দুর্যোগপ্রবণ এলাকা ঢাকা। বিভিন্ন সময়ে ছোট-বড় আকারের বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্প হয়েছে। এতে ঢাকা অনেকবার ধংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। উপর্যুপরি বন্যায় ঢাকায় অনেকবার দুর্ভিক্ষও দেখা দিয়েছিল। ভূমিকম্প ও ঘূর্ণিঝড়ে আহসান মঞ্জিল, বঙ্গভবন ইত্যাদিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি তো এখনো চোখে ভাসে। প্রায়ই নগরে হানা দেয় ভূমিকম্প। এতে যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ। হরহামেশাই ঘটছে অগ্নিদুর্ঘটনা। আর এখন যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ও ভয়াবহ দাবদাহের প্রভাব। অর্থাৎ ‘এল-নিনো’র প্রভাব। কিন্তু এসব দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য নেই কোনো পরিকল্পনা, নেই উদ্যোগ!
দুর্যোগ মোকাবিলায় দুর্যোগবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও কয়েকটি অধিদপ্তর থাকলেও উল্লেখিত বিভিন্ন দুর্যোগের সময় তারা বরাবরই থাকে নিশ্চুপ। নেই পর্যাপ্ত জনবল ও যন্ত্রপাতি। আবার দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) থাকলেও সেটিও নামমাত্র, সরকারের সব মন্ত্রণালয় বা সংস্থা তা অনুসরণ করে না। ফলে যখনই কোনো দুর্যোগ ঘটে, তখন অন্যান্য বিভিন্ন সংস্থার অসমন্বিত কার্যক্রম চোখে পড়ে। সচরাচর যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সকে প্রথমে ঘটনাস্থলে দৌড়াতে দেখা যায়। আর প্রায় ক্ষেত্রে কিছু সংস্থার লোকজন হাজির হন সাধারণ মানুষের মতো খালি হাতে, আর কিছু সংস্থা তো লোকদেখানোর জন্যই আসে! চলে পরস্পরের মধ্যে দোষারোপের খেলাও! কিন্তু এই অবস্থা তো আর স্থায়ীভাবে চলতে পারে না!

দেশের যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলার দায়িত্ব থাকে মূলত ফায়ার সার্ভিসের ওপর। ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (FSCD) অতঃপর একীভূতভাবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের গঠন হলেও এখনো এর সাংগঠনিক কাঠামো সেভাবে হয়নি! এটি এখনো সাধারণ আমলাতন্ত্রের কাঠামোতে পরিচালিত হচ্ছে, যদিও এর কার্যক্রম মূলত কারিগরি প্রকৃতির। এতে নেই কোনো দক্ষ প্রকৌশলী বা কারিগরি লোকজন। অর্থাৎ ফায়ার অফিসারস, ফায়ার মার্শালস, ফায়ার প্রিভেনশন অফিসারস, স্ট্র্যাটেজিক অফিসারস, টেকনিক্যাল ইনভেস্টিগেটরস ইত্যাদি এবং অগ্নিনির্বাপণকালীন পরিস্থিতি বিশেষ করে জনসাধারণ ও যানজট মোকাবিলার জন্য নিজস্ব কোনো ম্যাজিস্ট্রেটও! এ পর্যন্ত দেশে যত অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে, তার কোনো একটিরও বৈজ্ঞানিক তদন্তও করা হয়নি। ফলে যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিসকে সর্বদা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় এবং উদ্ধার অভিযান বিলম্বিত হয়।
