সড়কের দীর্ঘস্থায়িত্বে কংক্রিট

ফাটল, ছোট-বড় গর্ত, বিটুমিন উঠে ইট-পাথর বেরোনো, ভারী যানবাহনের চাপে মাটি দেবে কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু এমনই দৈন্যদশা বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কের। প্রচুর বৃষ্টিপাত, বন্যা, প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, জলাবদ্ধতাসহ নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকতে ব্যর্থ হচ্ছে দেশীয় সড়কগুলো। নতুন একটি সড়ক বছর না যেতেই হয়ে পড়ছে ভঙ্গুর। কারণ, সিংহভাগ সড়কই বিটুমিন নির্মিত ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট বা পিচের রাস্তা। এসব বেহাল চিত্র প্রমাণ করে সড়ক নির্মাণে বিটুমিন আদর্শ উপাদান নয়। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) দেশের মোট ২১ হাজার ৪৮১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ১৪ হাজার ৬৫২ কিলোমিটার সড়কে মার্চ, ২০১২ সালে একটি পর্যবেক্ষণ ও জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, তিন হাজার ৫৩৩ কিলোমিটার সড়কই যান চলাচলের একেবারে অনুপযোগী, সাত হাজার কিলোমিটার সড়ক অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, বাকি অংশের অবস্থাও ভালো নয়। সড়কের এই বিপর্যয়ের কারণে প্রতিনিয়তই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। জীবনহানি ও আহতের হারও বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। অথচ একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম শর্ত উন্নত সড়ক যোগাযোগ। এটা নিশ্চিত করতে এ দেশের সড়কের প্রচলিত নির্মাণকৌশল থেকে বেরিয়ে আধুনিক, বিশ্বমানের ও টেকসই সড়ক নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশেগুলোও যখন একই সমস্যার মুখোমুখি, তখন দেশগুলোর বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা বিটুমিন বা অ্যাসফল্ট প্রথা ছেড়ে সড়ক নির্মাণে ব্যবহার করছেন কংক্রিট, যা রিজিড পেভমেন্ট (Rigid Pavement) নামে পরিচিত। এই সড়ক প্রচলিত বিটুমিন সড়কের তুলনায় অনেক বেশি টেকসই, দীর্ঘমেয়াদি এবং অর্থনৈতিকভাবেও দারুণ সাশ্রয়ী।

কংক্রিট সড়ক নি‍র্মাণ প্রক্রিয়া

প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগেও এ দেশে সড়ক নির্মিত হচ্ছে সনাতনি ধারায় অর্থাৎ বিটুমিনে। এগুলোর স্থায়িত্বকাল ২০ বছর বলা হলেও অতিরিক্ত পণ্যবাহী যান চলাচলের কারণে কিছু এক বছর আর বেশির ভাগ সড়কই পাঁচ বছরের মধ্যেই যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। অথচ আগে সড়ক নির্মাণে বিটুমিনের পরিবর্তে কংক্রিটই ব্যবহৃত হতো, যা স্থায়িত্বেও ছিল অনন্য। দ্য গ্রান্ড ট্রাঙ্ক মহাসড়কটি এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো সড়কের মধ্যে একটি। দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার আয়তনের এই মহাসড়কটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে ভারত, পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তানের কাবুলে মিশেছে। প্রায় চার শতাব্দীকাল পেরোলেও মহাসড়কটি এখনো সগর্বে টিকে আছে। ইউফ্রেটিস নদীতীরের দেশগুলোতেও একই প্রযুক্তিতে অনেক সড়ক নির্মিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ছয় হাজার অব্দে ইরাকে প্রথম রিজিড বা কংক্রিট সড়ক নির্মিত হয়। তখন থেকেই সড়ক নির্মাণে অত্যন্ত কার্যকরী নির্মাণকৌশল হিসেবে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। পৃথিবীতে এমন সড়কের কয়েকটির অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান। আগে বাংলাদেশে সিমেন্ট আসত ইন্দোনেশিয়া ও পরে ভারত থেকে। দেশে তখন সিমেন্ট উৎপাদন হতো না। ফলে রিজিড পেভমেন্ট করাও ছিল বেশ ব্যয়সাধ্য। সিমেন্টসংকট ও পশ্চিমা কিছু দেশের চাপে বাধ্য হয়েই এ দেশের সড়কে বিটুমিন ব্যবহার শুরু হয়। সময়ের পরিক্রমায় সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সিমেন্ট উৎপাদনে বাংলাদেশ যে স্বয়ংসম্পূর্ণ তা-ই নয়, করছে রপ্তানিও। এমনকি শিল্পটি ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করলেও পর্যাপ্ত চাহিদা না থাকায় তার পরিসর খুব বেশি বাড়ানো যাচ্ছে না। 

