সাধারণত যেকোনো ধরনের স্থাপনার স্থায়িত্ব ধরা হয় ১০০ বছর। সেভাবেই স্থাপনার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। এ রকম চিন্তা থেকেই নির্মাণকাজে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ও ভালো মানের নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার চলে আসছে। কিন্তু সঠিক নির্মাণসামগ্রী ও যথাযথ নকশা অনুযায়ী নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার পরেও অধিকাংশ স্থাপনাই তার সম্পূর্ণ আয়ুষ্কাল অবধি টিকে থাকতে পারে না। এই সমস্যা যে শুধু আমাদের দেশেই তা নয়, বরং পৃথিবীর উন্নত দেশেও ঘটছে একই ঘটনা। এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী কংক্রিটের ভেতরের স্টিল বা রডের ক্ষয়। এর ফলে যেকোনো ধরনের স্থাপনার কাঠামো দুর্বল হয়ে এর আয়ুষ্কাল কমে অনেকাংশে।
কংক্রিট কী?
কংক্রিট উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন (Compressive Strength) একধরনের যৌগিক নির্মাণ উপাদান। যার ফলে নির্মাণকাজের জন্য যেকোনো আকার ও আকৃতির কংক্রিট ব্যবহার করা হয়। যেহেতু কংক্রিটের টেনসাইল স্ট্রেন্থ (Tensile Strength) কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থের তুলনায় অনেক কম হয় এ কারণে কংক্রিটে স্টিল যুক্ত করা হয়। এটা এমনভাবে করা হয়, যাতে কংক্রিটের সংস্পর্শে আসা টেনসাইল স্ট্রেন্থের পুরোটাই স্টিলে ট্রান্সফার হয় এবং কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ স্টিলের সঙ্গে বন্ধনকারী কংক্রিটে ট্রান্সফার হয়। কংক্রিটে টেনসাইল স্ট্রেন্থ কম থাকার কারণে যে কোন ধরনের নির্মাণে রিইনফোর্সড কংক্রিট ব্যবহার করা হয়। কংক্রিটে অবস্থিত স্টিল বারের ক্ষয় স্থাপনাসমূহের আয়ুষ্কাল সীমিত করে নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত স্থায়িত্বে বড় ধরনের বাধার সৃষ্টি করে। ফলে স্থাপনাগুলো সম্ভাব্য মেয়াদকাল পর্যন্ত টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়।

কংক্রিটে স্টিলের ক্ষয়
রিইনফোর্সড কংক্রিটে সাধারণত ভিন্ন ভিন্ন সাইজের এবং ভিন্ন শক্তিমাত্রার স্টিল ব্যবহার করা হয়। কংক্রিট এসব স্টিল বারের ধারক বা প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। কংক্রিটে ব্যবহৃত স্টিল বারের মধ্যে তার ওয়েল্ডিং কিংবা অন্যান্য সাপোর্ট অথবা এসব বার নিজেদের দ্বারা নিজেদের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করে।
কংক্রিটের মধ্যকার স্টিলের ক্ষয় একধরনের ইলেকট্রো-কেমিক্যাল পদ্ধতি, যা বিভিন্ন ধরনের আয়নের আদান-প্রদানের মাধ্যমে ঘটে। স্টিলের যে পাশ বেশি সক্রিয় (Active) তাকে অ্যানোড (Anodes) বলে। এই আয়নসমূহ ইলেকট্রন ত্যাগ করে এবং ফেরাস আয়ন হিসেবে চারপাশের কংক্রিটে ছড়িয়ে পড়ে। এই পদ্ধতিকে হাফ সেল অক্সিডেশন বিক্রিয়া বা অ্যানোডিক বিক্রিয়া বলে। এই বিক্রিয়া সংঘটিত হয় যে প্রক্রিয়ায়-
