বিশ্বজুড়ে এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সুন্দর নান্দনিক মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর বৃহদাকৃতির চমৎকার মসজিদ। আগেও অনেক দেশে তৈরি হয়েছে চোখ ধাঁধানো চমক লাগানো সব মসজিদ। এটা নিঃসন্দেহে স্থপতিদের জন্য গর্ব করার মতো বিষয়। স্থপতিদের আধুনিক মনস্ক চিন্তাচেতনার সঙ্গে বাহ্যিক সৌন্দর্যবোধে আর্থিক সাশ্রয়ে নির্মিত হয়েছে এমন সব মসজিদ। এ রকমই চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায় তুরস্কের স্থপতি ভেডেট ডেলোকের স্থাপনায়, যেটা গড়ে উঠেছে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে। নাম যার ফয়সাল মসজিদ। এটি শাহ ফয়সাল মসজিদ নামেও পরিচিত।
ফয়সাল মসজিদ পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ মসজিদ। পাকিস্তানের জাতীয় মসজিদও এটি। বিশ্বে নামকরা যে কয়েকটি মসজিদ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম। বড় মসজিদের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ায় যা ষষ্ঠ। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এটি ধরে রেখেছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মসজিদের সুনাম। প্রায় তিন লাখ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারে মসজিদটিতে। ৫৪ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে মসজিদটির অবস্থান। এতে রয়েছে চারটি মিনার। প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ৩০০ ফুট এবং মসজিদটি তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৮৬ সালে। এটির স্থপতি তুরস্কের ভেডেট ডেলোকে (Vedat Dalokay)। মসজিদটির নকশাটি তিনি এমনভাবে করেছিলেন, যা দেখে মনে হয় মরুভূমির বেদুইনদের তাঁবু এটি।

চমৎকার স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মসজিদটির অবস্থিত ফয়সাল এভিনিউয়ের দক্ষিণে মারগোলা পাহাড় ও হিমালয় পর্বতের পাদদেশে। অবস্থানগত কারণে মসজিদটির গুরুত্ব অনেক। এমনকি অনেক দূর থেমে মসজিদটি দেখা যায় দিনে কিংবা রাতে। মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে সৌদি আরবের সাবেক বাদশা ফয়সাল বিন আবদুল আজিজের নাম অনুসারে। আর তাই তো মসজিদটি তৈরিতে সব ধরনের অর্থায়ন করেছেন সৌদি বাদশা স্বয়ং। একে পাকিস্তানের প্রতি তাঁর শুভেচ্ছা উপহারও বলা চলে।
বর্তমানে মরক্কোর কাসাব্লাংকার হাসান- ওও, মক্কার মসজিদ আল-হারাম এবং মদিনার আল মসজিদ-আল নাবাওয়াই মসজিদের পরে আয়তন বিবেচনায় ফয়সাল মসজিদের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ।
ফিরে দেখা
১৯৬৬ সালে বাদশা ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ সরকারি সফরে পাকিস্তানে এসে পাকিস্তান সরকারকে মসজিদ তৈরির জন্য যাবতীয় সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় পাকিস্তানের ইসলামাবাদে গড়ে ওঠে সে সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ মসজিদটি।
বিশ্বের ১৭টি দেশের স্থপতিরা মসজিদটির নকশা প্রণয়নে ৪৩টি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। মসজিদটির চূড়ান্ত নকশা করার জন্য নির্বাচিত হন তুরস্কের স্থপতি ডেভেট ডেলোকে। ১৯৭৬ সালে মসজিদের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল কনস্ট্রাকশন অব পাকিস্তান। পুরো কাজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন প্রকৌশলী আজিম খান। বিশাল এ নির্মাণযজ্ঞে সৌদি সরকার প্রায় ১৩০ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল বিনিয়োগ করে, যার বর্তমান অর্থমূল্য ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। নির্মাণকাজ চলাকালীন বাদশা ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর তাঁর নামানুসারে মসজিদটি নামকরণ করা হয় ফয়সাল মসজিদ। এমনকি মসজিদসংলগ্ন রাস্তার নামও রাখা হয়েছে নিহত বাদশার নামে। মসজিদটির নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয় ১৯৮৬ সালে।

