আবুধাবির স্থাপনা নির্মাণে নতুন ধারা আল দার প্রপার্টিস

পারস্য উপসাগরের তীরঘেঁসে গড়ে ওঠা মনোমুগ্ধকর নগর আবুধাবি; আরব আমিরাতের রাজধানী। এখানকার ঝাঁ-চকচকে স্থাপনার সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হবে যে কেউও। বিশ্বে অত্যাধুনিক আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, এর পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান মধ্যপ্রাচ্যের। মধ্যপ্রাচ্যের অত্যাধুনিক এই ভবনগুলো কেবল আভিজাত্য আর জাঁকজমকের জন্যই নয়, বরং কখনো কখনো এগুলো সৌন্দর্য আর চমৎকার স্থাপনাশিল্পের নিদর্শনও! এ রকমই বিস্ময়কর এক স্থাপনা আল দার প্রপার্টিস, যা মূলত একটি ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির সদর দপ্তর। আকাশচুম্বী ভবনের তালিকায় এটিই প্রথম বৃত্তাকার স্থাপনা। পারস্য উপসাগরের কোলঘেঁষে আল রাহা বিচে গড়ে ওঠা অপূর্ব এই ভবনটি বাইরের কাচের দেয়ালে প্রতিফলিত সূর্যালোকে মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করে। কাছ কিংবা দূর থেকে এর সৌন্দর্য সমান উপভোগ্য। আবুধাবির হাইওয়ে, সমুদ্র এবং শহর থেকেও ভবনটি সহজেই দেখা যায়।

আল দারের এই সদর দপ্তর নির্মাণের প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল কাতারের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এমজেড অ্যান্ড পার্টনারসের। ভবনটির ডিজাইন করা হয় ২০০৫ সালে। এরপর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে প্রকল্পটির দায়িত্ব নেয় অরূপ কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার্স লি., যাতে এক বছরের মধ্যে এর নির্মাণকাজ শেষ করা যায়। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটির প্রকৌশলী স্টুয়ার্ট ক্লার্ক স্থাপনাটির স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন। এই প্রকল্পটি আমেরিকান সিস্টেম অব ক্ল্যাসিফিকেশনের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের লিড (US Green Building Council, LEED) নীতিমালা অনুসারে নির্মিত।

ভবনটির নকশা প্রণয়নের সময় এমজেড অ্যান্ড পার্টনারস চেয়েছিল এমন কিছু নির্মাণ করতে, যেটা তৎকালীন সব ধরনের উঁচু নগরভবন নির্মাণের প্রচলিত ধারণাটি পাল্টে দেবে। আর এ ক্ষেত্রে তারা শতভাগ সফল। আবুধাবির আকাশচুম্বী ভবনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল এই ভবনটি যেন সাগর থেকে উঠে এসে আবুধাবি আর তার সমস্ত স্থাপনাকে পিছে ফেলে সদর্পে জানান দিচ্ছে এর উজ্জ্বল উপস্থিতির। এমজেড অ্যান্ড পার্টনারসের প্রতিষ্ঠাতা স্থপতি মারয়ান গাইবের মতে, এই নকশার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক এর সারল্য আর সহজবোধ্যতা। নকশাটির পেছনের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। স্থপতি এমন কিছু নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যেটা একই সঙ্গে হবে সাবলীল; সেই সঙ্গে আবুধাবির অন্যান্য জটিল স্থাপনার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে সুস্পষ্ট ব্যবধানে। সূচনা করবে আবুধাবির স্থাপনা নির্মাণে নতুন ধারার। ভবনের নকশার ক্ষেত্রে বৃত্তাকৃতিকে বেছে নেওয়াটাই এর আসল চমক। আর বৃত্তের আকৃতি কেমন হবে তার জন্য সোনালি অনুপাত বা গোল্ডেন রেশিওর ব্যবহার আরেকটি অনন্য দৃষ্টান্ত। গোল্ডেন রেশিওর ক্ষেত্রে বৃত্তে বন্দী একটি পঞ্চভুজ অথবা বৃত্তের মধ্যে হাত-পা প্রসারিত একজন মানুষকে কল্পনা করা হয়েছে, যার কোমর বা মধ্যবিন্দু থেকে ওপরের অংশ ও নিচের অংশের অনুপাত ১ : ১.৬১। এখানে পায়ের দিক অর্থাৎ নিচের দিকের অংশটি ভবনের বেসমেন্ট হিসেবে বিবেচ্য। অপর দিকে বৃত্ত হচ্ছে একতা, স্থিতিশীলতা আর সাম্যের প্রতীক। সেই সঙ্গে এটি অনন্ত বা অসীমত্বের প্রতীকও, যার নেই কোনো শুরু বা শেষ। গোলকাকৃতির ভবনটি দেখলে মনে হয় সমুদ্রতীরে বালুকাবেলায় ঝিকমিক করছে বিশালাকৃতির একটি মুক্তাখন্ড।