2Fe -2Fe2+ + 4e–
স্টিল বারে যে পরিমাণ ইলেকট্রন অবশিষ্ট থাকে, তা ক্যাথোডে ধাবিত হয়। ওই অংশে সৃষ্ট বিক্রিয়াকে রিডাকশন বিক্রিয়া বলে। এই বিক্রিয়া সংঘটন প্রক্রিয়া-
2H2O +O2 + 4e– – 4OH–
ইলেকট্রন আয়নের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে ফেরাস আয়নসমূহ কংক্রিটের ছিদ্রে অবস্থিত পানির মাধ্যমে স্টিলের যে পাশে ক্যাথোডিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়, সেই দিকে অগ্রসর হয়। যেখানে বিক্রিয়ার মাধ্যমে ফেরাস হাইড্রো-অক্সাইড বা মরিচার সৃষ্টি করে।
2Fe2+ + 4OH– -2Fe (OH)2
জলীয় বাষ্প বা বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট প্রাথমিক হাইড্রো-অক্সাইড অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে অধিক অক্সাইড উৎপন্ন করে। ধীরে ধীরে বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী উপাদানের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে অধিক পরিমাণে দ্রবীভূত অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়ায় অংশ নেয়। যার ফলে কংক্রিটের মধ্যে চাপ বা স্ট্রেসের সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে এই চাপের পরিমাণ বেড়ে এমন অবস্থায় পৌঁছায়, যা কংক্রিটের উপরিভাগে ফাটল বা Spalling সৃষ্টি করে।

কংক্রিটে স্টিলের ক্ষয় কংক্রিটের ক্ষমতা বা শক্তিকে অনেকাংশে অবনমিত করে। কংক্রিটে স্টিলের ক্ষয় তিনটি প্রধান ধাপে সংঘটিত হয়-
ক্ষয় হওয়ার প্রাথমিক সময়কাল।
ক্ষয় শুরুর সময় থেকে শুরু করে কংক্রিটের উপরিভাগে ফাটল (Crack) দৃশ্যমান হওয়ার সময়কাল।
কংক্রিটের উপরিভাগে ফাটল দৃশ্যমানের পর থেকে অধিকতর ক্ষয় সৃষ্টির সময়কাল, যা সাধারণভাবে স্থাপনার কাঠামোসমূহ দুর্বল করে এর স্থায়িত্বের ক্ষতি করে।
ক্ষয় যে কারণে
কংক্রিটে অবস্থিত স্টিলের ক্ষয় সৃষ্টি হওয়ার কারণ প্রধানত দুইটি। প্রথমত, ক্লোরাইড আয়নের বিক্রিয়ার ফলে কংক্রিটের স্টিলের ক্ষয় হয়। দ্বিতীয়ত, বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইডের সঙ্গে স্টিলের বিক্রিয়ায় ক্ষয় শুরু হয়। শক্তিশালী ও উন্নতমানের কংক্রিটে অবস্থিত স্টিলের ক্ষয়ের জন্য যা যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করে। কিন্তু নির্মাণকাজে ব্যবহৃত কংক্রিটে লবণের অধিক উপস্থিতি এবং আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে কলকারখানা থেকে দূষণের পরিমাণ বাড়ছে, যা থেকে পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে কংক্রিটের স্টিলে ক্ষয় সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। এ ধরনের পরিবেশ-বিপর্যয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নির্মাণকাজের স্থায়িত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কংক্রিটে স্টিল ক্ষয়ের ধরন
১. ক্রিভাইচ ক্ষয় (Crevice Corrosion)
