এসো হে বৈশাখ এসো এসো… বাংলা নতুন বছরকে চমৎকার এই গানটির সুরে উৎসবের আমেজে নয়নাভিরাম রঙের বহুমাত্রিক নান্দনিকতায় খরতাপ গ্রীষ্মের প্রথম দিনটিকে বরণের অপেক্ষায় থাকে বাঙালি। বৈশাখ এলেই সবার মাঝে জেগে ওঠে ষোলো আনা বাঙালিয়ানা। অন্তরে সব সময় বিরাজ করে বাঙালিরূপ, যা দৃশ্যমান আমাদের নিত্যনৈমত্তিক ব্যবহার্য জিনিসপত্র তথা কাপড়চোপড় আর গৃহসজ্জায়। একজন দক্ষ ইন্টেরিয়র ডিজাইনারের পরামর্শে আপনি আপনার আধুনিক ঘরটিতে মুহূর্তেই আনতে পারেন বৈশাখের ছোঁয়া। পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণীনির্বিশেষে সব বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আর আনন্দ-উচ্ছল আয়োজনের কথা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, এটিই এখন বাঙালির একমাত্র সর্বজনীন উৎসব। আর এ উৎসব এলেই ঘরের প্রতিটি কোণে বাংলার রূপ তুলে ধরার চেষ্টায় সদা ব্যস্ত থাকেন গৃহিণীরা। উৎসবমুখর এ দিনটি শুধু নিজেকে সাজাতেই নয় বরং এর সৌন্দর্যের ছোঁয়া ছড়িয়ে যায় শৈল্পিক অন্দরমহলেও।
দিনটি যেহেতু উৎসবের স্বভাবতই ঘরে থাকে অতিথিদের আনাগোনা। আর তাই দেয়ালের নতুন রং, দরজা-জানালায় নতুন পর্দা, মেঝেতে শতরঞ্জি, ঘরের বিভিন্ন কোণে মাটির পটারির সঙ্গে খাবার টেবিলে মাটির থালাবাসনের সরব উপস্থিতি ঘরে আনে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। এ দিনের ঘর সাজানোতে প্রাধান্য পায় নানা ধরনের শৌখিন দেশীয় উপকরণ। আর এসব সামগ্রী দিয়ে সাজানো ঘর রূপ নেয় উৎসবের। কেননা বৈশাখ বাঙালির একান্তই নিজস্ব সাংস্কৃতিক উৎসব; আর তাই অন্দরের সাজে দেশি জিনিসের ব্যবহারে সহজেই প্রকাশ পায় শতভাগ বাঙালিয়ানা।
উপকরণ যখন মঙ্গল শোভাযাত্রার
দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে বাঙালিমাত্রই আমরা কমবেশি পরিচিত। বর্ণিল মুখোশ, তালপাতার পাখা, কুমির, হাতি, পেঁচা, বাদুর, টিয়াকে ঘিরেই মঙ্গল শোভাযাত্রা। শিল্পীর তুলির আঁচড়ে তৈরি এসব সামগ্রীও শোভা পেতে পারে আপনার ঘরের দেয়ালে। ঘরের লবিতে বা ফয়ায়ে টাঙিয়ে দিন মুখোশ, বসার ঘরের দেয়ালে তালপাখা, কারুকার্যময় হাতপাখা, কুলো অথবা চারুশিল্পীর হাতে আঁকা বিভিন্ন ধরনের পেইন্টিংও ঝুলতে পারে বসার ঘরের দেয়ালে। আর আপনার সংগ্রহে যদি থাকে বাঁশের শিল্পকর্ম তবে তো কথাই নেই। বাঁশ, মাটি আর কাগজের মুখোশের দারুণ কম্বিনেশন বদলে দেবে দেয়ালের সনাতন রূপ। এ ছাড়া ঘরের দেয়ালে লাগাতে পারেন নান্দনিক ওয়াল ম্যাট, যা দেবে বৈশাখী আমেজ।

মৃৎশিল্পের ছোঁয়া
গ্রামীণ আবাহ আনতে ঘরের বিভিন্ন কোণে রাখতে পারেন মাটির পটারি। নানা আকৃতির মাটি পটারিতে শোভা পাবে ইনডোর প্লান্টস কিংবা কাগজের তৈরি রংবেরঙের ফুল। সিঁড়ির কর্নারে মাটির চাড়িতে ফ্লোটিং, মোমবাতির সঙ্গে ছড়িয়ে দিতে পারেন তাজা ফুলের পাপড়ি কিংবা ফুল, ঘরে ফুলের সুগন্ধি আর সবুজের ছোঁয়া প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেবে মনকে। ঘরের দরজায় ঝোলাতে পারেন মাটির ঘণ্টি। ঘণ্টার টুং টুং শব্দ আপনাকে নিয়ে যাবে অপূর্ব সুর-সংগীতের মূর্ছনায়। মাটির ফ্রেমে বন্দী করতে পারেন আপনার বিশেষ মুহূর্তের কোনো ছবি। টেবিল ল্যাম্পের নিচের অংশেও ব্যবহার করতে পারেন মাটির তৈরি নানা ধরনের স্ট্যান্ড। প্রবেশপথের মুখে দেয়ালে টানিয়ে দিতে পারেন মাটির আয়না। খাবার টেবিলে খাবার পরিবেশনে ব্যবহার করা যেতে পারে মাটির থালাবাসন।