স্থাপনার পার্শ্বচিত্র

ভবনটি নির্মাণের সময় অরূপ ইঞ্জিনিয়ার্স এমজেড অ্যান্ড পার্টনারসের মূল নকশা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। এতে ভবনটিকে আরও আকর্ষণীয় ও বাণিজ্যিক উদ্দেশে ব্যবহারের উপযোগী হয়েছে। মূল নকশায় ভবনের দুই পাশের সম্মুখভাগ দুই দিকে আলাদা থাকলেও অরূপ ইঞ্জিনিয়ার্স এটিকে আরও কাছাকাছি এনেছে। এ ক্ষেত্রে মূল নকশা অনুসরণ করলে আরও বেশি জায়গার প্রয়োজন হতো, এতে বাড়ত ভবনটির আকার। আর্কিটেক্ট মূল নকশায় যে ডায়াগ্রিড রেখেছিলেন তাতে বৃত্তাকার ভবনটিকে যে দুভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল, সেখানে ভূমি থেকে অনেক বিমের নেটওয়ার্ক তৈরি হতো, যা কি না একটা বাণিজ্যিক ভবনের জন্য ঠিক ব্যবহারের উপযোগী নয়। এ ছাড়া এখানে প্রয়োজন হতো অতিরিক্ত ১০ হাজারেরও বেশি কাচের ভিন্ন ভিন্ন মাপের বিম। স্থাপনাটির ইঞ্জিনিয়ার স্টুয়ার্ট এ জন্য ডায়াগ্রিড নকশায় সমান মাপের কৌণিক বিম রেখেছেন, ফলে ১০ হাজার ভিন্ন মাপের কাচের বিমের বদলে মাত্র আটটি সমান দৈর্ঘ্য ও মাপের বিমেই কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানের আরেকটি দিক ছিল ভবনটির ফেসিং, মানে এটি কোন দিকে গড়ে উঠবে। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত হলে ভবনে সরাসরি সূর্যরশ্মি কম পড়ত, ফলে কাচের দেয়ালও হতো উত্তপ্ত। এতে ভবনটি শীতল থাকত বেশি। কিন্তু অরূপ ইঞ্জিনিয়ার্সের ভাবনাটা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। পূর্ব-পশ্চিম বিস্তৃত হওয়ায় ভবনটি থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুই-ই দেখা যায়। আর সারা দিনের সব আলো এর কাচের দেয়ালে প্রতিফলিত হওয়ায় ভবনটি হয়ে ওঠে আরও দর্শনীয়। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় আল দার সদর দপ্তর হয়ে ওঠে যেন আবুধাবির বিশালাকৃতির সৌন্দর্য আয়না, যেখানে প্রকৃতির নান্দনিক রূপটি প্রতিফলিত হয় অবিরত।

স্থাপনার ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছে এরডিক সিস্টেম। হালকা ওজনের অ্যালুমিনিয়াম প্যানেল, কাঠের ফ্রেম এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য আনুষঙ্গিক উপকরণ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। নির্মাণসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে রিসাইকেল্ড গ্লাস, কংক্রিট আর আগে থেকেই নির্মিত বাথরুম ফিটিংস, সিঁড়ি ও কলাম। মূল নকশা প্রস্তুত হওয়ার এক মাস পর থেকেই এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। আনুষঙ্গিক নকশার বিস্তারিত করা হয়েছে কাজের সঙ্গে সঙ্গে। সময় বাঁচানোর জন্যই এই ভবনে পূর্বনির্মিত সিঁড়ি, কলাম বা বাথরুম ফিটিংসের মতো সামগ্রীর ব্যবহার করা হয়েছে। এর কংক্রিটের নির্মাণকাজ শেষ হতে সময় লেগেছে এক বছর। পরবর্তী ১৪ মাসে প্রস্তুত করা হয় এর স্টিলের ফ্রেমওয়ার্কগুলো। সবচেয়ে জটিল অংশ ছিল কাঠামোটির বহির্দেয়াল নির্মাণ। শামুকের খোলসের মতো বাঁকানো কাচ দিয়ে এর পৃষ্ঠদেশ নির্মাণ আধুনিক যেকোনো ভবনেরই অন্যান্য জটিল স্থাপনা নির্মাণের চেয়ে ছিল বেশি চ্যালেঞ্জিং। এ ছাড়া এমন বৃত্তাকার ভবন নির্মাণে ডায়াগ্রিড কৌশল সবিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ডায়াগ্রিড হচ্ছে ডায়ামন্ড শেপের স্থাপনা। মূল কাঠামো তৈরিতে ষ্টিলের ডায়ামন্ড আকারের এই স্ট্রাকচার ব্যবহার করায় একদিকে যেমন নির্মাণব্যয় কমেছে, তেমনই এটিকে দিয়েছে শক্ত ও স্থায়ী ভিত্তি। কংক্রিট দিয়ে এর মূল কাঠামো তৈরি করলে এই সুবিধাগুলো পাওয়া যেত না।