ক্রিভাইচ ক্ষয় সাধারণত মাইক্রো-এনভায়রনমেন্টালে আবদ্ধ দ্রবণের ফলে সৃষ্টি হয়। এ ধরনের ক্ষয় মূলত স্থাপনার আবদ্ধ (Shielded) জায়গায় ঘটে। তরলে অবস্থিত অক্সিজেন মেটালের সঙ্গে বিক্রিয়ার ফলে এ ধরনের ক্ষয় পরিলক্ষিত হয়। তরল পদার্থের অক্সিজেন ক্রিভাইচ ক্ষয়ের মুখে থাকে, যা ব্যাপকভাবে বাতাসের সংস্পর্শে আসে ফলে স্থানীয় সেল (Cell) গঠন করে ক্ষয় অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। অক্সিজেনসমৃদ্ধ তরল যেসব উপরিতলের সংস্পর্শে আসে, তাতেই ক্ষয় সৃষ্টি হয়।

২. পিটিং (Pitting)
প্যাসিভিটি (Passivity)-এর তত্ত্বকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। যার একটা শোষণের ওপর এবং অন্যটি পাতলা অক্সাইডের উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে। অক্সাইড ফিল্ম তত্তে¡ ক্ষয়ের সম্মুখীন হওয়া পদার্থ ধীরে ধীরে প্যাসিভ ফিল্ম সৃষ্টি করে এবং ক্ষয় সৃষ্টির পথকে সুগম করে। প্রাথমিক ক্ষয় সৃষ্টি হওয়ার পরে এটা M+N+NH2O+ncl M(OH)+nHcl বিক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষয়ের মাত্রাকে ত্বরান্বিত করে।
স্টিল ক্ষয়ে বিশেষ প্রভাবক
কার্বণের বিক্রিয়ার ফলে ক্ষারতা হ্রাস
এ কথা সবার জানা, উজ্জ্বল স্টিল বারকে যদি অরক্ষিত অবস্থায় উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখা হয় তবে খুব দ্রুতই এর ওপরে লালচে মরিচা পড়ে। যদি তা প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে মরিচা পড়া ও ক্ষয় ক্রমাগত চলতে থাকে। মরিচা প্রতিরোধে স্টিলের বারগুলোকে এমন একটা পরিবেশে সংরক্ষণ করা উচিত, যেখানকার পরিবেশে ক্ষার বা PH-এর মান ৯.৫ থেকে ১২-এর মধ্যে থাকে। এ ধরনের উচ্চ PH-এর মান স্টিলের বারে এক ধরনের Passive ফিল্ম সৃষ্টি করে, যা স্টিলের ক্ষয়কে অত্যন্ত নিম্নমানে নিয়ে আসতে সক্ষম। যার ফলে স্টিলের ক্ষয়ের পরিমাণ আর ক্ষতিকারক বলে মনে হয় না। এভাবে কংক্রিটের আচ্ছাদন স্টিলে ফিজিক্যাল ও কেমিক্যাল সুরক্ষা প্রদান করে। এরপরেও ক্ষারতার মান নিম্নোক্ত উপায়ে কমতে পারে-
বায়ুমন্ডলে অবস্থিত অ্যাসিড গ্যাসের সঙ্গে বিক্রিয়ার (যেমন : কার্বন ডাই-অক্সাইড) দ্বারা।
কংক্রিটের উপরিভাগ থেকে পানি চুইয়ে ভেতরে প্রবেশের ফলে।
কংক্রিট ভেদ্য বা ভেদনযোগ্য সামগ্রী হওয়ায় পানি ও বায়ুমন্ডলীয় গ্যাস কংক্রিটে প্রবেশ করতে সক্ষম। অ্যাসিড গ্যাসসমূহ ক্ষারের সঙ্গে বিক্রিয়া করে কার্বনেট ও সালফেট প্রস্তুত করে। ক্ষারসমূহকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় এবং এর সঙ্গে PH-এর মানকে অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। যদি কার্বনেট কংক্রিটের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়, তাহলে কংক্রিটে অবস্থিত স্টিলের সুরক্ষার ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়। এতে অক্সিজেন ও ময়েশ্চার উভয় উপস্থিত থাকায় স্টিলের ক্ষয় শুরু হয়। এর বিক্রিয়াটি এ রকম-
