ক্লক টাওয়ার বললেই এক নামে সবাই বুঝে ফেলে সহজেই। ক্লক টাওয়ার জিনিসটা কী তা আর কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। উঁচু যে ভবন বা টাওয়ারের শীর্ষে বড় আকৃতির ঘড়ি লাগানো থাকে, স্থানীয়দের সময় জানাতে তাকেই বলে ক্লক টাওয়ার। এই তো সাধারণ ব্যাপার। তাই না? কিন্তু এখন যদি বলি, পৃথিবীর প্রথম যে ক্লক টাওয়ার ছিল তা থেকে সময় ঠিকই জানা যেত, কিন্তু সেই ক্লক টাওয়ারে ছিল না কোনো ক্লক! তাহলে একটু আশ্চর্য লাগবে! তাই তো? আচ্ছা আজ তবে ঘড়ি বা ক্লকবিহীন ক্লক টাওয়ারের গল্প শোনাব। আর সেই সঙ্গে শোনাব বিশ্বের আরও কিছু সেরা, সুউচ্চ, দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় ক্লক টাওয়ারের গপ্পো। তবে আর দেরি কেন? আসুন, এবার তাহলে প্রবেশ করি ঘড়ির রাজ্যে। ঘড়ির রাজ্য বললে ভুল বলা হবে, আসলে প্রবেশ করাতে চাইছি ক্লক টাওয়ারের ভুবনে।
মক্কা ক্লক টাওয়ার, সৌদি আরব
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ক্লক টাওয়ার হলো সৌদি আরবের আবরাজ আল বাইত ক্লক টাওয়ার, যা কিনা মক্কা রয়াল ক্লক টাওয়ার বা মক্কা ক্লক নামেও পরিচিত। ২০০৪ সালে এটির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ২০১০ সালের ১১ আগস্ট পবিত্র রমজান মাসের প্রথম দিনে মক্কা ঘড়ি তিন মাসের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়। ২০১১ সালে এটি পূর্ণাঙ্গভাবে উন্মুক্ত করা হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদ সৌদি আরবের মসজিদ আল হারাম থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৫০ মিটার বা ১৫০ ফুট। মক্কা ক্লক একটি চতুর্মুখী ঘড়ি, যা প্রায় ৪০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। শহরের চারপাশ থেকেই দেখা যায় এটি। রাতে ১৭ কিলোমিটার এবং দিনে ১২ কিলোমিটার দূর থেকে সময় দেখায় এটি। এতে ব্যবহার করা হয়েছে প্রায় ১০ কোটি রঙিন কাচের টুকরো। সেই সঙ্গে রয়েছে ২০ লাখ এলইডি বাতি। ঘড়ির ওপরের অংশে রয়েছে আরও ২১ হাজার সাদা ও সবুজ বাতি।

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত আলো জ্বালিয়ে সংকেত দেওয়া হয় এই ক্লক টাওয়ার থেকে। ঘড়ির চারপাশে আরবি ক্যালিওগ্রাফিতে বড় হরফে লেখা রয়েছে আল্লাহু আকবার। আল্লাহর নামের ওপর ৫৯০ মিটার ১৮০০ ফুট উঁচুতে রয়েছে সোনা দিয়ে মোড়ানো বিশালাকৃতির বাঁকানো চাঁদ, যা কিনা ৭৫ ফুট ডায়ামিটার বিশিষ্ট।
বিশেষ বিশেষ দিবসে আকাশের দিকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত আলো প্রক্ষেপণ করা যায় ১৬ ধরনের বাতির মাধ্যমে। ক্লকটির ডায়ালের ব্যাস ৪৩ মিটার বা ১৩০ ফুট।
মক্কা ক্লক আরব সময়সূচি অনুযায়ী চলে। যা কি না গ্রিনিচ সময় থেকে ৩ ঘণ্টা এগিয়ে ও বাংলাদেশ সময় থেকে ৩ ঘণ্টা পিছিয়ে। অর্থাৎ বাংলাদেশে যখন সকাল ৭টা, মক্কা ক্লকে তখন সকাল ১০টা।
মক্কা ক্লকের নকশা করেছেন সুইস ও জার্মান প্রকৌশলীরা। ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের ২০০৯-১০ সালের বাজেটের চেয়েও বেশি। ভবনটি পৃথিবীর তৃতীয় সুউচ্চ ভবন। এখানে রয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির টেলিস্কোপ সেন্টার, জাদুঘর এবং ৭ তারকা বিশিষ্ট হোটেল। তবে এর স্থাপনা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তৈরি অটোম্যানদের বিখ্যাত আজিয়াদ দুর্গ ভেঙে নির্মাণ করা হয় এই টাওয়ার।
