বর্তমানে উদ্যমী অনেক তরুণ স্থপতি ও প্রকৌশলী দেশে নিজেদের পেশাদারি দায়িত্ব পালন করছেন দক্ষতার সঙ্গে। বিষয়টি আমাদের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এর মধ্যে অনেকেই নতুন নতুন চিন্তায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক অপ্রাপ্তি থাকা সত্ত্বেও। এমনকি শহরকে রক্ষায় পরিবেশগত বিপর্যয়ের হাত থেকে প্রতিবেশকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন প্রাণান্ত। অনেকে আবার বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি এবং ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে তা নিজ দেশে নানাভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষিত বিবেচনায় যদিও সুষ্ঠু স্থাপত্যচর্চা এবং চাহিদানুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব রয়েছে, তবুও তরুণেরা এমন সব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করছেন প্রতিনিয়ত। তাঁদের লক্ষ্য পরিবেশ ও জলবায়ুবান্ধব স্থাপনা ও অবকাঠামো গড়ে তুলে দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
তরুণ স্থপতিদের কেউ কেউ কাজ করছেন ভার্টিক্যাল গ্রিনিং (Vertical Greening) নিয়ে। ভার্টিক্যাল গ্রিনিং বর্তমানে টেকসই স্থাপত্যচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ হলেও আমাদের দেশে স্থপতিদের মধ্যে ঠিক সেই অর্থে এখনো এর ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে। এমনকি মালিকপক্ষের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় তা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। তবে আশার কথা, দেশের নামকরা প্রবীণ স্থপতিদের সঙ্গে এখন নবীন স্থপতিরা স্বল্পমূল্যে এর ব্যবস্থাপনার কথা জানাচ্ছেন। তাঁরা চাইছেন এই সব আইডিয়া প্রকল্পে যুক্ত করতে। অনেক সময় হয়তো প্রকল্পে তা যোগ করা সম্ভব হয় না, তবে এটি কিন্তু আশা জাগানিয়া। আজ না হোক, ভবিষ্যতে কংক্রিটের শহরগুলো সবুজে পাল্টে যাবে। এখন দেশে নবীন স্থপতিদের সংখ্যা মোটেও কম নয়। যাঁরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। স্থাপত্যের শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশে এমন সব স্থাপনা নির্মিত হবে, যা কার্বন নির্গমন রোধ করে গাছের মতো কার্বন শোষণ করবে। রক্ষা করবে পরিবেশের ভারসাম্য। এমন স্বপ্ন ফেলনা নয় মোটেই, বরং ভবিষ্যতে যা আমাদের স্বপ্ন দেখায়, অনুপ্রাণিত করে নতুন স্থাপত্য গবেষণায়।

ছোট ছোট এসব স্বপ্নকে আমরা যদি একত্র করতে পারি, তবে নিশ্চিত হবে সবুজ নগরায়ণে আমাদের আগামীর পথচলা। কী নেই আমাদের। স্থাপনা তৈরির উপকরণ উৎপাদনে শক্তির ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার কৌশল, এমনকি যে কংক্রিট দিয়ে আমরা স্থাপনায় দৃঢ়তা আনি, সেই অস্বাদ কংক্রিটকে স্বচ্ছ করে তার মধ্যে আলোর প্রসারও এখন আমাদের হাতের নাগালে আনার চিন্তায় ব্যস্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। শুধু তা-ই নয়, স্থাপনার ভারবহন ক্ষমতা নিজস্ব নির্মাণ উপকরণের ওজন কমিয়ে আরও হালকা করা যায় কীভাবে, সেই প্রযুক্তি নিয়েও ভাবছেন আমাদের দেশের নবীন প্রকৌশলীরা। তবে এত সম্ভাবনা আর প্রাপ্তির মধ্যেও আমাদের কিছু অপ্রাপ্তি আর অপূর্ণতা কাঠিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি আজও। নির্মাণশিল্পে চলছে নানা ধরনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা। আমাদের শ্রমিকেরা যেমন একজন প্রকৌশলী, স্থপতি, নগরপিতার এখনকার স্বপ্নপূরণ করছেন, তাঁদের জন্য আরও ভালো কিছু করা যায় কি না এটিও ভাবতে হবে আমাদেরকেই।
জাপানের হোক্কাইডোতে কর্মরত একজন নির্মাণশ্রমিক, যাঁর বয়স প্রায় ৬৫ ছুঁই-ছুঁই। পরনে ঢিলেঢালা প্যান্ট সঙ্গে ফুলহাতা জামা আর মাথায় হেলমেট। কোমরে বাঁধা বেল্টে রয়েছে অনেক ধরনের জীবন রক্ষাকারী যন্ত্রাংশ। যার হেলমেটের সঙ্গে রয়েছে একটি আলোক প্রক্ষেপণ (টর্চলাইট), পায়ে বুট জুতো ফিতাহীন, সেটি আবার হাঁটু অবধি ঢাকা। হাতে দাস্তানা এভাবেই তিনি প্রায় সব ধরনের নিরাপদ যন্ত্রাংশ নিয়ে সুসজ্জিত। হঠাৎ করে তাঁকে দেখলে মনে হতে পারে কোনো মহাকাশচারী। বিষয়টি কিন্তু তা নয়। আসলে তিনি তাঁর নিরাপত্তা আর প্রয়োজন মেটাচ্ছেন একই সঙ্গে। এসব ব্যবস্থাপনা ছাড়া কোনো শ্রমিক জাপানে কোনো ধরনের নির্মাণকাজে অংশ নিতে পারেন না। আমাদের কাছে বিষয়টি একটু নতুন আর অদ্ভুত বলে মনে হলেও দেশে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী অবস্থান দেশীয় শ্রমিকদের। তদুপরি আমাদের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো এগুলোকে খুব বেশি আমলে নেয়নি আজও। এ নিয়ে লেখালেখি খুব যে কম হয়েছে সেটি নয়। আমাদের মূল সমস্যা আমরা সব বুঝি, সব জানি কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এগুলোর বাস্তবায়ন করি না। যুক্ত করি না মূল ব্যবস্থাপনায়। আর এটিই পিছিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে আমাদের মূল দুর্বলতা। আমাদের দেশের মতো এত কমমূল্যে শ্রম পাওয়ার বিষয়টি বিশ্বে সত্যিই বিরল। তাই নির্মাণশ্রমিকদের জীবনের মূল্য দিয়ে নির্মাণ ব্যবস্থাপনায় তাঁদের সঠিক পন্থায় ব্যবহার করাও আমাদের নগর অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য একান্ত জরুরি বৈকি!

- স্থপতি সজল চৌধুরী
- শিক্ষক, জলবায়ু এবং পরিবেশ গবেষক
- (বর্তমানে জাপানের হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিউম্যান এনভায়রনমেন্টাল সিস্টেম’-এর ওপর গবেষণারত)
[email protected]
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৬