Ca (OH)2+CO2-CaCo3+H2O
এর ফলে ক্ষারের পরিমাণ কমে এবং PH-এর মান ৮ থেকে ৯-এর মধ্যে নিয়ে যায়। ফলে স্টিলের সুরক্ষাব্যবস্থা নষ্ট হয়।

ক্লোরাইডে ক্ষারতা হ্রাস
ক্লোরাইড আয়নের উপস্থিতিতে ক্ষারীয় অবস্থা নষ্ট হয়। কংক্রিটে উচ্চমাত্রায় ক্ষার উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও ক্লোরাইড আয়নের উপস্থিতির ফলে এমন পরিবেশ নষ্ট হয়। ক্লোরাইড কংক্রিটের ক্যালসিয়াম অ্যালুমিনেট এবং অ্যালুমিনোফেরাইটের সঙ্গে বিক্রিয়া করে অদ্রবণীয় ক্যালসিয়াম ক্লোরোমিনেট তৈরি করে। যদিও এই বিক্রিয়া কখনো শেষ হয় না এবং কিছু ক্লোরাইড আয়ন কংক্রিটে থেকে যায়। এ ধরনের ক্লোরাইড দ্রবণযুক্ত অবস্থায় থাকে এবং অল্প মাত্রায় ক্ষয়ের সৃষ্টি করে। কিন্তু ক্লোরাইডের এই দ্রবণের পরিমাণ বেশি হলে স্টিলের ক্ষয়কে বেশি মাত্রায় ত্বরান্বিত করে।
মেকানিক্যাল লোডে সৃষ্ট ফাটল
কংক্রিটে সাধারণত টেনশন লোডের কারণে ফাটল সৃষ্ট হয়। এভাবে সৃষ্ট ফাটল, সংকোচন এবং অন্যান্য Factors বায়ুমন্ডলীয় গ্যাসসমূহকে কংক্রিটের মধ্যে প্রবেশে সাহায্য করে। যার ফলে কার্বনীয় স্তর বা অঞ্চলের সৃষ্টি করে। এই ফাটল যদি কংক্রিটের মধ্যে অবস্থিত স্টিল পর্যন্ত পৌঁছায়, তবে এর সুরক্ষাব্যবস্থা নষ্ট হয়।
বায়ুমন্ডলীয় দূষণে সৃষ্ট ক্ষয়
নির্মাণকাজে ব্যবহারের আগে স্টিলের পরিবহন এবং নির্মাণ সাইটে ব্যবহারের আগে সংরক্ষণের সময়ে দীর্ঘক্ষণ স্টিল বায়ুমন্ডলের সংস্পর্শে থাকে। এর মধ্যে যেকোনো সময়ে ক্লোরাইড আয়নের মাধ্যমে স্টিল বারসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে স্টিলের উপরিভাগ ক্ষয়ের সম্মুখীন হয়।
জলীয় বা আর্দ্রতা চলাচলের পথ
কংক্রিটের বাইরের উপরিতল (Surface) যদি দীর্ঘসময় ভেজা বা আর্দ্র অবস্থায় থাকে, তবে এই জাতীয় জলীয় অবস্থা খুব শিগগিরই কংক্রিটের স্টিলকে আক্রান্ত করে। এ ধরনের জলীয় পরিবেশ খুব সহজেই কংক্রিটে সৃষ্ট ফাটল বা ছিদ্র দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। কংক্রিটের আস্তরণ স্টিলের বারকে বাইরের পরিবেশ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু এই সুরক্ষাব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা ক্ষয়ের সম্মুখীন হয়।

পানি ও সিমেন্টের অনুপাত
অধিক পানি ও সিমেন্টের অনুপাতবিশিষ্ট কংক্রিটের স্থাপনায় অধিক ছিদ্রযুক্ত প্লাস্টিক কংক্রিটের সৃষ্টি হয়। এ ধরনের ছিদ্র কংক্রিটের মধ্যে পানি প্রবেশের হারকে বাড়িয়ে কংক্রিটে ফাটল সৃষ্টির আশঙ্কাকে বাড়ায়। ফলে কংক্রিটের স্টিল বার বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শে চলে আসে এবং ক্ষয়ের ফলে এর কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়।
কংক্রিটের কম টান শক্তি