দুঃখজনক হলেও সত্য, বিটুমিনের শৃঙ্খল থেকে এখনো আমরা বেরোতে পারিনি। বিশ্বে উন্নত সব দেশেই হচ্ছে রিজিড পেভমেন্ট সড়ক। তবে এ ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রায় সব শহরের সড়কই নির্মিত হচ্ছে এ প্রযুক্তিতে। মাত্র ছয় মাইলের একটি সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে শতাব্দীকাল আগে শুরু হয় কংক্রিট সড়কের যাত্রা। সে যাত্রা এখন এমনই পর্যায়ে যে গত ২০ বছরে ১১ হাজার মাইলেরও বেশি সড়ক নির্মিত হয়েছে কংক্রিটেই। এমনকি দেশটির মোট সড়ক যোগাযোগের প্রায় ৫০ শতাংশই রিজিড পেভমেন্টে তৈরি। জাপান ও ইতালি সড়ক নির্মাণে এই পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোও এখন আর পিছিয়ে নেই। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় সড়ক, উড়ালসড়কসহ বিভিন্ন প্রকল্পে রিজিড পেভমেন্টকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ‘ইভ্যালুয়েশন অব ফ্লেক্সিবল অ্যান্ড রিজিড পেভমেন্ট কনস্ট্রাকশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে তুলে ধরে, ফ্লেক্সিবল পেভমেন্টের চেয়ে রিজিড পেভমেন্টই সড়ক নির্মাণে সময়োপযোগী ও সাশ্রয়ী। এ ধরনের সড়কের স্থায়িত্ব প্রায় ৫০ বছর। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করলে আরও বহু বছর নির্বিঘ্নে ব্যবহার করা যায়। অন্যদিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ মান বজায় রেখে নির্মাণ করলেও বিটুমিন সড়কের আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ ১০ বছর। অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য, পাঁচ-ছয় বছরের বেশি স্থায়িত্বের কথা বলেন না। আর ঘন ঘন সংস্কারের ঝক্কি তো আছেই।