অপর দিকে একই অবস্থা অগ্নিনির্বাপণে পানির উৎস নিয়ে। কারণ যুগ যুগ ধরে ঢাকাসহ দেশের সব শহর এলাকার নিচু ভূমি, পুকুর-দিঘি, খাল-জলাশয় ইত্যাদি ভরাট করে সেখানে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ অর্থাৎ ঘরবাড়ি এবং বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ করে কংক্রিটময় করে ফেলা হয়েছে। এ পর্যন্ত যেখানে যত অগ্নিকান্ড ঘটেছে, তার প্রায় ক্ষেত্রেই পানির সমস্যা হয়েছিল এবং অনেক স্থানে ফায়ার সার্ভিসকে অনেক দূর এমনকি কয়েক মাইল দূর থেকে পানি এনে আগুন নেভাতে হয়েছে। অথচ এ জন্য দেশে শক্তিশালী ইমারত নির্মাণ আইন ও বিধিমালা, অগ্নিনির্বাপণ আইন, পার্ক-মাঠ ও জলাশয় সংরক্ষণ আইন এবং বিল্ডিং কোড ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও এই অবস্থা! আবার পাশাপাশি এসব নিচু জমি যেনতেনভাবে ভরাট করে সেখানে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে ও ক্রুটিযুক্ত ঘরবাড়ি বা ইমারত নির্মাণের কারণে অনেক ইমারত ধসে বা হেলে পড়ছে।

স্বাধীনতার পর যুদ্ধোত্তর পরিস্থতিতে রাজধানী ঢাকায় জনসংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে তখন অভাব ও অব্যবস্থাপনায় দুর্ভিক্ষেরও প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। ১৯৫৯ সালে প্রণীত ঢাকার প্রথম মহাপরিকল্পনা অনুসারে ২০ বছর মেয়াদে নগরীতে জনসংখ্যা হওয়ার কথা ছিল ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখের মতো, কিন্তু দেখা গেল ১৯৮০ সালে ঢাকায় জনসংখ্যা ৩০ লাখের অধিক! আর এখন তা ২ কোটির বেশি। সে সময় ঢাকার ঘরবাড়ি ছিল সর্বোচ্চ এক-দুই-তিনতলাবিশিষ্ট এবং প্রায় সব বাসাবাড়ি প্রাঙ্গণেই ছিল গাছগাছালি এবং সবুজায়নে ভরা। আর এখন সবকিছুই বদলে গেছে! নগরীর সর্বত্রই গায়ে গায়ে লাগানো উঁচু ইমারত এবং পুরো প্লট/জমিজুড়েই ইমারত এবং প্রায় সর্বত্রই বাণ্যিজিকীকরণের প্রভাব! এতে বর্তমানে নগর পরিবেশ খুবই উত্তপ্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। পরিবেশ ও নগরবিদদের অনেকে তো বর্তমান ঢাকাকে একটি ‘তপ্ত দ্বীপ’ বা হিট আইল্যান্ড হিসেবেও বলছেন!
এই নিয়ে অর্থাৎ ক্রুটিযুক্ত ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত নির্মাণের জন্য অনেকেই রাজউকের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন ইত্যাদিকেও সমভাবে দায়ী করেন! কারণ, একদিকে ঢাকার যেকোনো স্থানে ইমারত নির্মাণের অনুমোদনের জন্য এসব সংস্থাগুলোর পেছনে অনেক টাকা খরচ করতে হয়, অন্যদিকে কোনো একটা ইমারতের অনুমোদন পাওয়ার পর এসব সংস্থাগুলো কোনো লোকজন তাদের অনুমোদিত নকশা ও ছাড়পত্রের শর্তানুযায়ী ইমারত নির্মিত হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য সাইটে যায় না। গেলেও তা লোকদেখানো। ফলে বাস্তবে এভাবে নির্মিত প্রায় ইমারতই ক্রুটিযুক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়!
স্বাধীনতার পর অনেক পরে নগর উন্নয়ন আইনে সংশোধন ব্যতিরেকে ১৯৯৫ সালে স্ট্রাকচার প্ল্যান ও ড্যাপ বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে, কিন্তু এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজউকে ছিল না দক্ষ নগর পরিকল্পনাবিদ ও আর্থিক সামর্থ্য। ফলে কার্যত এই পরিকল্পনাগুলোর কোনোটিরই বাস্তবায়ন হয়নি। ২০২২ সালে আবারও একইভাবে নগর উন্নয়ন আইনে সংস্থান না থাকা সত্ত্বেও বিএনবিসি ছাড়াই ড্যাপ তৈরি, অনুমোদন ও গেজেট হয়ে যায়। সে থেকে আবার এই প্ল্যানের বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে এর বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারসের মধ্যে সমালোচনাও শুরু হয়, যা নিরসনে কমিটি গঠিত হয়ে এই ড্যাপটি আটকে আছে! এই অবস্থায় ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান এবং ড্যাপ অনুযায়ী বাস্তবায়িত হচ্ছে না বললে ভুল হবে না!