কম টেনসাইল স্ট্রেন্থসমৃদ্ধ কংক্রিটের ক্ষয় দুভাবে হয়। প্রথমত, এ ধরনের কংক্রিটে টান বা সংকোচনের ফলে খুব সহজেই ফাটল সৃষ্টি হয়, যা খুব সহজেই আর্দ্রতা, অক্সিজেন ও ক্লোরাইড আয়নকে কংক্রিটের মধ্যে অবস্থিত স্টিল স্তরে নিয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের কংক্রিটের স্টিলে ক্ষয় শুরু হলে ফাটলের স্থানে ক্ষয়ের হার বৃদ্ধি পায়।
ভিন্নধর্মী ধাতুতে ইলেকট্রিক্যাল সংস্পর্শ
যখন দুটি ভিন্ন ধাতু একে অপরের সংস্পর্শে আসে তখন অধিক ক্রিয়াশীল মেটাল কম ক্রিয়াশীল মেটালে ক্ষয়ের সৃষ্টি করে। এ ধরনের ক্ষয় অনেক সময় কংক্রিটে ফাটলের কারণ ঘটায়। তা ছাড়া অধিক কিউরিং বা পানি প্রয়োগের ফলে সংকোচনের দ্বারা কংক্রিটে ফাটলের সৃষ্টি হয়।

পরিবেশগত ভিন্নতায় সৃষ্ট ক্ষয়
যখন বিভিন্ন মেটাল ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে পরস্পরের সংস্পর্শে আসে, তখন ভেজা বা সিক্ত (Damp) কংক্রিটের সৃষ্টি করে। যেমন-
- যদি স্টিল বার অ্যালুমিনিয়াম পরিবাহীর সংস্পর্শে থাকে।
- যদি কংক্রিটের বাইরের উপরিতল এবং স্টিল বারের সংস্পর্শে থাকা কংক্রিটের মধ্যে জলীয় বা আর্দ্র অবস্থার খুব বেশি তারতম্য হয়।
- যদি কংক্রিটের বিভিন্ন স্থানে প্রযুক্ত স্ট্রেসের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হয়।
সুরক্ষায় করণীয়
কংক্রিট সব সময় শুষ্ক রাখা প্রয়োজন। যাতে করে পানির উপস্থিতিতে কোনো ধরনের মরিচা না পড়ে। কেননা, কংক্রিট সর্বদা শুষ্ক থাকায় মরিচা সৃষ্টির জন্য কোনো ধরনের অক্সিজেনের উপস্থিতি না থাকে।
স্টিল বারের চারপাশে পলিমেট্রিকের আস্তরণ সৃষ্টি করে একে জলীয় বা আর্দ্র এবং Aggressive Agents থেকে সুরক্ষিত রাখা যায়।
প্রথাগত কালো রঙের স্টিল বারের পরিবর্তে মরিচারোধী স্টিল বার ব্যবহার করে ক্ষয় রোধ করা সম্ভব।
ফ্লাই অ্যাশবিহীন (Fly Ash) উচ্চপ্রযুক্তির সিমেন্ট অথবা নির্দিষ্ট মাত্রায় ফ্লাই অ্যাশ মিশ্রিত সিমেন্ট দ্বারা নির্মিত কংক্রিটের ভেদনযোগ্যতা অনেক কম থাকে। যার ফলে পানি ও লবণকে স্টিলের সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত রাখা যায়।

ক্লোরাইড আয়নের একটা নির্দিষ্ট অংশ ব্যাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কংক্রিটের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই ক্লোরাইড আয়ন ট্রাইক্যালসিয়াম অ্যালুমিনেটের সঙ্গে মিশে বা বিক্রিয়া করে ক্যালসিয়াম ক্লোরো-অ্যালুমিনেট (ফ্রাইডেল লবণ) প্রস্তুত করে। যার দ্বারা ক্লোরাইড আয়নের পরিমাণকে কমিয়ে ক্ষয়ের পরিমাণ অনেকাংশে হ্রাস করে।
কার্বনেট কংক্রিটে ইলেকট্রো-কেমিক্যাল ক্ষয়-নিরোধক প্রয়োগ করে ক্ষয় (Corrosion) অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।
স্টিল বারের উপরিতল যত বেশি অমসৃণ; কংক্রিটের সঙ্গে সেই স্টিল বারের বন্ধন তত বেশি মজবুত হয়। স্টিলের অক্সিডেশনের মাধ্যমে স্টিল এবং সিমেন্ট সেস্টের বন্ধনকে অনেক বেশি দৃঢ় করে। যার মান মসৃণ স্টিলের সঙ্গে সৃষ্ট বন্ধনের চেয়ে বেশি।
