দেশের সার্বিক পরিবেশরক্ষায় নদীর ভূমিকা অগ্রগণ্য
সিলেটে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে অনেক ছোট-বড় ছড়া। এই ছোট ছড়াগুলোই নদী। প্রাকৃতিকভাবে সেখানে পাহাড় গড়িয়ে পানি আসছে। বয়ে চলছে ঝিরঝির ধারায়। দেশের নদনদীগুলো মাছ উৎপাদনে রাখছে বড় ভূমিকা। বড় নদীর তালিকায় রয়েছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র। বর্ষাকালে অনেক নদীর পানি উপচে মিশে যায় প্লাবনভূমিতে। এ সময় বহমান এ নদীগুলো প্লাবনভূমিতে ফেলে আসে কিছু পানি আবার কিছু পানি বয়ে আনে। আর এসব পানিতে থাকা পলিতে ভরাট হচ্ছে নদীগুলো। নদী ভরাট ও খনন সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম আবদুল মতিন কথা বলেছেন বন্ধন-এর সঙ্গে। আলাপচারিতার সূত্রধর শামস আহমেদ

বাংলাদেশের নদীগুলো ক্রমেই ভরাট হওয়ার প্রধান কারণ কী?
দেশের শত শত নদী আজ অস্তিত্বের সংকটে। এর কারণ আর কিছুই না, দূষণ আর অবৈধ দখল। নদীগুলো ক্রমেই ভরাট হওয়ার কয়েকটি কারণের মধ্যে নদীতে মাত্রাতিরিক্ত বালুপ্রবাহ অন্যতম। অতিমাত্রায় নদীর পানি উত্তোলনে মাটির নিচের পানি ধারণক্ষমতা কমছে।
জানতে চাই নদীর পলি, কাদা বয়ে আনা সম্পর্কে?
নদীর তলদেশে দিয়ে যা প্রবাহিত হয় তা বাংলায় পলি, ইংরেজিতে সেডিমেন্ট। সেডিমেন্ট নুড়ি পাথর থেকে শুরু করে মোটা বালু পর্যন্ত হতে পারে। চিকন বালু, মিহি বালু ও অতি মিহি বালুও এর অন্তর্ভুক্ত। নদী যে পানি বহন করে তাতে থাকা পলি নদীর উপরিভাগে দেখা যায়। কাজেই নদীর তলদেশে যা প্রবাহিত হয়, তাকে পানি বলা যায় না। এর মধ্যে আছে বালু। অনেকে বলেন, নদীবাহিত পলি জমির উর্বরতা বাড়ায়। এ কথা ঠিক নয়। জমিতে বালুমিশ্রিত পলি পড়লে নষ্ট হয় আবাদি জমি।
নদীর পানি ব্যবহার সম্পর্কে কিছু বলুন?
আমাদের দেশে নদীর পানি ব্যবহৃত হচ্ছে নানাভাবে। নদীর পানি ব্যবহারের রয়েছে দুটি ভাগ। এক. পানি ব্যবহারে পানির পরিমাণের তারতম্য হয়; দুই. পানি ব্যবহারে পানির পরিমাণের তারতম্য হয় না। নদীতে মাছ উৎপন্ন হলে কিংবা নদীতে নৌযান চললে নদীর পানির পরিমাণে তারতম্য হয় না। অন্যদিকে ফসল উৎপাদন কিংবা অন্য যেকোনো কাজে নদীর পানি উত্তোলন করলে নদীর পানির পরিমাণে তারতম্য ঘটে। নদীর পানি উত্তোলনের জন্য নদী তার নাব্যতা হারায়। ঢাকা শহরের পানির চাহিদার ৮৫ শতাংশ মেটানো হয় নদীর পানি থেকে। নদীর পানি উত্তোলন করলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ।
বাংলাদেশের নদীগুলো অনেকাংশে হারিয়ে যাচ্ছে কিংবা মরে যাচ্ছে, এ সম্পর্কে কিছু বলবেন?
