ঢাকার নগরায়ণের দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও কখনো এই নগরী পরিকল্পিত ছকে বিকশিত হয়নি। পরিকল্পনা-প্রস্তাবনা ও বাস্তবায়নে রয়েছে বরাবরের গরমিল। দৃশ্যত কোনো উন্নয়ন প্রকল্পই মূল পরিকল্পনা মোতাবেক বাস্তবায়িত হয়নি। নগরীর বেশির ভাগ সড়ক নেটওয়ার্ক আঁকাবাঁকা এবং অনেক ক্ষেত্রে সংকুচিত (Bottle-neck)। কিছু গুরুত্বপূর্ণ সড়ক তো হঠাৎ করেই থেমে গেছে, অথচ মহাপরিকল্পনায় এসব সড়ক নেটওয়ার্ক সোজাসুজি ও পর্যাপ্ত চওড়ায় দেখানো আছে। তার মধ্যে নামবদলের অপসংস্কৃতিতে নগরীর কোন সড়কটি কখন নির্মিত হয়েছে, তাও নতুন প্রজন্মের জানার অবকাশ নেই। এর পেছনে প্রধান কারণ একদিকে যেমন যথোপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অভাব, অন্যদিকে তেমনি ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন বিশেষ করে Liberal Policy of Industrialization, অস্বাভাবিক জনস্ফীতি, পরিসংখ্যান কিংবা তথ্যের অভাব, উন্নয়নে সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনা। তা ছাড়া ভ‚মি অধিগ্রহণে জটিলতা, অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দ, উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় Top Down Approach, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দৌরাত্ম্য তো আছেই। আর আমাদের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীরা যা কিছু প্রস্তাব করুন না কেন, তাতে কিছু আমলারা (নিজেদের জাহির করা বা দাপট দেখাতে) কম-বেশি কাটছাঁট করবেনই। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে কিছু প্রকল্পের সম্পূর্ণ লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যও বদলে যায়। কোনো প্রকল্পই নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়িত হয় না।
ঢাকার বিকাশমান ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ‘বায়ান্ন বাজার তেপান্ন’ গলির শহর বলে পরিচিত প্রাক্-মোগল এবং মোগল ঢাকার উন্নয়ন ছিল স্বতঃস্ফ‚র্ত। আর কোম্পানি ও ব্রিটিশ আমলে যা ছিল অবহেলিত। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে অনিয়ন্ত্রিত। দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতা অর্জনের ৪৫ বছর পর আজও প্রায় সবকিছু চলছে সেই একইভাবে বরং অধিকতর অসমন্বিতভাবে, আমলাতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে। ফলে নগরবাসীর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি মিলছে না। বিভিন্ন সময়ে পরিকল্পিতভাবে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয়েছে, তারও কোনোটির যথাযথ ও পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি, যার কারণে দিনে দিনে ঢাকার নগরজীবন হয়ে পড়ছে আরও সমস্যাসঙ্কুল। অথচ এই দীর্ঘ সময়ে নগরীর পরিধি বেড়েছে, উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে, নগরীর উন্নয়নের সঙ্গে অনেক সংস্থার সম্পৃক্ততা ঘটেছে কেবল বাড়েনি সেবার মান। বরং কমেছে সড়ক ও খোলা জায়গার পরিসর, উধাও হয়ে গেছে একদা ঢাকার গর্বের অসংখ্য খাল-নালা-ঝিল ও বিস্তীর্ণ জলাভূমি, চলছে সমন্বয়হীন উন্নয়ন। বেড়েছে অবৈধ নির্মাণ ও দখলের প্রবণতা। এমনকি নগরীর বিভিন্ন স্থানে সংরক্ষিত কার পার্কিং স্পেস, বর্জ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জায়গাগুলোও