ব্লক পদ্ধতিতে কংক্রিট সড়ক নি‍র্মাণ

একাধিক গবেষণা এবং নির্মিত বিভিন্ন সড়কের দীর্ঘস্থায়িত্বে প্রমাণ করে রিজিড পেভমেন্ট অত্যন্ত যুগান্তকারী। অর্থাৎ বিটুমিনের ব্যর্থতাকে মুছে এখন সাফল্যের দোরগোড়ায় কংক্রিট। পিচ মিশ্রিত বিটুমিন সড়কের চারটি স্তর থাকলেও তা শুধু ওপরের স্তরকেই আঁকড়ে রাখতে পারে কিন্তু রিজিড পেভমেন্টের কংক্রিট তার সব উপাদানের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি করে বলে অবকাঠামো সহজে নষ্ট হয় না। যেমন- একটি সড়ক দ্রুত নষ্ট হলেও ওই সড়কেরই একটি সেতু কংক্রিট নির্মিত বলে ৩০-৪০ বছর পেরোলেও তেমন ক্ষতি হয় না। এর অন্যতম কারণ বিটুমিন পানিতে শক্তি হারায়, কিন্তু কংক্রিট পায় শক্তি। তা ছাড়া রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণে ব্যবহৃত হয় পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্ট, কোর্স অ্যাগরিগেইট, বালু এবং পানি, যার সবটাই শক্তিশালী প্রাকৃতিক উপাদান। এ ছাড়া অবকাঠামোর কার্যক্ষমতা ও স্থায়িত্ব বাড়াতে তাতে মেশানো হচ্ছে আধুনিক নানা উপাদান। ফলে কংকিট সড়ক হচ্ছে অত্যন্ত শক্ত, নিরেট ও অধিক চাপ সহনীয়। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় তা দারুণ কার্যকরী। কারণ, আমাদের জলবায়ুতে ময়েশ্চার বা আর্দ্রতা অনেক বেশি। কংক্রিট চরমভাবাপন্ন জলবায়ুতেও রাসায়নিক আক্রমণ সহ্য করে টিকতে পারে। এর স্থায়িত্ব, শক্তিমত্তা, বাহ্যিক রূপসহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অর্থাৎ সিমেন্ট, বালু, স্টিল, পানি ও অনুষঙ্গিক উপাদানের সঠিক অ্যাডমিক্সচারের মাধ্যমে এবং এয়ার এনট্রেইনমেন্ট ও যথাযথ কিউরিংয়ের মাধ্যমে রিজিড পেভমেন্টকে যদি পানিরোধী করা যায়, তাহলে সড়কের স্থায়িত্ব বাড়ে কয়েক গুণ।

এ ধরনের সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ যেমন কম, তেমনি ভারী ও বেশি যানবাহন চলাচলের জন্য দারুণ উপযোগী। স্থান ও জলবায়ুর ধরন অনুযায়ী বিশ্বে বিভিন্ন প্রযুক্তিতে রিজিড পেভমেন্ট নির্মিত হচ্ছে। এর মধ্যে বড় সড়কের ক্ষেত্রে রোলার কমপ্যাক্ড কংক্রিট (RCC) এবং ছোট পরিসরে কমপ্যাক্ড কংক্রিট (CC) পদ্ধতি নির্মাণের বহুল প্রচলিত ধারা। তবে অধুনা নিত্যনতুন প্রযুক্তি যোগ হচ্ছে এ পদ্ধতিতে। যেমন- নির্মাণকাজকে দ্রুত ও অধিক টেকসই করতে কাস্ট-ইন-সিটু ছেড়ে প্রি-কাস্ট বা প্রি-স্ট্রেস পদ্ধতি বেছে নিচ্ছেন প্রকৌশলীরা। কারণ, জয়েন্ট টু জয়েন্ট পদ্ধতিতে নির্মিত এ কংক্রিট মূলত  প্রি-কাস্ট বা প্রি-স্ট্রেসড প্রক্রিয়ায় তৈরি লম্বা ক্লিয়ার স্প্যান, যা যেকোনো স্থান থেকে তৈরি এবং পরিবহন করে নির্মাণস্থানে খাপমতো জোড়া লাগানো যায়। কোনোভাবে এর কোনো স্প্যান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেটি সরিয়ে অন্য একটি স্প্যান জুড়ে দেওয়া যায়। ফলে বিটুমিন সড়কের মতো বছর বছর কার্পেটিংয়ের ভোগান্তি পোহাতে হয় না এবং সাশ্রয় হয় বিপুল অঙ্কের অর্থ। যেসব সড়কে বড় ও ভারী কার্গোভ্যান চলে, সেসব সড়কে ফাইবার রি-ইনফোর্সড কংক্রিট ব্যবহারে অত্যন্ত শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী সড়ক নির্মাণ করা যায়। কংক্রিট পুনর্ব্যবহারযোগ্য বলে তা বেশ পরিবেশবান্ধব। প্রতিনিয়তই পুরোনো অবকাঠামো ভেঙে গড়া হচ্ছে নতুন ভবন, যার অব্যবহৃত কংক্রিট ব্যবহার করে সহজেই হালকা ধাঁচের সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব। যেমন- হাউসিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট ঢাকার বিজয় সরণির র‌্যাংগস ভবনের ভাঙা কংক্রিট দিয়ে নির্মাণ করেছে রেমড আর্থ হাউস। জার্মানির শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা সম্প্রতি রিজিড পেভমেন্টে কংক্রিট অ্যাডমিক্সারে জুড়ে দিচ্ছেন প্লাস্টিক বর্জ্য, ফাইবার, গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ারের টুকরা ও পলেস্তেরিন (কর্কশিট) জাতীয় উপাদান। ফলে কংক্রিটের পানি সহনীয় ক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি সাধারণ সড়ক নির্মাণ থেকে ১২ শতাংশ অর্থ, ১৫ শতাংশ নির্মাণ সময় এবং এর জীবনকালে ৪০ শতাংশ শক্তি সাশ্রয়ে সক্ষমতা লাভ করছে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, বিটুমিন সড়ক গাড়ির জ্বালানি খরচ বাড়িয়ে দেয় এবং টায়ারের প্রচুর ক্ষয় সাধন করে। তা ছাড়া ভঙ্গুর সড়কগুলো যানবাহনের কাঠামোরও আয়ু কমিয়ে দেয়, যার সবটাই অর্থনৈতিক ক্ষতি। অথচ রিজিড পেভমেন্ট ১০ শতাংশের বেশি জ্বালানি সাশ্রয় করে যানবাহনের মাইলেজ বাড়াতে সাহায্য করে।