এখানে উল্লেখ্য, মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকায় ইমারতের নকশা অনুমোদনের দায়িত্ব রাজউকের ওপর। কিন্তু এ পর্যন্ত ডিআইটি পরে ঢাকায় কত নকশা অনুমোদিত ও ইমারত নির্মিত হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান রাজউকে সংরক্ষিত নেই! তবে আগে নিয়ম/বিধি ছিল- প্রতিটা প্লটে ইমারতের চারপাশে পর্যাপ্ত জায়গা ছাড়ার এবং সেখানে গাছ লাগানোর, যা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। কিন্তু পরে নির্মাণশিল্পে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের আবির্ভাব এবং এতে জমির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে ইমারত নির্মাণ ও আবাসন ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এর কারণে প্লট/জমির মালিকদের লোভ-লালসাও অনেক বেড়ে যায়। কেউ কেউ তো একে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীমহল বিশেষ করে স্থপতিদের মধ্যে একধরনের নেক্সাস বা পরস্পরের যোগসাজশ বলেও দায়ী করছেন! এ জন্য অবশ্যই ইমারতের নকশা অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ (রাজউক) তথা ঢাকা সিটি করপোরেশনও সমভাবে দায়ী। কারণ তাদের দুর্বলতা বা অক্ষমতায় ঢাকার সর্বত্র যা ইচ্ছে তা-ই ইমারত নির্মাণ ও ব্যবহার করা হচ্ছে! এভাবে আজ পুরো ঢাকা মহানগরীই একটি অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থান এবং ঝুঁকিপূর্ণ নগরীতে পরিণত হয়েছে।
আশির দশক থেকে ঢাকায় ক্রুটি ও ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত নির্মাণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে ১৯৯১ সালে এ-সংক্রান্ত জাতীয় টাক্সফোর্সের সুপারিশের প্রেক্ষিতে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ও অর্থায়নে জাতীয় বিল্ডিং কোড অর্থাৎ বিএনবিসি-১৯৯৩ প্রণীত হয়। পরে এটি সংশোধিত হয়ে ২০০০ সালে অনুমোদিত হয়। কিন্তু অদ্যাবধি এটির কার্যকরণে কোনো প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়নি। এই পর্যন্ত অনেক ইমারত ধসে পড়ে, বিশেষ করে সাভারে ‘রানা প্লাজা’ ধসে পড়ে প্রায় ১ হাজার ৩০০ শ্রমিকের মৃত্যুর পরও। উল্লেখ, উদ্ধারকাজে সমন্বয়হীনতার কারণেই রানা প্লাজাধসের এক মাসের চেয়ে বেশি সময় লেগেছিল ওই দুর্যোগ মোকাবিলায়। এর ফলে জরুরি ভিত্তিতে বিএনবিসি কোডটির কার্যকরণের জন্য উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনাও আসে। কিন্তু আজ অবধি এটির কার্যকরণে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়নি। অর্থাৎ একটি বিল্ডিং কোড থাকা সত্ত্বেও তা এখনো অফশনাল ডকুমেন্ট হিসেবেই রয়ে গেছে।

আইন অনুযায়ী যেকোনো কিছু বা নির্মাণসামগ্রী দিয়ে তৈরি করা যেকোনো কিছু, ইমারত ও অবকাঠামোকে ‘ইমারত’ বলা হয়। রাজধানী ঢাকার ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মোতাবেক নগর পরিকল্পনার আলোকে কোনো বসবাস বা ব্যবহারযোগ্য জমির মালিকানার প্রমাণসহ যথানিয়মে রাজউকের কাছ থেকে এর ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র (প্ল্যানিং পারমিট) গ্রহণ এবং তালিকাভুক্ত পেশাজীবীদের দ্বারা প্রস্তাবিত ইমারতের স্থাপত্য ও কারিগরি ডিজাইন তৈরি ও অনুমোদন করিয়ে (বিল্ডিং পারমিট গ্রহণ করেই) উপযুক্ত নির্মাণসামগ্রী দ্বারা এবং কারিগরি লোকজনের তত্ত্বাবধানে যেকোনো ধরনের ইমারত নির্মাণ করা বাধ্যতামূলক। সে সঙ্গে যেকোনো ইমারতের নির্মাণকালে সর্বপর্যায়ে বিল্ডিং কোড, ফায়ার কোড ইত্যাদিসহ অপরাপর বিধিবিধান অনুসরণ করাও বাধ্যতামূলক। এভাবে নির্মিত কোনো একটি ইমারতকে ‘প্রকৃত ইমারত’ বলা যায়।
কিন্তু এখন যেনতেনভাবে ইমারত নির্মিত হচ্ছে। অর্থাৎ অনেকে রাজধানী ঢাকায় বসবাস করেও এর আইনকানুন ও বিধিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে এবং অনেকাংশে অনুমোদন না নিয়েই ইমারত নির্মাণ হচ্ছে। আবার যারা অনুমোদন নিয়ে ইমারত নির্মাণ করে, তাদের বেশির ভাগও প্রায় ক্ষেত্রে অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে সমতলে ও ঊর্ধ্বমুখী ইমারতের সম্প্রসারণ করে এবং কারিগরি লোকজনের অনুপস্থিতিতে ইমারত নির্মাণ করেছে ও করে চলেছে। এভাবে অনেকে ইমারতের বহির্দেয়ালে রকমারি গ্লাস লাগিয়েও ইমারতকে ঝুঁকিপূর্ণ করে চলেছে। একইভাবে অনুমোদিত অভ্যন্তরীণ ডিজাইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েও নিজেদের ইচ্ছেমতো ইমারত নির্মাণ এবং অনাবাসিক ব্যবহার করে এমনকি বেসমেন্ট ফ্লোরসও (যা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য নির্মিত) অন্য কাজে ব্যবহার করা যেন একটা নিয়মেই পরিণত হয়ে গেছে!
ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও বিল্ডিং কোড অনুসরণে যথাযথভাবে ইমারত নির্মাণ শেষে অথবা ইমারতের আংশিক নির্মাণ করে তা ব্যবহার করা বা ভাড়া দেওয়ার আগে নকশা অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ থেকে ইমারতের বসবাসযোগ্য সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রেও খুবই কমসংখ্যক ইমারতের মালিক/রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান এই সনদ গ্রহণের আবেদন করেন। এর প্রধান কারণ হলো, যথাযথভাবে অর্থাৎ অনুমোদন মোতাবেক ইমারত নির্মাণ না করা, বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা ইত্যাদি। প্রকৃত অর্থে, এ ধরনের প্রায় ইমারতই কমবেশি বিভিন্ন মাত্রায় ‘ক্রুটিযুক্ত’ ও ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচিত! এতে বড় সমস্যা দেখা দেয়। যদি কখনো কোনো কারণে এসব ইমারতে আগুন লাগে, বিস্ফোরণ ঘটে বা ধসের সৃষ্টি হয়। কারণ, তখন তাৎক্ষণিকভাবে এসব ইমারতের অনুমোদনের তথ্য অর্থাৎ অনুমোদিত নকশার কপি পাওয়া যায় না। একইভাবে এসব প্রায় ইমারতের Structural & MEP As-Built Drawings তথা অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা এবং অগ্নিপ্রতিরোধের তথ্যাবলিও মেলে না। ফলে কোনো একটা দুর্ঘটনার পর এক মহাদুর্যোগের সৃষ্টি হয়ে বসে।
এভাবে বিশেষ করে ঢাকার অপরিকল্পিত এলাকায় প্রায় ইমারতের নিচ দিয়ে প্রবাহিত পয়ঃপ্রণালি ও গ্যাসের লাইনের কারণে এবং লিকেজও আরেকটা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে! প্রথমত, খুব কম ক্ষেত্রেই এসব সার্ভিসেস লাইনের As-Built Drawings সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে সংরক্ষিত আছে। দ্বিতীয়ত, এসব সার্ভিসেসের দুর্বলভাবে রক্ষণাবেক্ষণ এবং আনাড়িভাবে সংযোগের কারণেও অনেক স্থানে বিস্ফোরণেরও সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিককালে যা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটিতে ফ্লাইওভার নির্মাণকালে এবং এর আগে নারায়ণগঞ্জের একটি মসজিদে, ফুলবাড়িয়ার সিদ্দিকবাজারে একটি ইমারত ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়সহ আরও অনেক জায়গায়। অনুরূপ এখনো অনেকে বিভিন্ন নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে ও দুর্বল ফাউন্ডেশনে এবং নিজ নিজ তত্ত্বাবধানে নিজেদের ঘরবাড়ি বা ইমারত নির্মাণ করে থাকেন, যেখানে ভাঙা/বর্জ্য মালামাল ব্যবহার এমনকি দাহ্য পদার্থ দিয়েও ইমারত নির্মাণ করা হয়। আর এতে এসব সার্ভিস লাইনসের ত্রুটির কারণে যখন তখন বিস্ফোরণ ঘটা ও ইমারত ধস একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এভাবেই ইদানীং প্রায়ই ঢাকায় সৃষ্টি হয় নানা সমস্যা ও দুর্যোগ! এর পেছনে আরেকটা বড় কারণ হলো সচরাচর বড় বা ভালো কন্ট্রাকটর বা ডেভেলপাররা অনুমোদিত ডিজাইন অনুসারে এবং গুণগতমান বজায় রেখে মোটামুটি ভালো ইমারত নির্মাণ করার চেষ্টা করে থাকেন, কিন্তু যারা ছোট ঠিকাদার বা ওয়ান-টাইম ডেভেলপার বা যারা নিজেরা ইমারত নির্মাণ করেন, তারা খুব কম ক্ষেত্রেই অনুমোদিত নকশা এবং যথাযথ নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার ও বিল্ডিং কোড মেনে গুণগতভাবে ভালো ইমারত নির্মাণ করে থাকেন! আবার অনেকে নির্মাণকালে নির্মাণসামগ্রীর ওভারলোডিংও করে বসেন, যার কারণে তেজগাঁও এলাকায় ফিনিক্স ভবনের সংস্কারকালে আকস্মিক ইমারতটি ধসে পড়ে অনেক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। এ ধরনের দুর্ঘটনা ও দুর্যোগ এখন ঢাকায় নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এভাবে নগরীর যত্রতত্র ও যেনতেনভাবে বিভিন্ন মার্কেট/ইমারত কমপ্লেক্স বা স্থাপনা নির্মাণ- যেমন গাউছিয়া ও চাঁদনী চক, মৌচাক, বঙ্গবাজার, রাজধানী সুপার, নীলক্ষেত, ঠাটারীবাজার মার্কেট ইত্যাদি করার পর এগুলোর অপব্যবহার আরেকটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে প্রায়ই এসব স্থাপনায় আগুন লাগা বা আকস্মিক ধস ঘটে বসে, যা সাম্প্রতিককালে ঢাকার অনেক স্থানেই ঘটেছে। গত কয়েক বছরে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের অনেক দুর্যোগ ঘটেছে, যা আমরা দেখেছি- বঙ্গবাজার মার্কেটে আগুন, মগবাজার নিউ সার্কুলার রোড, ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট ও সর্বশেষ বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের অগ্নিকান্ড।