বাংলাদেশের নদীগুলোর অবস্থা এককথায় সঙ্গিন। ১৯৬৪ সালে পানি ব্যবস্থাপনার জন্য নেওয়া হয়েছিল আধুনিক মহাপরিকল্পনা। তখন বিশ্লেষকদের গুরুত্ব ছিল বন্যা ব্যবস্থাপনায়। ১৯৬৪ সালে আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল আমন। খাদ্যের শতকরা ৮০ ভাগ আসত আমন থেকে। বর্ষাকালের বন্যায় এ আমন নষ্ট হতো। যে বছর বন্যা হতো সে বছর দেখা দিত দুর্ভিক্ষ। এ কারণে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দরকার ছিল অনেক টাকার। তৎকালীন সরকার এত বড় অংকের বাজেট প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী ছিল না। এখন আমাদের নদীগুলো ঘিরে যে পরিকল্পনা হচ্ছে তা ওই মহাপরিকল্পনারই অংশ। ১৯৭২ সালে সরকার আরও একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। বাংলাদেশের বন্যার ওপর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় শীতকালীন ফসল উৎপাদনে বিশ্বব্যাংক প্রচলন করে লোলিফট পাম্পের।
লোলিফট পাম্প কী?
লোলিফট পাম্পে নদী থেকে পানি তুলে ব্যবহার করা হতো কৃষিজমিতে। এ পদ্ধতিতে নদী থেকে পানি তুললে নদীর পানি কমে গিয়ে নদী শুকিয়ে যায়। কিন্তু নদী শুকিয়ে যাওয়া নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আমাদের মাথাব্যথা শুধু খাদ্য নিয়ে। কেবলমাত্র খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে ধ্বংস করছি মাছ ও নদীর জীববৈচিত্র্য। পানিকে এভাবে ব্যবহার না করে একটি সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে ব্যবহারের চিন্তা করা উচিত। আমাদের পানিকে পর্যাপ্তভাবে ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। নইলে সৃষ্টি হবে সমস্যার। অপচনশীল দ্রব্য পরিবহনে সাশ্রয়ী মাধ্যম নৌপথ। এখানে খরচ কম। সম্ভাবনার এই দিকটি বরাবরই উপেক্ষিত। সমুদ্রের পানি উপকূলে ধেয়ে আসায় লবণাক্ততা বাড়ছে। এ জন্য প্রয়োজন পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা।

সেচের জন্য নদীর পানি ব্যবহার কতটা যুক্তিযুক্ত?
বর্তমানে সেচে ব্যবহৃত পানির শতকরা ৭০ ভাগ আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে, ২৫ শতাংশ আসে ছোট নদী থেকে, আর ৫ শতাংশ পানি আসে বড় নদী থেকে। শুষ্ক মৌসুমে তথা নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত সাত মাসে যে পরিমাণ পানি নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়, তার ৬৭-৬৯ শতাংশ প্রবাহিত হয় ব্রহ্মপুত্র দিয়ে আর ১৫-১৬ শতাংশ গঙ্গা দিয়ে, ৫ শতাংশ মেঘনা দিয়ে। তার মানে ৯০ শতাংশ পানিই প্রবাহিত হয় বড় নদী দিয়ে। এই ৯০ শতাংশের ১ শতাংশ পানিও আমরা ব্যবহার করতে পারি না। বাকি যে ১০ শতাংশ পানি দেশে ছোট ও মাঝারি সাইজের নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেগুলোকে আমরা তুলে নিচ্ছি পাম্প দিয়ে। বড় নদীগুলোর পানি ব্যবহারে উপযুক্ত কাঠামো প্রয়োজন আর ছোট ছোট নদীর পানি উত্তোলনে জরুরি হয়ে পড়েছে একে নিয়মে আওতায় আনা।
ঢাকার নদীগুলোর ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলবেন?
বুড়িগঙ্গার প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে ঢাকার আশপাশের নদীগুলো থেকে বুড়িগঙ্গায় পানি আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এতে যমুনা নদীর মিঠা পানি আনা হবে। যা কমাবে বুড়িগঙ্গার দূষণ।
নদীগুলোকে কীভাবে খনন করলে এর নাব্যতা আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
নদী দুই ধরনের। একটি বড় নদী আরেকটি ছোট নদী। বড় নদীর শাখানদীগুলোকেই বলা হয় ছোট নদী। আর এই শাখানদীগুলো ভালোভাবে খনন করলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নদীর নাব্যতা। আমাদের এখানে বড় নদীগুলো আগে খনন করা হয়। আর ছোট নদীগুলোর দিকে তেমন একটা নজর দেওয়া হয় না। ফলে বড় নদীগুলো যেভাবে নাব্যতা হারাচ্ছে। নদী খনন করা একটি কারিগরি বিষয়। নদী খনন করা হয় একটা নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে থেকে।
টিপাই মুখের বাঁধ সম্পর্কে কিছু বলবেন?
