স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য বাড়ি নির্মাণ

মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম বাসস্থান। বাংলাদেশে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। গ্রামের খেটেখাওয়া অল্প আয়ের মানুষ সব সময় চায় নিরাপদ বাসস্থানের নিশ্চয়তা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর জীবিকার তাগিদে মানুষ শহরকেন্দ্রিক হচ্ছে, তথাপি জনসংখ্যার একটি বড় অংশের বাস এখনো গ্রামে। বাংলাদেশের শতকরা ৪৭ ভাগ মানুষের মানসম্মত বাড়ি নেই, যা দিয়ে বৃষ্টি কিংবা ঠান্ডা ঠেকানো যায়। বেশির ভাগ গ্রামীণ মানুষ ঘর বানায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার মধ্যে। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা কিংবা দুর্যোগ সামাল দিতে পারে না ছনের চাল কিংবা হোগলাপাতার বেড়া দেওয়া এসব ঘর। নদীভাঙন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও আগুনে পুড়ে অসংখ্য মানুষের ঘরবাড়ি নষ্ট হয় প্রতিবছর।

বাসস্থানের নিরাপত্তা 

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কর্মসংস্থানের অপর্যাপ্ততা আর রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে মানুষ একক ও যৌথভাবে বাস করছে। বিশ্বে ৬৪০ মিলিয়ন মানুষ আশ্রয়হীন। এর তিনটি কারণ রয়েছে আর তা হচ্ছে দারিদ্র্য, মানুষে মানুষে বিভেদ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

১৯৮৭ সালে বন্যার পরে বিভিন্ন সংগঠন ও উদ্যোক্তা গ্রামীণ ঘরবাড়ির নির্মাণ প্রযুক্তি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করে। ইটের মেঝেতে চারটি কনক্রিটের পিলার দিয়ে বাড়ি বানানোর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়। চারটি পিলারের মাঝে ছয়টি বাঁশের খুঁটি এবং বিম হিসেবেও ব্যবহৃত হয় বাঁশ। কাঠ কিংবা টিন দিয়ে ছাদ বা ছাউনি বানানো হয় এসব ঘরে। এতে ভারী বৃষ্টিপাত এবং প্রচণ্ড ঠান্ডা থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

মজবুত ঘর নির্মাণ

ঘর তৈরির জন্য ঘরের নকশা অতীব জরুরি। ঘরটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেখানে স্বস্তিতে থাকা যায়, হাঁটাচলার জন্য একটু বাড়তি জায়গা থাকে। প্রয়োজনে একটু বড় বা ছোট করা যায়, এমন চিন্তা মাথায় রেখে তৈরি করতে হবে। নি¤œ আয়ভুক্ত মানুষের জন্য নির্মিত ঘরের অবকাঠামো হবে দীর্ঘমেয়াদি ও ওজনে হালকা। তা ছাড়া শক্ত ও মজবুতও হতে হবে, ঝড়ে যাতে উড়ে না যায়। সামান্য বাতাস বা বৃষ্টিতে ভেঙে নষ্ট না হয়। 

গ্রামে কম খরচে বাড়ি নির্মাণ 

শহর অঞ্চলে নির্মিত বাড়িগুলো বহুতল ভবনবিশিষ্ট। কিন্তু গ্রামে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এটি কল্পনাও করা যায় না। গ্রামের বেশির ভাগ জায়গায় পুরোনো মডেলের টিনের দোচালা ঘর দেখা যায়। অনেক জায়গায় রয়েছে মাটির ঘর। মাটির ঘরের বিশেষত্ব, সূর্যের আলোয় ঘর গরম হয় তাড়াতাড়ি এবং রাতে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়। এ সমস্যা কাটিয়ে খুব অল্প খরচে বসতবাড়ি শীতল রাখতে বাঁশের তৈরি বাড়ি বানানো উত্তম। 

নির্মাণ উপকরণ 

বাঁশ, মাটি, ঢেউটিন, ১২ ফুট উচ্চতায় ৬” X ৬” আরসিসি পিলার চারটি এবং বিমের জন্য চারটি, লোহার তৈরি এল টাইপ ফিটিং (চিত্র অনুযায়ী), নাট ও বোল্ট।

নির্মাণকৌশল 

১০” X ১০” একটি ঘর তৈরি করার জন্য পিলারের জন্য প্রাথমিকভাবে মোট চারটি স্থানে গাঁথুনি করতে হবে। গ্রামে কম খরচের জন্য বেশির ভাগ মানুষ বাঁশ ব্যবহার করে, যাতে ঘরটি দীর্ঘস্থায়ী হয়। তাই ঘরে প্রধান চারটি খুঁটি আরসিসি পিলার দিলে যেমন দীর্ঘস্থায়ী হবে, তেমনি প্রচণ্ড ঝোড়োবাতাসে সহজে উড়িয়ে নেবে না। খুঁটি দেওয়া হয়ে গেলে চারদিকে টানা দেওয়ার জন্য আরও চারটি বিম ব্যবহার করা হয়। আজকাল বাজারে রেডিমেইড ১২ ফুট লম্বা আরসিসি ৬” X ৬” মাপের পিলার পাওয়া যায়। নতুবা সহজেই এটি তৈরি করে নেওয়া যায়। পিলারগুলোর সঙ্গে টানা বিমের জন্য লোহার তৈরি এল-টাইপ ছিদ্রবিশিষ্ট ব্রাকেট দিয়ে নাট-বোল্টের সহায়তায় ঘরের প্রধান অবকাঠামো তৈরি করা হয়। (চিত্র-৯ অনুযায়ী) মাটির নিচে পিলার চারটি ২” থেকে ২.৫” নিচ পর্যন্ত গাঁথুনি দিলে ভালো হয়। প্রচণ্ড ঝড়ে যাতে ঘর উড়িয়ে নিয়ে যেতে না পারে। এরপর চিত্র নং-২ অনুযায়ী টিনের চাল সেই অবকাঠামোতে যুক্ত করতে হবে। যুক্ত করার জন্য অবশ্যই লোহার তৈরি এল-টাইপ ব্রাকেট নাট-বোল্ড দিয়ে সংযুক্ত করতে হবে। এভাবে তৈরি হয় ঘরের প্রধান কাঠামো।

