর তাই তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের জন্য সংযোজন করেছে একটি Nap Room বা ঘুমঘর। এর প্রয়োজনীয়তা কী পরিমাণ বেড়েছে তা বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রের মানবসম্পদ উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত একটি জরিপের মাধ্যমে। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিষ্ঠানে Nap Room সংযোজন করেছিল, যা ২০১১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৬ শতাংশে। এই সুবিধাদানের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মপরিবেশ, প্রতিষ্ঠানের প্রতি কর্মীদের ইতিবাচক মনোভাব এবং কাজের গুণগত মান ও গতিশীলতা বেড়েছে বহুলাংশে। যাতে দারুণ উৎসাহী প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০০৩ সালে নাসার একটি গবেষণা বলছে, ‘দিবানিদ্রা কর্মীদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি ও বুদ্ধিমত্তা তীক্ষ্ন করে। বিশেষ করে যেসব কর্মী জটিল এবং একই সঙ্গে একাধিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। ‘The National Sleep Foundation’ প্রতিবছর গণসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক ‘National Sleep Awarness Week’ পালন করে। যেখানে-
স্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা ও সুরক্ষার জন্য ঘুমের প্রয়োজনীয়তা
স্বল্প ঘুমের অপকারিতা এবং
ঘুমের সমস্যা সমাধান সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা হয়।
যেকোনো প্রতিষ্ঠান নিজ স্বার্থেই প্রতিষ্ঠানে একটি ঘুমঘর সংযোজন করে একে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারে, যা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের তাঁদের কাজের প্রতি আরও মনোযাগী, উদ্যমী ও আন্তরিক করে তুলবে। যাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাভ হবে প্রতিষ্ঠানের।

আরামদায়ক ঘুমঘর
কীভাবে একটি ঘুমঘরকে আরামদায়ক ও আকর্ষণীয় করা যায় তা নিয়েও হয়েছে বিস্তর গবেষণা এবং চলছে এখনো। এখানে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো কর্মীদের একটি ছোট্ট কিন্তু পরিপূর্ণ বিশ্রামের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। একটি ঘুমঘরকে আরামদায়ক করতে প্রথমেই যে বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হবে তা হচ্ছে এটি অবশ্যই অফিসের সবচেয়ে কোলাহলমুক্ত নিরিবিলি কোনো স্থানে স্থাপন করতে হবে। ঘরটি যদি শব্দ প্রতিরোধক করা সম্ভব হয় তবে তো কথাই নেই। এখানে প্রয়োজনীয়সংখ্যক আরামদায়ক ঘুমের উপযোগী কেয়ার স্থাপন করতে হবে, পাশাপাশি এর অভ্যন্তরীণ সাজ অবশ্যই মনোরম হতে হবে। নরম আলোয় মৃদ সংগীতে অল্প সময়ের দিবানিদ্রা যে কাউকেই করে তুলবে আরও বেশি সতেজ, চাঙা ও চনমনে। নির্দিষ্ট সময় পর স্পিকারের সাহায্যে বা আলো জ্বালিয়ে দিয়ে তাঁদের ঘুম থেকে ডেকে দেওয়া যেতে পারে। ঘুম থেকে ওঠে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ গরম চা বা কফি পান কর্মীদের আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে, যা কাজের প্রতি তাঁদের আরও বেশি মনোযোগী, উদ্যমী ও সৃজনশীল করে তুলবে।

ঘুমঘর তৈরির মাধ্যমে অফিসের অনেককেই ক্লান্তিকর ও একঘেয়েমি পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিয়ে অফিসের সার্বিক কর্মপরিবেশে প্রাণ সঞ্চার করা সম্ভব। প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ও উপভোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমাদের এখানকার বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে পারে।
- আশিক মাহমুদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৭ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৪