স্যালগিনাটোবেল ব্রিজ
সুইজারল্যান্ডের এক ধরনের আর্চ নির্মিত সেতু

আর্চ (Arch) হলো এমন একটি অবকাঠামো, যার বিস্তার থাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গাজুড়ে এবং এটি ওই জায়গার ওপরে সম্পূর্ণ অবকাঠামোটির ভার বহন করে। একে অনেকে খিলান নামেও চেনেন। তাই বলা যায়, দুটি স্তম্ভের ওপর প্রলম্বিত অংশ দ্বারা যে নকশা তৈরি করা হয়, তাকে খিলান বা আর্চ বলে। প্রাচীনকাল থেকেই আর্চের সাহায্যে মনোরম স্থাপত্যশৈলীর দালান ও অন্যান্য অবকাঠামো তৈরি হয়ে আসছে, এখনো আর্চ নির্মাণশিল্পের অনন্য এক অনুষঙ্গ হয়ে আছে। আর্চ দ্বারা সাধারণত বিভিন্ন অলংকৃত তোরণ ও দালানকোঠার সম্মুখভাগ নির্মাণ করা হলেও বিভিন্ন ধরনের সেতু নির্মাণে এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এখানে আমরা বিশ্বের প্রথম থ্রি-হিঞ্জ আর্চ সেতু স্যালগিনাটোবেল ব্রিজের নির্মাণশৈলী ও স্থাপত্যকৌশল স¤পর্কে জানাব।

আর্চের রকমফের

আর্চ দ্বারা প্রধানত পাথর ও রডবিহীন কংক্রিটের (Non-Reinforced Concrete) অবকাঠামো তৈরি করা হয়। কারণ, বলবিদ্যার দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী আর্চ সম্পূর্ণরূপে সংকুচিত অবস্থায় (Pure Compression Form) থাকে, যা এর ওপর ক্রিয়াশীল বলকে কম্প্রেসিভ স্ট্রেসে (Compressive Stress) রূপান্তর করে, টেনসাইল স্ট্রেসকে (Tensile Stress) সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত করে। এ জন্য আর্চ অবকাঠামোতে রডের কোনো প্রয়োজন হয় না। আর্চ সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে। এগুলো হলো সংযুক্ত আর্চ (Fixed Arch), যা ছোট স্প্যানের ব্রিজ বা টানেল তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়, দুই হিঞ্জবিশিষ্ট আর্চ (Two-Hinged Arch), যা সাধারণত বড় স্প্যানের ব্রিজ তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় এবং তিন হিঞ্জবিশিষ্ট আর্চ (Three-Hinged Arch), যা মাঝারি স্প্যানের ব্রিজ বা বড় দালানের ছাদ তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়।

স্যালগিনাটোবেল ব্রিজ

সুইজারল্যান্ডের স্যালগিনাটোবেল ব্রিজ একধরনের আর্চ নির্মিত সেতু। এর আগেও অনেক আর্চ দিয়ে সেতু নির্মিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে, কিন্তু এই স্যালগিনাটোবেল ব্রিজের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি বিশ্বের প্রথম তিন হিঞ্জবিশিষ্ট আর্চ (Three-Hinged Arch) সেতু। এটি সুইজারল্যান্ডের স্কিয়ারসে আলপাইন ভ্যালির ওপরে ১৯২৯-৩০ সালে নির্মাণ করা হয়। সম্পূর্ণ রি-ইনফোর্সড (Reinforced) কংক্রিট দ্বারা নির্মিত এই সেতুটির নকশা প্রণয়ন করেছেন প্রখ্যাত সুইস পুরকৌশলী রবার্ট মেইলারট। অন্যান্য আর্চ ব্রিজের তুলনায় এই ব্রিজটি আলাদা এই কারণে যে স্প্যানের মাঝখানে একটি অতিরিক্ত হিঞ্জ থাকার কারণে আর্চটি দুটি বিপরীত দিকে সমানভাবে সরে যেতে পারে (Move in Two Opposite Directions) এবং এর ফলে যেকোনো মানের সংকোচন-প্রসারণের (Contraction-Expansion) সঙ্গে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। শুধু তা-ই নয়, ব্রিজটিতে তাপীয় পরিবর্তনের কারণে কোনো আলাদা স্ট্রেস কাজ করে না। তিন হিঞ্জবিশিষ্ট এই আর্চ সেতুটির কাঠামো স্থিতিবিদ্যা অনুযায়ী সীমাবদ্ধ (Statically Determinate)। এর ফলে ব্রিজের ফাউন্ডেশন ডিজাইন করা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে সেতুটি অবস্থিত হওয়ায় ব্যতিক্রমধর্মী নির্মাণশৈলীর কারণে শুরু থেকেই স্যালগিনাটোবেল ব্রিজ বিশ্বের তাবৎ পুরকৌশলী ও ডিজাইনারের কাছে এক দর্শনীয় অবকাঠামো বলে পরিচিতি পেয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালে স্যালগিনাটোবেল ব্রিজকে আন্তর্জাতিক ঐতিহাসিক পুরকৌশলীয় নিদর্শন (International Historic Civil Engineering Landmark) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

