যান্ত্রিক এ শহরে বসতবাটি প্রতিনিয়তই ছোট হয়ে আসছে। ক্ষুদ্র এই পরিসরে শোয়া-বসার জায়গাটুকু বাদে বাকি জায়গাতেই চলে যাপিত জীবনের অন্যান্য কাজ। এর মধ্যে রসনাবিলাসে গিন্নির রসুইঘরটি একবারেই কোণঠাসা। রসুইঘর বা রান্নাঘরটি ছোট হোক কিংবা বড়, রান্না তো করতেই হবে। কথায় আছে না ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।’
নতুন ফ্ল্যাট হোক অথবা পুরোনো বাড়িতে করা নতুন ইন্টেরিয়রে রান্নাঘরের থাকা চাই একটি স্পেশাল টাচ। গৃহিণীদের বেশির ভাগ সময় কাটে রান্নাঘরে। আর কারও যদি শখ থাকে রান্না করার, তবে তো কথাই নেই। একটা সুন্দর ঝকঝকে রান্নাঘর রান্না করার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয় দ্বিগুণ। প্রথমেই খেয়াল রাখতে হবে রান্নাঘরের দেয়াল যেন ড্যাম্প ও ক্র্যাক ফ্রি হয়। দেয়ালে লাগিয়ে নিন কমপক্ষে সাত ফিটের টাইলস। রান্নাঘরের দেয়ালের কর্নার পারফেক্ট রাইট অ্যাঙ্গেল হলে টাইলস লাগানো সুবিধা। টাইলস নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিন যেকোনো হালকা রংকে। দেয়ালের ভেতর দিয়ে ইন্টারনাল প্ল্যাম্বিং থাকলে দেয়াল ওয়াটাপ্রুফ করে নিন। টাইলস কেনার সময় যে বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো টাইলস যেন হয় স্ট্রং, হিট রেজিস্ট্যান্ট, স্টেন রেজিস্ট্যান্ট। আর যদি আপনার রান্নাঘরকে ডিফরেন্ট ও ক্রিয়েটিভ লুক দিতে চান তাহলে নানা আকারের ও রঙের টাইলস ব্যবহার করুন রান্নাঘরের দেয়ালে। সিরামিক, পোর্সেলিন, কাচের আধুনিক টাইলস আজকাল খুব জনপ্রিয়। দেয়ালের খুঁত ঢাকতেও টাইলসের ব্যবহার দারুণ কার্যকরী। সে ক্ষেত্রে প্রযোজন দক্ষ মিস্ত্রির। টাইলস লাগাতে প্রয়োজনে হিট প্রুফ অ্যাডেসিভ ব্যবহার করুন। ইলেকট্রিক সুইচ ও সকেটের প্ল্যান আগে থেকে করে নিন। যাতে অযথা টাইলস বেশি কাটতে না হয়। ইজি টু ক্লিন, হিট প্রুফ এবং দীর্ঘদিন ভালো থাকে দেয়ালের জন্য এমন সারফেস স্ট্রাকচার বেছে নিন। টাইলসের জোড়া যাদের পছন্দ নয়, তাদের জন্য দরকার আদর্শ স্টোন ওয়াল। বড় পাথরের সংযেযাব ব্যবহার করলে দেয়ালে জোড়ার কোনো ব্যাপার থাকবে না। তবে এটি ব্যয়বহুল। ট্রাডিশনাল এবং কনটেম্পোরারি দুই ধরনের অন্দরসাজেই রাফ টেক্সচারড স্টোন ভালো মানায়। বড় রান্নাঘরে রাফ টেক্সচারড স্টোন ভালো মানায়, ছোট রান্নাঘরের জন্য পলিশ স্টোন সংযেযাব আদর্শ। যেহেতু তেল-মসলাদার রান্না বেশি খাই, তাই প্রতিদিন টাইলস ক্লিনার দিয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করে নিলে টাইলসে সহজে দাগ পড়বে না।