সব মিলে বর্তমানে ঢাকায় এ ধরনের কতসংখ্যক ত্রুটিপূর্ণ তথা ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত বা স্থাপনা আছে, তার কোনো সঠিক সংখ্যা এবং পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। সে সঙ্গে নেই বিভিন্ন সংস্থার অধীনে সংগৃহীত ভারী যন্ত্রপাতির বিবরণও। এতে প্রায়ই উদ্ধারকাজে সমস্যা দেখা দেয়! ভারতের ভূজ আর্থকোয়েকের পর দেশে কত ভারী/উদ্ধার যন্ত্রপাতি আছে, তা জরিপ করার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাও পরে থেমে যায়। আবার এসব তথ্য একেক সংস্থার মতে একেক রকম এবং এ নিয়ে পরস্পরের মধ্যে দোষারোপের খেলাও চলমান রয়েছে! রাজউকের দৃষ্টিতে অবৈধভাবে ও অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত ইমারতই ত্রুটিপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ এবং পুরো ঢাকা মহানগরজুড়ে এ ধরনের ইমারতের সংখ্যা কয়েক লাখের কম নয়! সিটি করপোরেশনের মতেও এই সংখ্যা অনেক, যদিও তাদের সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানমতে, ঢাকায় বর্তমানে ৪৫০টির মতো ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট ও অন্যান্য স্থাপনার কথা বলা হয়েছে! একই অবস্থা ফায়ার সার্ভিসেসের দৃষ্টিকোণ থেকেও! কিন্ত কোনো সংস্থার কাছেই রাজধানী ঢাকায় সঠিক ঝুঁকিপূর্ণ ইমারতের তালিকা এবং এসবের যথাযথ কারিগরি তথ্য সংরক্ষিত নেই।

তবে আইন অনুসারে ঢাকা মহানগর এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত বা স্থাপনা চিহ্নিতকরণের দায়িত্ব কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওপর। কিন্তু তাদের স্বপ্রণোদিত হয়ে কখনো নগরীর কোথাও কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ইমারতের তালিকা তৈরি, অপসারণ বা ভাঙার রেকর্ড নেই! অনুরূপ ফায়ার সার্ভিসেসের মতে, ২০২২ সালে তাদের পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুসারে ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন, শিল্প-কলকারখানা ইত্যাদির সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩০০টির মতো, যদিও বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। পাশাপাশি সরকারের শিল্প উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বহুপক্ষীয় জাতীয় কমিটির মতে, এই সংখ্যা কয়েক হাজার। আবার কয়েক বছর আগে (আশপাশের দেশে ঘন ঘন ভূকম্পনকে কেন্দ্র করে) বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের ঈউগচ প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত এক সমীক্ষা মতে, ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ইমারতের সংখ্যা ৭২ হাজারের মতো!
আশ্চর্যের বিষয় হলো, দেশের বিভিন্ন স্থানে ভালোভাবে নির্মিত কিছু ইমারতেও অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে, যা ঘটেছে গত কয়েক বছর ধরে। কারওয়ান বাজারের বিএসইসি ভবন, পান্থপথে বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স, বনানীর এফ আর টাওয়ার বা গুলশানের একটি অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট বাসায়। এই ইমারতগুলোতে আগুন লাগার পর অগ্নিনির্বাপণের দায়িত্বে থাকা ফায়ার সার্ভিসেসের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ করা হয় যে এই ইমারতটি ক্রুটিপূর্ণভাবে নির্মিত হয়েছে, যেখানে ফায়ার এক্সিট ও ফায়ার অ্যালার্ম নেই, হাইড্রেন্ট নেই ইত্যাদি আরও অনেক কিছুর ঘাটতি রয়েছে! অপর দিকে রাজউক থেকে বলা হয়, এটি একটি অত্যাধুনিক ইমারত এবং ইমারতটির ব্যবহারের আগে এটির বসবাসযোগ্য সনদও নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখানেও পরস্পরের মধ্যে দায় এড়ানোর খেলা চলমান!