- টিপাই মুখ বাঁধ যে নদীতে দেওয়া হবে তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। উজানের দেশ ভাটির দেশের সঙ্গে আলোচনা ব্যতীত আন্তর্জাতিক নদী থেকে পানি প্রত্যাহার বা বাঁধ স্থাপন করতে পারে না। কেননা টিপাই মুখে বাঁধ পরিকল্পনা নিশ্চিতরূপে আন্তর্জাতিক নদী আইনের পরিপন্থী। কেননা আন্তর্জাতিক নদীসমূহের কিছু দায়িত্ব রয়েছে।
- সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের অনুমতি ব্যতীত কোনো একক সিদ্ধান্ত হলে কোন নদীর গতিধারা পরিবর্তন করা যাবে না।
- কোনো আন্তর্জাতিক নদীর গতিধারার পরিবর্তন কোনো রাষ্ট্র একতরফাভাবে পরিবর্তন করতে পারবে না। তদুপরি এতে অপরপক্ষ ক্ষতিগ্রস্থ হলে এর জন্য ক্ষতিগ্রস্থ রাষ্ট্র ক্ষতিকারক রাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণ পাবে।
- আন্তর্জাতিক নদীর ক্ষেত্রে সব আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও যুক্তি প্রাধান্য পাবে। খননকাজ চলাকালীন স্রোতের ফলে সব আলগা মাটি ধুয়ে যায়। আর নদী নিজ থেকেই তার ড্রেজিংয়ের কাজ সম্পন্ন করে।
আমাদের দেশের নদীগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। এর কারণ কী?
শুষ্ক মৌসুমে ফসলের জন্য আমাদের নদীগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয়। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমে পানির সঙ্গে ভেসে আসা পলির কারণে নদী তার নাব্যতা হারায়। যার ফলে নদী পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি থাকে না। আমাদের এখানে এক বছর নদী খনন করলে অন্য বছর তা করে না। আর এর ফলে নদীগুলো পলিতে ভরাট হয়ে যায়। এভাবে নদীগুলো হারায় তার নাব্যতা। নদীগুলোকে আমরা দুইভাবে খনন করতে পারি ১. ক্যাপিটাল ড্রেজিং ২. ম্যানট্রেনিং ড্রেজিং।

নদীর স্রোত দেখে এ ধরনের খননকাজ করা হয়। এর জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট সময়। সময় ব্যতীত খননকাজ করলেও তেমন ফল পাওয়া যায় না। খনন কাজের উপযুক্ত সময় পানি মৌসুমে, এ সময় স্রোত থাকে আর স্রোতের সময় খননকাজ করলে যথাযথ ফল পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, যে সময় চাষের মৌসুম, ঠিক সেই সময়ই আমাদের নদীগুলোর পানি শুকিয়ে যায়। কারণ, অধিক পানি উত্তোলন। আমাদের দেশে পাম্পের মাধ্যমে মাটির নিচ থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি উত্তোলন করা হয়, যার প্রভাব নদীর ওপর পড়ে। আর এর ফলে নদীগুলো শুকিয়ে যায়। আবার শেষ মৌসুমে নদী থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি উত্তোলনের ফলে নদীর ধারাবাহিক অবস্থার পরিবর্তন হয়।
সবার ধারণা, বুড়িগঙ্গার তলদেশে বর্জ্য আর পলিথিনে ভরাট হয়ে গেছে। এ বিষয়ে কিছু বলুন?