রান্নাঘরে কেবিনেট একটা ভিন্নমাত্রা এনে দেয়। কিচেন কেবিনেটের মেটেরিয়াল হয় নানা ধরনের। রাবার উড, লেমিনেটেড বোর্ড, সেগুন, বার্মাটিক, মেলামাইন বোর্ড ইত্যাদি। বাজেট অনুযায়ী পছন্দের মেটেরিয়ালটি বেছে নিন। ছোট পরিবারের জন্য মডিউলার কিচেন অনেকটা সুবিধাজনক। ড্রয়ার, কেবিনেটে স্টিলের বাস্কেটসংবলিত রান্নাঘরে সব ধরনের কিচেন ওয়্যার, বোতল, কৌটা রাখার সুব্যবস্থা থাকে। ওপেন কিচেনের জন্য সুদৃশ্য রান্নার ব্যবস্থা করুন। যতটা সম্ভব নিচের পাল্লায় গ্লাস এড়িয়ে চলুন। কেবিনেটের রঙের ক্ষেত্রে পলিশ, ল্যাকার, ডুকো, এনামেল পেইন্ট যেকোনো কিছুই বেছে নিতে পারেন। লক্ষ রাখবেন রান্নাঘরের কেবিনেটের সঙ্গে টাইলসের যেন একটা সামঞ্জস্য থাকে। রান্নাঘরের সিলিংয়ে বা দেয়ালে উজ্জ্বল আলোর সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরের কাউন্টারে ডাউন লাইট বা অ্যাঙ্গেল লাইট লাগাতে পারেন। সবজি কুচানো বা কিচেন গ্যাজেট অপারেট করতে সুবিধা হবে। কিচেনের স্টোরিং কেবিনেটর ভেতরেও লাইট লাগাতে পারেন। রান্নাঘরের একটা কর্নারে বানিয়ে নিন কাচের পাল্লা দেওয়া ছোট কেবিনেট। কেবিনেটের মধ্যে স্পট লাইট এবং গ্লাস শেলফের ব্যবহার কিচেনকে করে তোলে আকর্ষণীয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের সিলিং এবং হ্যাংগিং লাইটও আজকাল বাজারে পাওয়া যায়। যাঁরা খাদ্যরসিক তাঁদের বাড়িতে বিভিন্ন রেসিপির বই থাকাটাই স্বাভাবিক। আর সেগুলো রাখার আদর্শ জায়গা হলো কেবিনেট। কিচেন কাউন্টারের জন্য মার্বেল অথবা গ্রানাইটের সংযেযাব নির্বাচন করুন। যাঁরা স্পাইসি খাবার খান, তাঁদের ইলেকট্রিক চিনি এবং একজস্ট ফ্যানের মাধ্যমে কৃত্রিম বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকাটা রান্নাঘরের পরিচ্ছন্নতার জন্য খুবই জরুরি। কর্মজীবী দম্পতিদের জন্য আরেকটি প্রয়োজনীয় গ্যাজেট হলো মাইক্রোওয়েভ ওভেন। রান্নাঘরের তাপ ঝাঁঝ এড়িয়ে চটজলদি রান্না বা খাবার গরম করার জন্য মাইক্রোওয়েভ ওভেন দারুন কার্যকর। এ ছাড়া পরিশ্রæত পানীয় জলের জন্য ওয়াটার পিউরিফায়ারের ভূমিকাও রান্নাঘরে অনস্বীকার্য।

প্রয়োজনীয় টিপস
- রান্নাঘরের আয়তন অনুযায়ী কোথায় কোন গ্যাজেট রাখবেন তা ঠিক করে নিন।
- রান্নাঘর বড় হলে ফ্রিজ রান্নাঘরে রাখতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রেই ঘরে দুটি ফ্রিজ থাকে। সে ক্ষেত্রে ডিপ ফ্রিজ রান্নাঘরে আর রেফ্রিজারেটর খাবার ঘরে রাখুন।
- রান্নাঘরের ফ্রিজ রাখার সময় লক্ষ রাখুন, জায়গাটি যেন খোলামেলা হয়। ফ্রিজের জন্য আলো-বাতাস খুবই জরুরি। সবচেয়ে ভালো হয় জানালার আশপাশের জায়গায় ফ্রিজ রাখতে পারলে।
- রান্নাঘরের কাউন্টার সাধারণত দুই ধরনের হয়। বড় রান্নাঘরে ‘ইউ’ শেপের কাউন্টার আর ছোট রান্নাঘরের ‘এল’ শেপের কাউন্টার। রান্নাঘর বড় হলে কাউন্টারের যেকোনো এক পাশে ওভেন রাখুন। তবে ওভেনের দুই পাশে কিছুটা ফাঁকা জায়গা রাখুন, যাতে ওভেনে রান্নার আগে বা পরে পাত্রগুলো ফাঁকা স্থানে রাখা যায়।
- ওভেন সব সময় দেয়ালের পাশে রাখা উচিত। জানালার আশপাশে ওভেন না রাখাই ভালো। ব্লেন্ডার, টোস্টার, কফি মেকার এমন নিত্যপ্রয়োজনীয় গ্যাজেটগুলো ওভেনের পাশেই রাখুন।