প্রসঙ্গক্রমে, ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে নগরীতে আরও যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় প্রতিটির ওপর একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল, কিন্তু কখনো কোনো তদন্ত কমিটির ফাইন্ডিংস, সুপারিশ ইত্যাদি আজ অবধি স্পষ্টভাবে কোনো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। সর্বশেষ বেইলি রোডের অগ্নিকান্ডের ঘটনায় যে ভয়াবহ অঘটন ঘটেছে, তারও কোনো পরিষ্কার বিবরণী বা ফাইন্ডিংসও পাওয়া যায়নি! রাজউক তদন্ত করে নিজেকে দায়মুক্ত করার চেষ্টা করেছে। অনুরূপ কখনো এ ধরনের কোনো একটা অগ্নিকান্ডের অপরাধে FSCD থেকে ইমারতের মালিক বা ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও শোনা যায়নি! পুরান ঢাকার নিমতলী এবং চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ২০০-২৫০ জনের মতো মানুষ মারা যাওয়ার পরও ওই দুটি তদন্তের FSCD-এর রিপোর্ট আজ অবধি আলোর মুখ দেখেনি। ওই অগ্নিদুর্ঘটনার পর পুরান ঢাকা থেকে সব কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ও গোডাউন ঢাকার বাইরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যা আজও কার্যকর হয়নি। বরং অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে এসব পুড়ে যাওয়া ইমারত ও স্থাপনায় পুনরায় প্লাস্টার করে ও রং/ডিসটেমপার মেখে সেখানে আবারও বসবাস এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বা অফিস-আদালত শুরু করা হয়েছে।
তবে কিছুটা ভিন্ন অবস্থা বনানীর ‘এফ আর টাওয়ারের’ ক্ষেত্রে। এই ২৩ তলা ভবনটিতে আগুন লেগে ২৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়। এর পর থেকে এই ভবনটিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়। এই ভবনটির নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন দেশের একটি বিখ্যাত ডেভেলপার গ্রুপ (!) এবং সংগতকারণে তাদের অব্যবস্থাপনার কারণেই এই ভবনটিতে আগুন লাগে এবং জানমালের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলেও পুলিশের তদন্তে প্রভাবশালী নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে দায়ী না করে এই প্লটটির মালিক ও কতিপয় ফ্লোর ক্রেতা/ভাড়াটেকে দায়ী করে পুলিশ তাদের চার্জশিট প্রদান করে! নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ‘হাসিম ফুড ইন্ডাস্ট্রিজে’ অগ্নিকান্ডে অনেক শ্রমিক নিহত হলেও এর মালিকপক্ষ সরকারদলীয় ছিল বিধায় তাদের ওই অগ্নিকান্ডের দায় থেকে পুলিশি তদন্তেই অব্যাহতি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে সাম্প্রতিককালে বেইলি রোডের অগ্নিকান্ডের পর এই ভবনটির ডেভেলপার ও এতে ব্যবসায়ে নিয়োজিত কয়েকজন রেস্টুরেন্টের মালিককেও সেফ-এক্সিট করে দেওয়ার কথাও শোনা গেছে!!
ঘরবাড়ি ও ইমারতে আগুন লাগা বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটা কোনো নতুন বিষয় নয়। বিভিন্ন কারণে বিশ্বের সর্বত্র (উন্নত ও অনুন্নত সব দেশেই) এমনকি সম্পূর্ণভাবে সুপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ইমারত এবং স্থাপনায়ও আগুন লাগে এবং ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। তবে প্রতিটি অগ্নিকান্ডের ক্ষেত্রে কীভাবে আগুনের সূত্রপাত ঘটল, কীভাবে আগুন ছড়িয়ে পড়ল, কত জানমাল ক্ষতিগ্রস্ত হলো ও পরবর্তী করণীয় এসব বিষয় পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমাদের দেশে আজ অবধি এই সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি! কোনো দুর্ঘটনার তদন্ত-উত্তর এসব তথ্য আর জানা বা পাওয়াই যায় না! ইতিপূর্বে ঢাকা মহানগরী এলাকায় তথা দেশজুড়ে আরও যেসব ইমারত ও স্থাপনায় আগুন লেগেছে, তার সব ইমারতই যে ত্রুটিপূর্ণভাবে ডিজাইনে নির্মাণ করা হয়েছে, তাও ঠিক নয়!
কারণ, ইদানীং যেকোনো ইমারতের উল্লেখযোগ্য অপব্যবহার হলো- ইমারতে বেসমেন্ট নির্মাণ করে তা অন্য ব্যবহারে নিয়ে যাওয়া অর্থাৎ দোকান, গোডাউন ইত্যাদিতে পরিণত করা। একইভাবে কমবেশি সব অ্যাপার্টমন্ট বা অফিস স্পেসে নানা ধরনের অতিরিক্ত বা মাত্রাতিরিক্ত বৈদ্যুতিক কাজসহ অপ্রয়োজনীয় ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা, যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে ইমারতের স্থাপতিক ও MEP (মেকানিক্যাল-ইলেকট্রো ও প্লাম্বিং) কাজের। কিন্তু এসব কাজ যথাযথ ব্যবস্থাপনায় ও উপযুক্ত নির্মাণসামগ্রী দিয়ে এবং অগ্নিপ্রতিরোধকভাবে করা হচ্ছে বা হয়েছে কি না তা পর্যবেক্ষণ এবং সনদ প্রদান বা প্রত্যয়ন করার জন্য দেশে এখনো কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এমনকি রাজধানী ঢাকায়ও এসব কাজের পর্যবেক্ষণ ও তদারকির জন্য আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান নেই! ফলে পরস্পরের (আন্তসংস্থার মধ্যে) দোষারোপের খেলায় দিনে দিনে এই বিষয়টি একটি জটিলতর রূপ নিচ্ছে। যদিও রানা প্লাজাধসের পর বিদেশি ক্রেতাগোষ্ঠীর চাপে দেশের কমবেশি সব আরএমজি (গার্মেন্টস শিল্পে) ভবন/স্থাপনার নিরাপত্তা ও পরিবেশের উন্নয়নে দেশি-বিদেশি পেশাজীবী মহল/উপদেষ্টাদের তত্ত্বাবধানে অনেক কাজ হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে সার্বিকভাবে দেশের আরএমজি স্থাপনাগুলো অনেকটা টেকসইও বলা যায়!