বাঁশ-বেতের যুগলবন্দী
বসার ঘরে আসবাব হিসেবে বাঁশ ও বেতের জুড়ি মেলা ভার। ঘরে কাঠের আসবাবের পাশাপাশি বিভিন্ন কর্নারে রাখতে পারেন বেত কিংবা বাঁশের ল্যাম্পশেড। অতিথি আপ্যায়নে বেতের ছোট ছোট জলায় রাখা যেতে পারে খই, বাতাসা, মোয়া, পিঠাপুলি প্রভৃতি। এ ছাড়া বাঁশ ও বেতের নান্দনিক ট্রের ব্যবহার আপনার বৈশাখের আয়োজনে এনে দেবে পূর্ণতা। বাঁশের তৈরি ফুলদানিতে রাখুন দেশীয় ফুল। এ ছাড়া বারান্দায় ঝোলাতে পারেন বেত ও বাঁশের তৈরি ফুলের টব। খাবার টেবিলে রাখা যেতে পারে বাঁশের তৈরি ফুলের ঝুড়ি। ঘরের কর্নারে নামাতে পারেন বাঁশের ঝুলন্ত লাইট। ঘরের টেবিল ব্যানার ও ম্যাট হতে পারে বাঁশের।
আলপনায় বর্ষবরণ
আলপনা বর্ষবরণের অন্যতম জনপ্রিয় অনুষঙ্গ। বাড়ির প্রবেশপথ, বারান্দা অথবা ছাদ আলপনায় সাজিয়ে তুলুন আপনার মনের মতো করে। আজকাল টাইলসের বাড়িতে রঙের আলপনা করা সহজ নয়। তাই রঙের পরিবর্তে নানা ধরনের ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি করুন পছন্দের আলপনা। এর মধ্যে নানা আঙ্গিকে ছড়িয়ে দিন প্রদীপ। সন্ধ্যায় প্রদীপের আলো সৃষ্টি করবে রহস্যময় এক পরিবেশ। নতুন করে কিছু না কিনেও বরং ঘরের ফাঁকা জায়গায় নানা ধরনের দেশি লোকজ উপকরণ একটু এদিক-সেদিক করে গুছিয়ে নিয়ে পয়লা বৈশাখের পয়লা দিনটিতে ঘরে আনা যায় শৈল্পিকতার ছোঁয়া। নান্দনিকতার পরশে বছরের প্রথম দিনটিতেই আপনার মন ভরে উঠবে। নিজেকে ভাববেন একজন খাঁটি বাঙালি, যা আপনাকে নিয়ে যাবে হাজার বছরের লোকজ সংস্কৃতির সান্নিধ্যে।

বর্ষবরণে অন্দরসাজের টুকিটাকি
- মূল দরজার প্রবেশদ্বারের পাশেই রাখা যেতে পারে মাটির বা পিতলের পানি ভরা পাত্রে তাজা কিছু ফুল ও পাপড়ি। সঙ্গে ভাসমান রঙিন মোম।
- সোফার পাশাপাশি বাড়তি কিছু চেয়ারও যোগ করতে পারেন বসার ঘরে। রাখতে পারেন বেত বা দড়ির মোড়া ও টুল। অতিথি বেশি হলে বসার ঘর থেকে সেন্টার টেবিল সরিয়ে ফেলুন, এতে বেশ খানিকটা জায়গা পাওয়া যাবে।
- খাবার টেবিলের মধ্যে রাখুন একগুচ্ছ তাজা ফুল। রাতে ক্যান্ডেল স্ট্যান্ড মোম দিয়ে ক্যান্ডেললাইট ডিনারের ব্যবস্থা করুন।
- ঘরের পর্দা, বিছানার চাদর, বালিশের কভার আগেই ধুয়ে ও ইস্ত্রি করে রাখুন। বিছানার কানায় ফুল চাদর ব্যবহার করুন। বৈশাখী আমেজ আনতে লাল, সাদা, কমলা, হলুদ রংকে প্রাধান্য দিন।
- বাচ্চাদের পুরো ঘরটায় শতরঞ্জি দিয়ে তাতে কিছু কুশন, পুতুল ও খেলনা রাখুন।
- খাবার টেবিলে বাঁশ, বেত কিংবা কাপড়ের টেবিল কর্নার ও ম্যাট ব্যবহার করুন। এতে টেবিল সহজেই পরিষ্কার করা যাবে।
ফারজানা গাজী
প্রধান নির্বাহী ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ফারজানা’স ব্লিস
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৮ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৪