কংক্রিটে সিমেন্টের পরিমাণ যত বৃদ্ধি পায়। তত বেশি পরিমাণে ক্লোরাইড বিক্রিয়ায় কঠিন স্তর সৃষ্টি হয়। তাই দ্রবণের পরিমাণ কমিয়ে ফিজিক্যাল উপাদানসমূহের উন্নতি সাধন করে ক্ষয়রোধ অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
ইলেকট্রো-কেমিক্যাল ক্লোরাইড মুক্তকরণ (Electro-Chemical Chloride Extraction) নতুন এক ধরনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যা দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী থাকে। ফলে ক্লোরাইড আয়নের প্রভাবে স্টিলের ক্ষয়ের আশঙ্কা কমে। যদিও এই পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ ক্লোরাইডমুক্ত হয় না। কিন্তু কংক্রিট ও স্টিলের পৃষ্ঠদেশ থেকে ক্লোরাইডের পরিমাণ নির্দিষ্ট মাত্রায় কমে।
বিভিন্ন ধরনের প্রলেপ-নিরোধক কংক্রিটের ওপর প্রয়োগ করে ক্লোরাইড আক্রমণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
পাতলা জিঙ্কের প্রলেপ গরম করে বা বৈদ্যুতিক পৃথক্করণের মাধ্যমে প্রয়োগ করে জিঙ্কের প্রভাবে সৃষ্ট স্বল্প মাত্রার ক্ষয়কে রোধ সম্ভব। তা ছাড়া এটা গ্যালভোনিক প্রতিরক্ষার মাধ্যমে পানি ও লবণের প্রবেশকে প্রতিহত করে।
কংক্রিটের মিক্স ডিজাইন এমন হওয়া উচিত, যাতে করে পানি ও সিমেন্টের অনুপাত কম হয়। কংক্রিটের ভেদনযোগ্যতা কমিয়ে দেয় এমন উপাদান ব্যবহার করা উচিত। যেমন- ফ্লাই অ্যাশ, সিলিকা ফিউম, সর্বোপরি ক্ষয় রোধকারী উপাদান ব্যবহার করে স্টিলের ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
যেকোনো ধরনের স্থাপনা নকশা করার সময় এমনভাবে নকশা করতে হবে, যাতে করে এর কাঠামো সবচেয়ে কম ক্ষয়ের সম্মুখীন হয়।

ক্ষয়ের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে প্রতিকারব্যবস্থা স্বরূপ ক্ষতিগ্রস্ত কংক্রিট এবং স্টিল বারসমূহকে পরিষ্কার করে ক্ষয় রোধকারী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কংক্রিটস্থ স্টিলে প্রধানত ক্লোরাইড আয়ন এবং বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড উপস্থিতির কারণে ক্ষয়ের সৃষ্টি হয়। সাধারণত ভেজা ও শীতল বা ঠান্ডা আবহাওয়ায় কংক্রিটের স্টিলসমূহ বিভিন্ন ধরনের ক্লোরাইড আয়ন ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের সংস্পর্শে আসে। এবং বিভিন্ন ধরনের স্থাপনার কাঠামোতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তাই যেকোনো ধরনের স্থাপনায় স্টিলের ক্ষয় রোধকারী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। সঠিক নকশা এবং নির্মাণকাজে ব্যবহৃত কংক্রিটের মিক্স ডিজাইন স্টিলের ক্ষয়ের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। এ ছাড়া পাতলা গ্যালভানাইজড স্টিল ব্যবহার করলে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়।
প্রকৌশলী সনজিত সাহা
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৫ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৪