বর্তমানে ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল ও প্লাম্বিং ডিজাইন তো যেকোনো ইমারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক, বিশেষ করে ইলেক্ট্রিক্যাল সিস্টেমের ডিজাইন ইমারতের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা এবং মঙ্গল নিশ্চিত করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ন্যাশনাল ফায়ার প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশন (NFPA)-এর মতে, ইলেক্ট্রিক্যাল কাজের ত্রুটি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবাসিক ভবনে আগুনের দ্বিতীয় প্রধান কারণ। দৃশ্যত বাংলাদেশেও অগ্নিকান্ডের অন্যতম কারণ হলো বৈদ্যুতিক গোলযোগ অর্থাৎ ইলেক্ট্রিক্যাল শর্টসার্কিট, তার গলে যাওয়া, অব্যবস্থাপনার ত্রুটি ইত্যাদি। বাস্তবে বিভিন্ন কারণে এসব হয়। যেমন- পরিকল্পিতভাবে MEP প্ল্যানিং না করা, ত্রুটিপূর্ণ তার ও সুইচ স্থাপন করা এবং দুর্বল ইলেক্ট্রিক্যাল সরঞ্জাম লাগানো, যা সঠিকভাবে ইনস্টল ও রক্ষণাবেক্ষণ না করার দরুন। একটি সুপরিকল্পিত ইলেক্ট্রিক্যাল ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ এই বিপদগুলো অনেকাংশে প্রতিরোধ করতে এবং ইমারত ও এর বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
অনুরূপ যেকোনো পুরোনো ইমারত ভাঙা বা ধসে যাওয়া ইমারত ভাঙার বিষয়াদি মনিটরিং করার জন্য ভিন্নভাবে একটি সমন্বিত ডেমোলিশন ইউনিট বা অথরিটি প্রতিষ্ঠারও প্রয়োজন। কারণ, বাস্তবে ইমারত নির্মাণের চেয়ে ভাঙা খুবই কঠিন ও জটিল কাজ এবং এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে অনেক মানুষজন মারা যায়।

এই অবস্থায় দুর্যোগ সহনশীল ইমারত নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত চিহ্নিতকরণ এবং সম্ভ্রাব্য যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলার লক্ষ্যে নিম্নােক্ত বিষয়গুলোর বাস্তবায়নসহ তা নিয়মিত মনিটরিংয়ের প্রয়োজন। যেমন-
- অনতিবিলম্বে বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) এনফোর্সমেন্ট অথরিটি প্রতিষ্ঠা করা এবং তদঅধীনে ঢাকায় ইমারতের নকশা অনুমোদনের কার্যক্রম পরিচালনা করা।
- ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরকে দক্ষ ও কারিগরি লোকজনের সমন্বয়ে যথোপযুক্ত যন্ত্রপাতির মাধ্যমে অধিকতর শক্তিশালী করা।
- নিরাপদ ইমারত নির্মাণে স্থাপত্য নকশার পাশাপাশি ইমারতের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। এ ক্ষেত্রে স্ট্রাকচারাল ডিজাইন পরীক্ষার জন্য ‘থার্ড পার্ট’কে নিয়োজিত করা যায়।
- এতদবিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব সামরিক-বেসামরিক সংস্থার সমন্বয়ে একটি লিড এজেন্সির নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের এক বা একাধিক স্থায়ী কমিটি গঠন করা, যার যৌথ নেতৃত্বে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা সহজে মোকাবিলা করা যায়।
- বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণে নগরীর সব ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত চিহ্নিতকরণ এবং পর্যায়ক্রমে সেগুলোকে অঝুঁকিপূর্ণ করা বা ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা করা।
- ইমারত নির্মাণের চেয়ে ভাঙা খুবই কঠিন ও জটিল বিষয়। এ জন্য রাজউক বা সিটি করপোরেশনের অধীনে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ডেমোলিশন ইউনিট বা আলাদা একটি অথরিটি প্রতিষ্ঠা করা।
- ঢাকা তথা দেশের বিভিন্ন সংস্থার অধীনে মজুতকৃত সব ভারী যন্ত্রপাতির ভেটাবেইস তৈরি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। সে সঙ্গে ঢাকায় অনুমোদিত ও অননুমোদিত ইমারত এবং ব্যবহার, ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত ও স্থাপনার তালিকা, উদ্ধার যন্ত্রপাতির বিবরণ ইত্যাদির ওপর বিআইএম (বিল্ডিং ইনফরমেশন মডেলিং) আকৃতির ডেটাবেইস) তৈরি করা।