অবকাঠামোগত বৈশিষ্ট্য

স্যালগিনাটোবেল ব্রিজের আর্চটি দৈর্ঘ্যে ১৩৩ মিটার। সবচেয়ে লম্বা স্প্যানটির দৈর্ঘ্য ৯০ মিটার। এর প্রধান অংশটি হচ্ছে একটি ফাঁপা কংক্রিটের বক্স গার্ডার, যা আর্চের কেন্দ্রীয় অংশের ওপরে অবস্থিত। ব্রিজের ওপর রাস্তাটি ৩.৫ মিটার চওড়া। রাস্তার স্ল্যাবটির ভিত্তি রি-ইনফোর্সড (Reinforced) কংক্রিটের পিলার দ্বারা তৈরি, যা আর্চে গিয়ে মিশেছে। ১৯২৯ সালে ব্রিজটির আলগা অংশগুলো (False Work) নির্মাণের মধ্য দিয়ে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়, যা শেষ হয় ১৯৩০ সালে। ১৯৩০ সালের আগস্ট মাসে সেতুটি সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

ব্রিজের উপরিভাগ ও নির্মাণকালীন ব্রিজের চিত্র

নির্মাণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ

যদিও এটি একটি যুগান্তকারী নির্মাণকাজ ছিল কিন্তু কিছুক্ষেত্রে কাজের মধ্যে গলদ রয়ে গিয়েছিল। যেমন- ব্রিজের ডেকটি পানিরোধক করে তৈরি করা হয়নি, কংক্রিটের বহির্ভাগের পুরুত্ব (Concrete Cover) যথাযথ ছিল না এবং পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা ছিল কিছুটা নাজুক। তাই ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালে ব্যাপক মেরামত কাজ হাতে নেওয়া হয়, সেতুটির প্যারাপেটের (Parapet) ডিজাইন কিছুটা সংশোধন করা হয় এবং পানিনিরোধকব্যবস্থা যোগ করা হয়। কিন্তু ১৯৯১ সালে এসে আবার দেখা যায় সেতুটির উপরিভাগের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। তখন পানি নিষ্কাশনব্যবস্থাকে আরও উন্নত করা হয় এবং ডেকের উপরিভাগের কংক্রিট অনেকটা তুলে ফেলে স্টক্রিট (Shotcrete) নামক একধরনের বিশেষ কংক্রিট (যা নজল দিয়ে উচ্চগতিতে ঢেলে এরপর ঢালাই করা হয়) দেওয়া হয়। এভাবে ১৯৯৮ সালে সম্পূর্ণ মেরামত কাজ শেষ হয়, যাতে মোট খরচ হয়েছিল প্রায় ১৩ লাখ মার্কিন ডলার।

সুইজারল্যান্ডের অহংকার স্যালগিনাটোবেল ব্রিজ বহু বছর আগে থেকেই অনেক ব্রিজ নির্মাণকারী প্রকৌশলী ও স্থপতিদের কাছে এক অনুপম নির্মাণ কৌশলের নিদর্শন। আধুনিক যুগের অনেক বৃহৎ ও সুন্দর ব্রিজের মধ্যেও এই সেতুটি এক ব্যতিক্রমধর্মী স্থাপনা হিসেবে আরও অনেক দিন সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকবে, এ কথা বলা যায় সহজেই।     

তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট

আবু আহমেদ সুফিয়ান

প্রভাষক, পুরকৌশল বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৩ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top