- রান্নাঘর ছোট হলে ওভেন, ব্লেল্ডার, টোস্টার মেশিন এ জাতীয় গ্যাজেটগুলো ডিনার ওয়াগন বা ক্রোকারিজ কেবিনেটে রাখতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ডিনার ওয়াগন বা কিচেন কেবিনেটের মধ্যের অংশে তাক করে এ গ্যাজেটগুলো রাখুন।
- রাইস কুকার রান্নাঘরের অতি প্রয়োজনীয় একটি গ্যাজেট। রাইস কুকার রান্নাঘরের কাউন্টারের এক পাশে রাখুন। খেয়াল রাখুন, জায়গাটি যেন বার্নার থেকে খানিকটা দূরে হয়।
- প্রেসার কুকার, ফ্রাইপ্যান কাউন্টারের নিচের কেবিনেটে রাখুন।
- চামচ, ছুরি, কাঁটা চামচ, চপার, পিলার, সালাদ কাটারসহ এ ধরনের গ্যাজেটগুলো কাউন্টারের ওপরই রাখতে পারেন। বার্নারের আশপাশেই রাখুন, যাতে রান্নার সময় হাতের কাছেই পাওয়া যায়। কাউন্টারের ওপরে জায়গা না হলে কাউন্টারের নিচে ড্রয়ার করেও রাখতে পারেন।
- থালা-বাসন রাখার জন্য র্যাক সিঙ্কের পাশেই রাখতে চেষ্টা করুন। বাজারে অনেক ধরনের র্যাক পাওয়ায়। একটু ভিন্নতা আনতে চাইলে দেয়াল কেবিনেটের মধ্যে কাঠ দিয়ে তৈরি করে নিতে পারেন থালা-বাসন রাখার তাক।
- সিঙ্কের পাশে এক থেকে দেড় ফিট খালি জায়গা রাখুন। থালা-বাসন ধুয়ে পানি ঝরাতে জায়গাটুকু বেশ কাজে দেয়।
- তোয়ালে বা কিচেন টিস্যু সিঙ্কের পাশের দেয়ালের কিছুটা ওপরে রাখুন।
রান্নাঘর ছোট হোক কিংবা বড়, রান্না তো করতেই হবে। তবে রান্নাঘর ছোট হলেও চিন্তা নেই। লম্বা কিচেন কাউন্টারের মধ্যে খানিকটা স্পেস বাড়িয়ে নিতে পারেন। কাউন্টারের মধ্যে আলাদা আলাদা দুটি জায়গায় মাপমতো কেটে ব্যবধান তৈরি করে নিন। হিঞ্জ দিয়ে লগবোর্ড লাগিয়ে পুল আউট টেবিল বানিয়ে নিন। প্রয়োজনমতো সেটা তুলে বোল্ট আটকে দিয়ে গ্যাপটা ভরে নিলেই কাজ হবে। এবার ওই টেবিলের ওপর সবজি কাটা, রুটি বেলা, চপ কাটার, মিক্সি চালানো এসবের সবই করা যেতে পারে। প্রয়োজন না থাকলে বোল্টের মুখে বোল্টটি ঝুলিয়ে দিলেই হলো।

সিঙ্কের নিচে ফাঁকা জায়গায় শেলফ বানিয়ে নিয়ে সেখানে থালা-বাসনা ধোয়ার সাবান, স্ক্র্যাবার, বাসন, ন্যাপকিন গুছিয়ে রাখতে পারেন। ধোয়া থালা-বাসনা যেখানে সেখানে উপুড় করে না রেখে সিঙ্কের সামনের ফাঁকা দেয়ালে ঝুলিয়ে নিন ওয়্যার শেলফ। তাতে পানি ঝরে যাবে। নিয়মিত সপ্তাহের একটা দিন বের করে কিচেন শেলফ গোছান। এতে শেলফ অগোছালো হয়ে কাজের সময় জিনিস জমে থাকার অসুবিধা থাকবে না। রান্নাঘরের বাইরের কোনো তাকে শেলফে রাখার ব্যবস্থা করুন। সেখান থেকে বের করে নিয়ে এসে কাজে লাগিয়ে আবার তুলে রাখুন। প্রতিদিন ব্যবহারের জিনিসপত্র স্লাইড শেলফে রাখার ব্যবস্থা নিন। পুরোনো দিনের ঝোলানো শিকের মতো সিলিং থেকে নানা মাপের ওয়্যার বক্স কিচেনে রাখার ব্যবস্থা করুন।
ফারজানা গাজী
প্রধান নির্বাহী ও ডিজাইনার
ফারজানা’স ব্লিস
www.farzanasbliss.com
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫০ তম সংখ্যা, জুন ২০১৪