সদরঘাট, কেরানীগঞ্জ, লালবাগ, সোয়ারিঘাট, কামরাঙ্গীরচর, শহীদনগর, আমলীপাড়া এসব এলাকার পানি এখন তরল ছাই। হাজারীবাগের বর্জ্য ১২ শতাংশ, ঢাকাবাসীর বর্জ্য ৭৮ শতাংশ এবং দুই তীরের শিল্পকলকারখানার বর্জ্য, কাঁচাবাজারের প্রতিদিনের আবর্জনা স্টিমার, লঞ্চ ও অন্যান্য নৌযান থেকে নিঃসৃত বর্জ্যে নদীর পানির এই দশা। বুড়িগঙ্গার দুই পাশের অসংখ্য পাইপ দিয়ে সুয়ারেজের ময়লা সরাসরি নদীতে পড়ে, যার ফলে নদীর তলদেশ এসব বর্জ্যে ভরাট হচ্ছে প্রতিদিন। পানির স্তর প্রায় দুই ফুট পর্যন্ত হচ্ছে বিষাক্ত। বিষাক্ত পানির আরও ২০ ফুট নিচে পলিথিন ও আবর্জনার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে মাটির স্তর। একসময় বুড়িগঙ্গার নদীর পানি ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ, সে সময় নদীর পাশের মানুষ রান্নাবান্নাসহ এ নদীর পানি পান করতে ব্যবহার করতো। কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলার ফলে বুড়িগঙ্গার পানি দুর্গন্ধময় হয়ে পীত বর্ণ ধারণ করেছে। যেকোনো দেশের সার্বিক পরিবেশরক্ষায় নদীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। নদী এভাবে দিনে দিনে দূষণ আর নাব্যতা হারাতে থাকলে আমাদের ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়তে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরব থাকা মোটেও উচিত নয়। বহুতল ভবন নির্মাণে যেখানে সেখানে ডিপটিউবওয়েল বসিয়ে মিটারের সাহায্যে ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন, নদী-নালা, খাল-বিল ভরাটসহ এ ধরনের সব কর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে। নইলে মারাত্নক পরিবেশ বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করা যাবে না।
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নদীতে পানি ধরে রাখতে বাঁধ ও ব্যারেজ দেওয়া হচ্ছে। এর ফল কী?
এর ফলে নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাবে, নদীগুলোর অবস্থা হবে আরও শোচনীয়। নদী তার নিজের নাব্যতা হারাবে। যার প্রেক্ষিতে নদীতে পলি জমতে জমতে একসময় নদী পানিশূন্য হয়ে যাবে। এককথায় নদীর নাব্যতার ওপর ভীষণ প্রভাব পড়বে।
আমাদের দেশের যেসব শাখানদী মরে যাচ্ছে, সেগুলো বাঁচানোর উপায় কী?
আমাদের দেশের যেসব শাখানদী মরে যাচ্ছে, সেগুলো বাঁচানোর উপায় হলো আন্তর্জাতিক নদীগুলোকে শাসনব্যবস্থার আওতায় আনা। নদীশাসন বলতে নদীগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে নিয়ে আসা। ব্রহ্মপুত্র নদী বাহাদুরাবাদের কাছে এখন থেকে ১০০ বছর আগে প্রশস্ত ছিল পাঁচ কিলোমিটারের মতো। সিরাজগঞ্জের কাছেও তাই। এখন সেখানে প্রশস্ততা প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার। নদীর প্রবাহের জন্য যতটুকু প্রশস্ততা প্রয়োজন, তার থেকে একটু বেশি জায়গা রেখে একটি সুনির্দিষ্ট পথ করে দিতে হবে, যে পথ দিয়ে বয়ে যাবে নদী। নদীর ভাঙন ঠেকাতে হবে। আমরা যদি সঠিকভাবে নদীশাসন করে তাকে একটি পথ দেখাতে পারি, তাহলে নদী তার গভীরতা নিজে নিজেই করে নেবে। কিন্তু প্রচলিত এ পদ্ধতিটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
নদীর নাব্যতা ফেরাতে ড্রেজিং বহুল প্রচলিত একটি পদ্ধতি। এতে দীর্ঘস্থায়ী কোনো সুফল পাওয়া যায় কি?
শুধু ড্রেজিং করে নদী বাঁচানো যাবে না, ড্রেজিং করে কোটি কোটি টাকা খরচ করে নদী ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি নদীশাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। নদী ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে প্রশিক্ষণব্যবস্থা।
নদীপথে পানির প্রবাহের গতিপথ ধরে রাখতে প্রতিবছর বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজিং করলেও নদীগুলোর নাব্যতা ফেরানো যায় না কেন?