অনেক গোঁড়া মনোভাবসম্পন্ন মুসলিম এই মসজিদটির নকশার সমালোচনা করেন। কেননা সচরাচর মসজিদ তৈরিতে যে নকশা করা হয়, তা থেকে এটা ভিন্ন হওয়ায় একে সমালোচিত হতে হয়। মসজিদটির অবকাঠামোতে কোনো গম্বুজ নেই, যা সাধারণত সব মসজিদেই থাকে। কিন্তু সব কথাই থেমে যায় মসজিদটির নির্মাণকাজ শেষে।
মসজিদের নকশা
ফয়সাল মসজিদের নকশাকার তুরস্কের ভেডেট ডেলোকে প্রকল্পটির নান্দনিক নকশার জন্য আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার খেতাবে ভূষিত হন। মসজিদটি স্থাপত্য দৃষ্টিকোণে অত্যাধুনিক ও অদ্বিতীয়। সনাতন নকশার মসজিদগুলোতে গম্বুজ দেখা গেলেও ফয়সাল মসজিদে কোনো গম্বুজ নেই; পরিবর্তনীয় নয় এমন আদর্শে তৈরি এমন মসজিদ বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই।
মসজিদটির ব্যতিক্রমধর্মী নকশা এটাই মনে করিয়ে দেয় যে দক্ষিণ এশিয়ার ইসলামিক স্থাপত্য, যা আরব বেদুইন তাঁবুর নতুন সংস্করণ, যেখানে আছে বিশাল ত্রিভুজ আকৃতির নামাজের জন্য মিলনায়তনসহ চারটি মিনার। মিনারটির নকশাটা করা হয়েছে সরু পেনসিলের মতো চিকন রেখাচিত্রে, যাতে ফুটে উঠেছে তুরস্কের নিজস্ব ঐতিহ্য।
ফয়সাল মসজিদটি আট দিকে কংক্রিট শোল দ্বারা নির্মিত, যা আরব দেশের মরুভূমির বেদুইনদের তাঁবুর কথা মনে করিয়ে দেয় এবং চারটি ব্যতিক্রমী মিনার মনে করিয়ে দেয় তুরস্কের অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্যশৈলীকে।
নামাজ পড়ার জায়গায় ঢোকার রাস্তাটি পূর্বদিকে। ২০০০ সাল থেকে সেখানে পরিচালিত হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। ইদানীং যা স্থানান্তরিত হয়েছে নতুন ক্যাম্পাসে। মসজিদটিতে রয়েছে লাইব্রেরি, বক্তব্য দেওয়ার হলরুম, মিউজিয়াম ও ক্যাফে। তাঁবু আকৃতির প্রধান মিলনায়তনটি সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে আচ্ছাদিত ও মোজাইকে সুসজ্জিত। পাকিস্তানের বিখ্যাত শিল্পী সাদেকুয়েন অংকিত ক্যালিগ্রাফির বর্ণিল ছটা রয়েছে মসজিদটির দেয়ালে। মোজাইক প্যাটার্নের পশ্চিম দিকের দেয়ালে কালিমা লেখা, যা নেওয়া হয়েছে কুফির পাণ্ডুলিপি থেকে এবং একই লেখা দেখা যাবে মসজিদের আয়নায় প্রতিবিম্ব প্যাটার্নে।

মসজিদের ধারণক্ষমতা
ফয়সাল মসজিদটির অবস্থান প্রায় ৫৪ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে। নামাজ পড়ার প্রধান হলরুমে ১০ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারে। এতে প্রবেশের জন্য ২৪ হাজারটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। তা ছাড়া এতে আছে ৪০ হাজার কোর্টইয়ার্ড এবং তৎসংলগ্ন একটি মাঠ। যদিও নামাজ পড়ার জায়গাটি অপেক্ষাকৃত ছোট তবুও আয়তনে ফয়সাল মসজিদটি বিশ্বে মুসল্লিদের নামাজ পড়ার জন্য তৃতীয় বৃহত্তম। এটি মুসলমানদের নামাজের জায়গা হিসেবে সৌদি আরবের মক্কার মসজিদ আল-হারাম এবং মদিনার আল-মসজিদ আল-নববীর পর ধরা হয়। প্রতিটি মসজিদে রয়েছে চারটি মিনার এবং উচ্চতায় প্রতিটি ৮০ মিটার (২৬০ ফুট), যা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উঁচু মিনার; পরিধিতে যা ১০X১০ মিটার। শৈল্পিক স্থাপত্যকর্মে ফয়সাল মসজিদ পৃথিবীর সুন্দরতম মসজিদগুলোর একটি।
প্রকৌশলী মহিউদ্দীন আহমেদতথ্যসূত্র : ইন্টারনেট
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪২ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৩