গোল্ডেন রেশিও প্রযুক্তি ও ভবনে কাচ দেয়াল স্থাপন

ভবনটির উল্লেখযোগ্য আরেকটি দিক হচ্ছে এর ছাদ। প্রচলিত চারকোনাকৃতির অন্যান্য ভবনের ধারণা অনুযায়ী এতে নেই কোনো ছাদ। এই ভবনটি তিন দিকের ওপর নির্মিত। তিন নম্বর দিকটি হচ্ছে জিপার এলিমেন্ট (যেন দুটি বাটিকে জিপার দিয়ে আটকিয়ে রাখা হয়েছে)। এটাই ভবনের ছাদ (ওপরের দিকের অংশ), পার্শ্বজানালা এবং দুই পাশকে একত্র করার কাজ করছে। ভবন নির্মাণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এর আলোকব্যবস্থা ও ভেন্টিলেশন বা বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা। এখানে এমনভাবে আলোকসজ্জা করা হয়েছে যেন তা অন্যান্য ডিজাইন এলিমেন্টকে করে তুলতে পারে আরও উজ্জ্বল। কাচের মধ্য থেকে বহির্দৃশ্য দেখতে পাওয়াও এক অনন্য সংযোজন। ভেন্টিলেশন এমনভাবে করা হয়েছে যেন এটি এর ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও এক্সটেরিয়র ডিজাইনের সাদৃশ্যে কোনো অসমাঞ্জস্যতা না আনে। এর ইন্টেরিয়র লাইটিং আর এক্সটেরিয়র ডিজাইন মিলে এই গোলকাকৃতির ভবনকে করে তুলেছে আরও সুন্দর ও আকর্ষণীয়।

১ লাখ ২৩ হাজার বর্গমিটার জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা এই ২৩ তলা উঁচু ভবনে রয়েছে প্রায় ৬২ হাজার বর্গমিটার কমার্শিয়াল স্পেস, যেখানে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের কর্মস্থলের সংকুলান নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া এখানে রয়েছে ১৭ হাজার থেকে ২৭ হাজার বর্গমিটারের কয়েকটি কলাম ফ্রি স্পেস আর তিনতলা ভূমিস্থ পার্কিংয়ে ১ হাজার ১৮৪টি গাড়ির পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়েছে ৪ হাজার বক্স এবং ৮ হাজার ইউটিলিটি পাওয়ার ট্রান্সমিটার। এর ১৪টি লিফট (১২টি প্যাসেঞ্জার লিফট ও ২টি সার্ভিস লিফট) সেকেন্ডে ৬ মিটার গতিতে ওঠানামা করতে পারে। এর ১৪টি লিফটের পাশাপাশি এখানে তিনটি মনোপ্সেস এলিভেটর, একটি বৃত্তাকার হাইড্রোলিক এলিভেটর ও দুটি ডাম্বওয়েটার্স আছে। এই প্রজেক্টে আরও আছে আন্ডারগ্রাউন্ড ভ্যাকুয়াম ওয়েস্ট কালেকশন সিস্টেম। বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য এ রকম ব্যবস্থা আবুধাবিতে এটিই প্রথম।

ভবনের ইন্টেরিয়র ডিজাইন

প্রকৃতিবান্ধব অনন্য স্থাপনার নিদর্শন হিসেবে ১২১ মিটার উচ্চতার এই ভবনটি বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছে, যার মধ্যে দ্য বিল্ডিং এক্সচেঞ্জ (The Building Exchange-BEX) থেকে ‘Best Futuristic Design’ পুরস্কার, গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল থেকে ‘Silver LEED as green building, Green Building Council (USA)’ পুরস্কার, ইঞ্জিনিয়ার অস্ট্রেলিয়া থেকে বিল্ডিং অ্যান্ড স্ট্রাকচার ক্যাটাগরিতে ‘Engineers Australia NSW Excellence Awards’ পুরস্কার, ক্যানপি থেকে ‘Tekla Middle East BIM Awards’ পুরস্কার, অ্যারাবিয়ান প্রপার্টি থেকে ‘Best Office Development’ পুরস্কার যার মধ্যে অন্যতম।

মহুয়া ফেরদৌসি

প্রকাশকাল: বন্ধন ৭২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top