- নগর উন্নয়ন আইনের যথাযথ সংশোধন ও সংস্থান করেই ঢাকার স্ট্র্যাকচার প্ল্যান ও ড্যাপ প্রণয়ন করা উচিত, অন্যথায় এই পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন হবে না।
- বর্তমানে জনঅধ্যুষিত ঢাকার কোথাও কোনো ওয়াটার হাইড্রেন্ট নেই এবং পুকুর-খালও ভরাট হয়ে গেছে। ফলে অগ্নিনির্বাপণে খুবই সমস্যা হয়। তাই নগরীর জনঅধ্যুষিত এলাকায় পুকুর খনন এবং ওয়াটার হাইড্রেন্ট বসানোর ব্যবস্থা করা।
- সে সঙ্গে ঢাকার ওপর থেকে জনসংখ্যা তথা ইমারত/স্থাপনা নির্মাণের চাপ কমানোর লক্ষ্যে নগরীয় অনেক কিছু বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজন। এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকারকেই ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাজধানী থেকে অবিলম্বে বিকেন্দ্রীকরণ শুরু করতে হবে।
এ বিষয়ে আশার সংবাদ হলো, সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় রাজউক ও সংশ্লিষ্ট অপরাপর সংস্থার অধীনে Urban Resilience Project (URP) শীর্ষক নামের একটি প্রকল্পের আওতায় কিছু সমীক্ষা ও কেস স্টাডি হয়েছে। আমি নিজেও এই কাজটির সঙ্গে কিছুদিন সংযুক্ত ছিলাম। এই প্রকল্প থেকে ঢাকার Urban Safety & Resilience-এর ওপর অনেক সুপারিশ দেওয়া হয়, কিন্তু বাস্তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের আন্তরিকতার অভাবে এসব সুপারিশমালার কার্যকরণ এখনো শুরু হয়নি! সত্যিকার অর্থে, যেই আগ্রহ ও উদ্যোগ নিয়ে এই প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছিল, সেভাবে এটি সম্পন্ন বা শেষ হয়নি! তবে ঢাকার বর্তমান অবস্থার বিবেচনায় এই প্রকল্পের সুপারিশসমূহের বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।
কারণ, এই প্রকল্পের আওতায় বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় (র্যাপিড ভিজ্যুয়াল ইন্সপেকশান অ্যান্ড প্রিলিমিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং টেস্টের মাধ্যমে) ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের ৫ হাজারের বেশি ইমারত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়েছে। তন্মধ্যে কিছু ইমারতের প্রিলিমিনারি ডিটেইলড ইঞ্জিনিয়ারিং টেস্টও করা হয়েছে। সে অনুসারে এসব ইমারতের কোনটি কোন মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ এবং এগুলোকে প্রয়োজনীয় strengthening/retrofitting করে ঠিক করা প্রয়োজন, তারও তালিকা করে দেওয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে ঢাকার কোনো এলাকার মাটিতে বহুতল ইমারত বা বড় স্থাপনা নির্মাণযোগ্য তাও বিভিন্ন ধরনের মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, কিন্তু এই কাজটিও এখনো পরিপূর্ণভাবে শেষ হয়নি! অন্যদিকে এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়াকে উন্নত (ডিজিটাইজেশন) করার জন্য Electronic Construction Permitting System (ECPS) বিষয়ের যেসব সফটওয়্যার তৈরি করা দেওয়া হয়েছে এবং সে সঙ্গে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার খসড়া প্রণয়ন করে এবং প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার সংগ্রহ করে তা রাজউকে জমা দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া বিএনবিসির ধারাবাহিক সংশোধন ও কার্যকরণ বিষয়েও কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।
তা ছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় রাজউকের মহাখালী (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের উল্টো দিকে) অফিস প্রাঙ্গণে ১০ তলাবিশিষ্ট একটি বিশেষায়িত বহুতল দপ্তর ভবনও নির্মিত হয়েছে, যেটিকে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখিত যাবতীয় সমন্বিত কার্যক্রম আরবান (সেফটি অ্যান্ড রেসিলেন্স) পরিচালনার সদর দপ্তর ও মনিটরিংয়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলাম
প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৮ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০২৪