সিবাহির শপিংমল ক্লক টাওয়ার, তুরস্ক
এ ঘড়িটি বর্তমান বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্লক টাওয়ারের ঘড়ি। তুরস্কের ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত শপিংমল সিবাহিরে এই দেয়াল ঘড়িটি শোভা পাচ্ছে। ২০০৫ সালে নির্মিত এই ঘড়ি। ঘড়ির ডায়ালের ব্যাস ৩৬ মিটার এবং ঘড়িটি শপিংমলের ছাদে স্বচ্ছ ব্যাকগ্রাউন্ডে স্থাপিত। বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘড়ি হিসেবে পরিচিত তুরস্কের সিবাহির মলের ঘড়ির ব্যাস ৩৬ মিটার বা ১২০ ফুট।

প্রাগ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ক্লক, চেক প্রজাতন্ত্র
এই ক্লক টাওয়ার অবস্থিত চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগ শহরের জনবহুল ওল্ড টাউন স্কয়ারে। এই শহরের মূল আকর্ষণই হচ্ছে এই ঘড়ি। প্রাচীন বোহেমেনিয়ান সময় অনুযায়ী এ ঘড়ির সময় চলে, অর্থাৎ সময়ের শুরুটা হয় মূলত সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়কে ১২ ঘণ্টা ধরে সময় পরিমাপ করা হয়। প্রায় ৬০০ বছর আগের এই ঘড়িটি পৃথিবীর অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়িগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো ঘড়িগুলোর অন্যতম।
ঘড়িটির নির্মাণকাজ কয়েক ধাপে সম্পন্ন হয়। মধ্যযুগে ১৪১০ সালে ঘড়িটির প্রথম নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। ১৮৬৫ সালে ঘড়ির নির্মাণকাজ শেষ হয়। এখনো পর্যন্ত তৈরি করা এটিই বিশ্বের প্রাচীনতম অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি। এই ঘড়ি দিয়ে জ্যোতির্বিদ্যার সময় জানা যায়। অর্থাৎ জ্যোতিষীরা সূর্য, চাঁদ ও নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কিত ধারণা নিতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই যুদ্ধ সমাপ্তির পরেই এর প্রধান প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো পুনর্নির্মাণ করা হয়। এই ঘড়ির প্রধান বিশেষত্ব হলো সময়ের শুরুটা হয় মূলত সূর্যাস্তের পরে এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়কে ১২ ঘণ্টা ধরে সময় পরিমাপ করা হয়। তা ছাড়া ঘড়ির নিচে একটি ক্যালেন্ডারও যুক্ত রয়েছে। এই বিখ্যাত ও সুরম্য ক্লক টাওয়ারটি জ্যোতির্বিদ্যার অনুপম নিদর্শন। এই ক্লক টাওয়ারটি দেখতে ভিড় লেগে থাকে সব সময়। এই চমৎকার ঘড়িটি দেখতে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক এখানে ভিড় জমান। প্রাগের এই ক্লক টাওয়ারটি দেখতে চাইলে আপনিও নিচের লিংকে ঢুকে একটা ডিজিটাল ট্যুর দিতে পারেন একেবারে বিনামূল্যে
বিগ বেন, লন্ডন
লন্ডনের ওয়েস্ট মিনস্টার এলাকায় এলিজাবেথ টাওয়ারেই রয়েছে লন্ডনের বিখ্যাত বিগ বেন টাওয়ার ক্লক। এটিও একটি চতুর্মুখী ঘড়ি। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অন্যতম অংশ বিগ বেনের ঘণ্টাধ্বনি। আগে টাওয়ারটিকে ডাকা হতো ক্লক টাওয়ার নামে। পরে ২০১২ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ক্ষমতা গ্রহণের হীরকজয়ন্তী উদ্্যাপনকে স্মরণীয় করে রাখতে নতুন করে এর নাম রাখা হয় এলিজাবেথ টাওয়ার।