রিজিড পেভমেন্টের নানামুখী স্তর

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ। বন্যা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা জলাবদ্ধতার মতো দুর্যোগ দেশটির নিত্য সঙ্গী। এ দেশের অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়কই নষ্ট হয় বর্ষা মৌসুমে। সে সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত, বন্যা, জলাবদ্ধতাসহ নানা কারণে সড়কের পিচ-বিটুমিন উঠে গিয়ে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। গ্রামের সড়কগুলোর অবস্থা আরও সঙিন। সাধারণত গ্রামের সড়ক নির্মিত হয় কৃষিজমির ভেতর দিয়ে এবং উঁচু করতে পার্শ্ববর্তী মাটিই ব্যবহৃত হয়। বৃষ্টি বা বন্যার সময় প্রচণ্ড বেগে পানি সড়কের ওপর দিয়ে প্রভাবিত হয়, এতে সহজেই বিটুমিন উঠে গিয়ে মাটি আলগা হয়ে যায়। তা ছাড়া সড়কের দুই পাশের গাছ থেকে অনবরত পানি পড়তেই থাকে। ফলে সড়কগুলো কোনোভাবেই টিকতে পারছে না। অথচ কংক্রিট উপাদানসমূহের মধ্যে রয়েছে চমৎকার বন্ধন। এটা স্লাব আকারে থাকে অনেকটা ঘরের ছাদের মতো। তাই এর ওপর দিয়ে পানি বয়ে গেলেও তেমন ক্ষতি হয় না। নিচ থেকে মাটি সরে গেলেও এটা ধসে পড়ে না। রাজধানীর সড়ক চিত্রও ভালো নয়। অধিকাংশ এলাকাই অপরিকল্পিত। এসব এলাকার সড়কে যথাযথ পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। থাকলেও তা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। অনেক সড়কে জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। এমনকি শুষ্ক মৌসুমেও ডিসিসির নর্দমা আর ওয়াসার পয়ঃপ্রণালির উপচানো দুর্গন্ধময় ময়লা পানিতে সয়লাব থাকে সড়কাগুলো। আর বছরজুড়ে এলাকাবাসীর দুর্দশাও চলতে থাকে সমানে। এ ক্ষেত্রেও কংক্রিট পেভমেন্ট অতুলনীয়। জমে থাকা পানি রাস্তার অতিমাত্রায় ক্ষতি করতে পারে না। বিগত বছরগুলোতে ডিসিসি অল্প কিছু রাস্তায় কংক্রিটে নির্মাণ করেছে, যা বহু দিন যাবৎ অটুট আছে। 

জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈষ্ণিক উষ্ণতার ঘনঘটায় যখন বিশ্ব তখন পরিবেশ বিপর্যয়রোধে প্রতিটি বিষয়কে আলাদা আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সড়ক যোগাযোগও এর বাইরে নয়। এর সঙ্গে পরিবেশ বিপর্যয়ের নানা অনুষঙ্গ সরাসরি জড়িত। সড়ক নির্মাণের সময় চুল্লিতে জ্বাল দিয়ে বিটুমিন ও পিচের মিশ্রণ তৈরি করা হয়; নির্গত হয় প্রচুর কালো ধোঁয়া। প্রচুর জ্বালানি ব্যয়ের ফলে কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়ে। তা ছাড়া তখন ওই স্থানের তাপমাত্রা পৌঁছায় ১৩৫-১৫০ ডিগ্রি সে., যা বৈশ্বিক উত্তাপ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ব্যাপারটা শুধু তখনই ঘটছে তা কিন্তু নয় বরং পৃথিবীকে উত্তপ্ত করার প্রক্রিয়া সবে শুরু হচ্ছে। কারণ বিটুমিন সড়কের তাপ শোষণ ক্ষমতা নেই বললেই চলে। এটা তাপ শোষণ না করে তা বায়ুমণ্ডলে আবারও ফিরিয়ে দেয়। গ্রীষ্মের দাবদাহে সড়কের পিচ গলে যাওয়া এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। তা ছাড়া প্রতিনিয়ত গাড়ির চাকার ঘর্ষণেও উত্তাপের সৃষ্টি হয়। এভাবে বিশ্বব্যাপী লাখও মাইল বিস্তৃত বিটুমিন সড়ক বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য কতটা দায়ী তা সহজেই অনুমেয়। এরই ফলে গ্রিন হাউস ও হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট সৃষ্টিতে বিটুমিন সড়ক যে মুখ্য ভূমিকা রাখছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

রিজিড পেভমেন্টের লেয়ারসমূহ

আবার জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ায় মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে এ দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলগুলোতে। জোয়ারের সময় সাগরের লোনাপানি অনেক সড়কের ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। এই লোনাজল খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই সড়ক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্থ করে ফেলছে, যার প্রকৃত উদারণ টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপসংলগ্ন সড়ক। সাতক্ষীরা, খুলনা, কক্সবাজারসহ অন্যান্য এলাকাও এর ব্যতিক্রম নয়। বিটুমিনে ব্যবহৃত কালো রঙের পিচ সাধারণত অশোধিত পেট্রোলিয়ামের উচ্ছিষ্ট বা বর্জ্য থেকেই তৈরি হয়। এতে পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বিষাক্ত হাইড্রোকার্বন থাকে। পিচ উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহন এবং ব্যবহারের সময় বাতাসে প্রচুর হাইড্রোকার্বন ছড়ায়। আর এই বিষাক্ত উপাদান পাথরে মিশিয়ে সড়ক নির্মিত হয়। অথচ এটা সবার অগোচরেই এর পুরো জীবনকালেই মানবদেহ, প্রাণীকুল ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সূর্যের তাপে প্রায় সব সময়ই পিচ থেকে বিষাক্ত হাইড্রোকার্বন নির্গত হয়। তা ছাড়া বৃষ্টির পানিতে পিচ ধোঁয়া পানি যখন ফসলি জমিতে মেশে তখন ফসল, মাছসহ জলাভূমির বিভিন্ন প্রাণীর ওপরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তা ছাড়া সড়ক নির্মাণকারী শ্রমিকদের নানা সমস্যার বিষয়টি আড়ালেই থেকে যায়। যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রায়ই গরম পিচে তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ দগ্ধ হয়। তা ছাড়া দীর্ঘদিন যারা, সরাসরি সড়ক নির্মাণের সঙ্গে জড়িত, তারা ক্যানসারসহ প্রায় ১৯ রকম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভোগে। এগুলোর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথা, ত্বকের রোগ, কফ, অস্থিরতা, গলা ও চোখের সমস্যা, ক্ষুধামান্দ্য ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অথচ এসব ক্ষতির কোনোটাই হয় না যদি সড়কগুলো কংক্রিটে নির্মিত হয়। পরিবেশ বাঁচাতে বিশ্বের প্রতিটি সড়কই যত দ্রুত সম্ভব আসছে ‘ইকো-লেন’-এর আওতায়; তবে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব।