ঘর তৈরির জন্য ঘরের নকশা অতীব জরুরি। ঘরটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেখানে স্বস্তিতে থাকা যায়, হাঁটাচলার জন্য একটু বাড়তি জায়গা থাকে। ছবি: ইউএনডিপি

পাটাতনের নির্মাণশৈলী

দোচালা ঘরের জন্য পাটাতন থাকা প্রয়োজন। গ্রামে প্রায় প্রতিটি গৃহস্থঘরে এই ব্যবস্থা আছে। পাটাতনে ধান, মরিচ ইত্যাদি তোলা ফসল রাখা হয়। সনাতন পদ্ধতি বাদ দিয়ে উন্নত এবং লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যুক্তিসঙ্গত। গ্রামের বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে ঘরের মাচা অনুযায়ী সাইজ করে নিতে হবে (চিত্র নং-৩)। তারপর সেই বাঁশগুলো আড়াআড়িভাবে চিরে দুই ভাগ করে ফেলতে হবে (চিত্র নং-৪)। এভাবে একটি বাঁশ থেকে দুটি খণ্ড পাওয়া যাবে। তারপর অর্ধেক কাটা বাঁশগুলো তার বা রশি দিয়ে বেঁধে একত্র করতে হবে (চিত্র নং-৭)। বাঁধা হয়ে গেলে পুরো পাটাতনটি দোচালা ঘরের মাঝখানে বিছিয়ে দিতে হবে। গ্রামে দেখা যায় প্রায় প্রতিটি ঘরে পানি মিশ্রিত মাটি দ্বারা ঘরের চারদিক লেপন করা হয়। ঠিক তেমনি পাটাতনটি দোচালা টিনের নিচে বসানোর পর চারটি খুঁটিতে ভালোভাবে আটকে দিতে হবে। প্রয়োজন হলে ঘরের মাঝখানে আড়াআড়িভাবে শক্ত বাঁশ দিতে হবে, যাতে পাটাতনটি ভারে নিচে পড়ে না যায়। অতঃপর পাটাতনে পানি মিশ্রিত মাটির দু-তিনটি প্রলেপ দিতে হবে (চিত্র নং-৮)। মাটির প্রলেপ বেশি করে দিলে প্রলেপের পুরুত্বটি বেশি হবে এবং তাতে দিনের বেলায় সূর্যের প্রচণ্ড তাপ দোচালা টিনকে গরম করে ঘরের নিচে প্রবেশ করতে অনেকটা বাধার সৃষ্টি করবে। রাতে ঘর ঠান্ডা থাকবে। দক্ষিণের জানালা খুলে তার সম্মুখ দিকে ভেজা চটের বস্তা ঝুলিয়ে দিলে ঠান্ডা বাতাস পাওয়া যাবে। অর্থাৎ দক্ষিণ দিক থেকে যে বাতাস বইবে তা যদি গরম থাকে তা ভেজা চটের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করায় ঘরের ভেতরে ঠান্ডা বাতাসের পরশ পাওয়া যাবে।

ঘরের চারপাশের দেয়াল

ঘরের সম্পূর্ণ কাঠামো তৈরি হওয়ার পর ঘরের চারদিকে দেয়াল দেওয়া প্রয়োজন। অনেকে টিন ব্যবহার করে। আবার অনেকে বাঁশের বেড়া দিয়ে থাকে। টিনের খরচ একটু বেশি কিন্তু মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী। পক্ষান্তরে বাঁশের বেড়া ব্যবহার করলে খরচ অপেক্ষাকৃত কম হয় কিন্তু কমে স্থায়িত্বও। বৃষ্টিতে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই অনেকে বাঁশের বেড়ার ওপর মাটির প্রলেপ দিয়ে সম্পূর্ণটাই মাটির ঘরে বদলে ফেলেন। মাটির ঘর হলে গরমে সুবিধা বেশি। ঘর ঠান্ডা থাকে। কিন্তু বর্ষাকালে মাটি ঝরে। তবে বর্ষা চলে গেলে পুনরায় মাটির প্রলেপে ঘরটি আবার নতুনত্ব ফিরে পায়। কম খরচে এখন প্লাস্টিকের দরজা পাওয়া যায়। এগুলো ব্যবহার করলে ঘর সুন্দর দেখায়। পানিতে দরজা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।

দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ গ্রামে বাস করে। তাদের আয় সীমিত। পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির সংখ্যাও কম। এ বিবেচনায় স্বল্প খরচে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে গ্রামে ঘর নির্মাণ করলে তা হবে সাশ্রয়ী ও দীর্ঘস্থায়ী। তদুপরি নির্মিত ঘরগুলো রক্ষা পাবে ঝড়-বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও। গ্রামের মানুষের একটি বড় বিনিয়োগ চলে যায় বাড়ি বানানোর কাজে। সেটি কমিয়ে আনতে পারলে অনেকেই এ রকম বাড়ি বানাতে আগ্রহী হবে। 

  • প্রকৌশলী মহিউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশকাল: বন্ধন ৩৬ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top