১৮৫৯ সালের ১১ জুলাই টাওয়ারটির উদ্বোধন করা হয়। ১০৫ মিটার বা ৩১৫ ফুট উঁচু এই টাওয়ারটি নির্মাণে সময় লেগেছিল প্রায় ১৩ বছর। মোট পাঁচটি ঘণ্টা রয়েছে এই টাওয়ারে। সব থেকে বড় ঘণ্টা বিগ বেনের ওজন সাড়ে ১৩ টন। এই বড় ঘণ্টাটির নামেই পরিচিত এই ক্লক টাওয়ার। আর যে হাতুড়ি দিয়ে বিগ বেনে আঘাত করা হয়, সেটির ওজন ২০০ কেজি। বিগ বেন ছাড়াও আরও চারটি ঘণ্টা আছে টাওয়ারে, যেগুলো কিনা মৃদু শব্দ করে। বিগ বেনের শুধু ঘড়িটির ওজনই ৫.০৮ টন। ঘড়ির ডায়ালের প্রতিটি ডিজিট ২ ফুট লম্বা। সংস্কারের কাজের জন্য বন্ধ থাকা ছাড়া ১৫৭ বছর ধরে প্রতি ঘণ্টায় বিগ বেন-এর ঘণ্টাধ্বনি বাজছিল।
লন্ডনে ঘুরতে গিয়ে বিগ বেন দেখেননি এমন পর্যটকের সংখ্যা খুব কমই। বিগ বেনের নিজস্ব একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট আছে। এই টাওয়ারটি যুক্তরাজ্যের নতুন বছর উদযাপনেরও কেন্দ্রস্থল। অবশ্য এর নাম বিগ বেন কীভাবে হলো, সেটা নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। অনেকে বলে থাকেন, স্যার বেনজামিন হলের নাম থেকে হয়েছে বিগ বেন। এই টাওয়ারে যে ঘড়ি রয়েছে, সেটার নকশাকার পেশাদার কেউ ছিলেন না। নাম এডমন্ড বেকেট ডেনিসন। তিনি পেশায় একজন উকিল। ঘড়ি তৈরি ছিল তাঁর শখ। আবার মতভেদ আছে যে এই টাওয়ারটির নকশা করেছিলেন অগাস্টাস পুগিন। ২০২১ সাল পর্যন্ত অবশ্য বিগ বেনের শব্দ শোনা যাবে না। এটির সংস্কার চলছে আপাতত। তারপরেই আবার পুরান ঐতিহ্য নিয়ে স্বমহিমায় ফিরবে বিগ বেন।
পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন ক্লক টাওয়ার
প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে কোনো রকম মিনিট বা সেকেন্ডের কাঁটা ছাড়াই গোল চাকতিতে একটি মাত্র নির্দেশক কাঁটা ও সময়ের ঘরের ছক নিয়ে প্রাচীন মিসরীয় এবং ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় যে ঘড়ির প্রচলন হয়, তার নাম ছিল ‘সূর্যঘড়ি’। ধারণা করা হয় মিসরীয়রাই প্রথম প্রকৃতিনির্ভর সূর্যঘড়ির প্রচলন করেন। ইউরোপীয়রা যান্ত্রিক ঘড়ির রূপ দেন ১৪ শতাব্দীতে। ১৬৫৭ সালে ডাচ্ জ্যোতির্বিদ ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন্স নির্ভুলভাবে ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ডের কাঁটাসংবলিত উন্নতমানের যান্ত্রিক ঘড়ির নকশা তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে এসব ঘড়ি টাওয়ারেও স্থান পেতে থাকে।

ক্লক টাওয়ারগুলোর বেশির ভাগই বর্তমানে তাদের নান্দনিকতার জন্য প্রশংসিত, তবে তারা একসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে কাজ করেছিল। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বা তারও আগে, বেশির ভাগ লোকের ঘড়ি ছিল না। প্রথম ঘড়ির মুখ ছিল না, তবে এটি ছিল একমাত্র ঘণ্টার ঘড়ি। এগুলোর ঘণ্টা বাজিয়ে আশপাশের স¤প্রদায়কে কাজ করতে বা প্রার্থনা করতে ডাকা হতো। এগুলো তাদের টাওয়ারে স্থাপন করা হয়েছিল, যাতে ঘণ্টাগুলো অনেক দূর থেকেও শোনা যায়। শহরের কেন্দ্র বা টাউন সেন্টারের কাছাকাছি ক্লক টাওয়ার স্থাপন করা হতো। এবং কারণবশতই সেগুলো লম্বা টাওয়ারের ওপরে স্থাপন করা হতো।
পৃথিবীর প্রথম ক্লক টাওয়ারে হয়তো ক্লক ছিল না। কিন্তু প্রযুক্তি আরও সহজলভ্য হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে টাওয়ারগুলোতে ঘণ্টার পাশাপাশি বড় বড় ডায়াল স্থান করে নিতে থাকে। আর বিশ্ববাসীও সাক্ষী হয়ে ওঠে অসাধারণ সব ক্লক টাওয়ারের।
– ফয়সাল হাসান সন্ধী
প্রকাশকাল: বন্ধন ১১৪ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৯