যোগাযোগ খাতে একটি দেশের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। এই ব্যয় কোনো অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য বহন করা কষ্টসাধ্য। প্রতিবছর আর্থিক বাজেটে এ খাতে প্রচুর অর্থবরাদ্দ রাখায় দেশটির নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়ন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তা ছাড়া বছর বছর সড়কগুলোর মেরামত ও কার্পেটিং ব্যয় তো আছেই। অথচ রিজিড পেভমেন্ট নির্মিত হলে এসব ঝামেলা থেকে অনেকটাই পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। তবে সে ক্ষেত্রে ব্যাপক পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও গাইডলাইন ঠিক করতে হবে যেন সবকিছুই সুষ্ঠুভাবে এবং নিয়ম মেনে করা হয়। কারণ যেকোনো ভুল পুরো সম্ভাবনাকেই নষ্ট করে দেয়। এ ছাড়া ঠিকাদার বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজের নীতিমালা করতে হবে। প্রকৌশলী; ঠিকাদার এমনকি শ্রমিকদের এ প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সড়ক, মহাসড়কে রিজিড পেভমেন্টের কোন পদ্ধতি ও স্ট্যান্ডার্ড মানা হবে তাও ঠিক করে নিতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারেও অবহেলা করা যাবে না। তা ছাড়া কারণে অকারণে যেন সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি না করা হয় সে জন্য সড়কের নিচে টানেল পথে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, ইন্টারনেট, টেলিফোনসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় লাইন টানা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে আগে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে দেশের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের বিশেষ করে সওজ, এলজিইডির বুয়েটসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে। এবং যদি এসব প্রতিষ্ঠানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে রিজিড পেভমেন্ট সড়ক নির্মাণ করা যায় তাহলে সড়ক সংস্কারের নামে ব্যাপক দুর্নীতি এবং অপচয়ও কমানো সম্ভব হবে। সড়ক যোগাযোগের সর্বত্রই যদি এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় তাহলে সিমেন্ট, রেডিমিক্স, স্টিল ও অন্যান্য শিল্পের পাশাপাশি কংক্রিট স্প্যান নির্মাণের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে; ঘুচবে বেকারত্ব। তখন আবাসন প্রতিষ্ঠানের মতো সড়ক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হবে, যা অনেকটা বিপ্লবের পর্যায়ে পৌঁছাবে।

আরসিসি কংক্রিটে সড়ক নি‍র্মাণ প্রক্রিয়া

আমরা পৃথিবীকে নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস করছি। কিন্তু আর নয়, এবার থামাতে হবে এই ধ্বংষযজ্ঞ। এ বিশ্বকে রক্ষায় জিরো কার্বন; জিরো ওয়েস্ট পলিসি গ্রহণ করতে হবে। প্রযুক্তি আমাদের সর্বাধুনিক, সহজ, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব সড়ক নির্মাণকৌশল উপহার দিয়েছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটা অনেকটা সোনার কাঠি পাওয়ার মতো ব্যাপার। এখন সময় এর বাস্তবায়ন। মধ্য আয়ের দেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর আমাদের স্বপ্নটি কিন্তু অধরাই থেকে যাবে যদি এগুলো প্রয়োগে আমরা ব্যর্থ হই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এই বিষয়টিকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করেছেন। তাই সম্প্রতি তিনি এ দেশের সড়ক নির্মাণে রিজিড পেভমেন্টের ওপর গুরুত্ব আরোপ ও প্রকৌশলীদের প্রতি তা বাস্তবায়নে আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর এ যুগোপযোগী নির্দেশনা প্রশংসার দাবিদার। এখন তা বাস্তবায়নের ভার সড়ক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজ্ঞ প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। 

মাহফুজ ফারুক

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৯ তম সংখ্যা, মে ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top