মূলত নদীর ড্রেজিং মেটেরিয়াল সঠিক স্থানে বসানো হয় না। সঠিক স্থানে পাইলিং না করালে ড্রেজিং কাজে সফলতা পাওয়া সহজ নয়। ড্রেজিং করা বালু ও পলি ফেলার জন্য প্রথম কাজটি হলো জায়গা নির্বাচন করা। যাতে করে ড্রেজিং করা বালু কিংবা পলি পুনরায় নদীতে ফিরে না আসে। কিন্তু আমাদের দেশের সঠিক অভিজ্ঞতা না থাকায় ড্রেজিং করা পলি ও বালু নদীতে কিংবা নদীর পাশেই ফেলা হয়। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, পলি ও বালু আবার নদীতে ফিরে আসে। মূলত এ জন্যই সব কাজই হয় ব্যর্থ।

সাধারণত দেখা যায় ড্রেজিংকৃত বালু ও পলি নদীতেই ফেলা হচ্ছে। এতে কিছুদিন পরে আবারও নদী ভরাট হয়ে যায়, এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?
নদী থেকে দূরে এমন জায়গায় এগুলো ফেলা হয় যা আবার পুনরায় নদীর পানিতে ফিরে আসে। সঠিক স্থান নির্ণয় সাপেক্ষে পলি ফেলতে হবে, যাতে করে নদীতে পলি পুনরায় ফিরে আসতে না পারে অর্থাৎ যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে নদীর পলি ফেলতে হবে।
ড্রেজিং-পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া কী?
ড্রেজিং-পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের প্রক্রিয়াটি বেশ ব্যয়বহুল। তবে নৌরুট অর্থাৎ নৌযান চলাচলের রাস্তাগুলো নিয়মিতভাবে ম্যানট্রেনিং ড্রেজিং করতে হবে। ম্যানট্রেনিং ড্রেজিং বলতে ধারাবাহিক ড্রেজিংকে বোঝায়। নিয়মিত এই ড্রেজিংগুলো করতে হবে তাহলে নৌপথগুলো সচল রাখা সম্ভব। এ ধরনের ড্রেজিং করলে নদীর তেমন কোনো ক্ষতি হয় না।
নদীগুলোতে নাব্যতা ফেরাতে যে ধরনের ড্রেজিং মেশিন প্রয়োজন, তা এ দেশে আছে কি?
প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। সবাই যদি একসঙ্গে একটি কাজ করে তবে কাজটি সবার পক্ষেই সহজ হবে। শুধু সরকার একা পারবে না, প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার।
নদীর নাব্যতা ফেরাতে ড্রেজিং ছাড়াও আর কী কী আধুনিক পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
নদীর নাব্যতা ফেরাতে শুধু পানি প্রবাহের প্রয়োজন। প্রবাহ যদি না থাকে তবে বিদ্যুতেই নাব্যতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। নদীর পানির প্রবাহ যদি ঠিক রাখা যায়, তবে নদীর নাব্যতা ধরে রাখা সম্ভব। আমাদের সবার আগে যে কাজটি করার প্রয়োজন, সেটি হলো নদীর পানির প্রবাহ ঠিক করতে হবে, তবেই নাব্যতা ধরে রাখা যাবে।
নদীর নাব্যতা ফেরাতে বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিকৌশল বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি?
হ্যাঁ, অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) নদীশাসন ও নদীশাসনসংক্রান্ত পোস্ট কারিকুলামের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া শিক্ষা এবং গবেষণাকাজ করে আসছে। এখান থেকে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রজেক্টসংক্রান্ত উপদেশ ও পরামর্শ দেওয়া হয়।
এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ নদীসংক্রান্ত অনেক কার্যক্রম শুরু করেছে। অবশ্য সরকারের পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের জন্য কাজের গুরুত্ব অনুসারে কাজে অগ্রসর হতে হবে। আর একটি কাজ সরকার করতে পারে সেটি হলো, বিদেশ থেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্রকৌশলী না এনে দেশীয় গবেষক ও প্রকৌশলীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এ ধরনের কাজ বাস্তবায়ন করা। এখানে সরকারকে বুঝতে হবে, আমাদের দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি আমাদের থেকে আর কেউ ভালো বুঝবে না। আর তাই শুধুমাত্র দেশীয় মেধাকেই কাজে লাগিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব শতভাগ।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৮ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৪