বেদখল বা অন্য ব্যবহারে চলে গেছে। পাশাপাশি ক্রমবর্ধিষ্ণু বিভিন্ন ইউটিলিটি সার্ভিসেসের স¤প্রসারণে সমগ্র নগরে সারা বছর চলে খোঁড়াখুঁড়ি, যাতে সর্বস্তরের নাগরিকদের ভোগান্তিসহ সার্বিক নগর পরিবেশ বিপর্যস্ত হয় বলাই যায়। সবমিলে বর্তমানে অবস্থা এমনই যে বৃষ্টি না হতেই জলাবদ্ধতা আর ভয়াবহ যানজটে নগরজীবন এখন অচল ও অবরুদ্ধপ্রায়। এই অবস্থায়, বৈশ্বিক মাপকাঠিতে রাজধানী ঢাকাকে একটি ‘বসবাস অযোগ্য’ নগরী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

অথচ ঢাকা বিশ্বের পুরোনো শহর বা স্থাপনার একটি। প্রাক্-ঐতিহাসিক আমলে ঢাকার বিভিন্ন ধরনের প্রাচুর্যে আকৃষ্ট হয়ে এখানে অনেক রাজাধিরাজের শাসন চলেছে, হয়েছে ক্ষমতার যুদ্ধ ও পটপরিবর্তন। রাজা বিক্রমাদিত্য, কামরুপের বৌদ্ধরাজ ও তুঘলগী (মুসলিম) সাম্রাজ্যের মধ্যে ঢাকার কর্তৃত্ব দখল নিয়ে যুদ্ধ-বিগ্রহের রয়েছে অনেক কাহিনি। ১৬০০ শতাব্দীর শুরুতে মোগলরা আসার আগে এখানে তুর্ক-আফগান-পর্তুগিজ-ওলন্দাজ (ডাস)-ফরাসি-গ্রিক বণিকদেরও আনাগোনা ছিল, যার কিছু স্মৃতি-বিস্মৃতি এখনো নগরীর বিভিন্ন স্থানে দৃশ্যমান। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ঢাকার নাম ‘জাহাঙ্গীরনগর’ আখ্যায়িত করে এখানে সুবে বাংলার রাজধানী স্থাপন করা হয়। সে সময় এখানে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হিন্দু-মুসলিম অনেক পেশাজীবীর আগমন ঘটে এবং তাদের নামে শহরের বিভিন্ন জায়গা কিংবা বসতি ও মহল্লাগুলোর পরিচিতি এবং বিস্তৃতি ঘটে। ১৬৭৯ সালে ঢাকায় ভ্রমণরত পর্তুগিজ পরিব্রাজক টমাস বাউরি তাঁর স্মৃতিকথায় লেখেন, ঢাকার নগরায়ণের পরিধি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৪০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত এবং শহর অভ্যন্তরের খাল-নদী পথে ৫০০-৬০০ টনের জাহাজও চলাচল করত। মেঘনা-শীতলক্ষ্যা-বংশী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত বুড়িগঙ্গা-বালু-টঙ্গী-তুরাগ নদে পরিবেষ্টিত ঢাকার অভ্যন্তরে অসংখ্য খাল-বিলের সমন্বয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে ছিল অনেক দ্বীপ-অণুদ্বীপও। সে সময় এসব খাল-নদী পথ ছিল ঢাকার প্রধান পরিবহনব্যবস্থা। তখন বিশ্ব পর্যটকেরা ঢাকাকে ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ বলতেন। কিন্তু কালক্রমে আজ এর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
ঢাকার অধঃপতন শুরু হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে, যখন (১৭০৪ সালে) এখান থেকে রাজধানী অপসারণ করে প্রথমে মুর্শিদাবাদ ও পরে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। পশ্চিম বাংলার বনেদি হিন্দুদের ষড়যন্ত্রে ভূ-রাজনীতির শিকার হয়ে ঢাকার প্রতি কোম্পানির শাসকদের অবহেলায় সমগ্র নগরে প্রাক্-মোগল ও মোগলদের নির্মিত ইমারত ও স্থাপনাগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। নগরীর পরিধি সংকুচিত ও জনসংখ্যা কমে গিয়ে একপর্যায়ে (১৮০০ শতাব্দীতে) ঢাকা ছোট্ট এক মফস্বল শহরে রূপ নেয়। ব্রিটিশ জরিপকার র্যানেলের মতে, তখন ঢাকার নগরায়ণ বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে বাঁধ বরাবর চার মাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং মোগল শাসনামলে যেখানে ঢাকার জনসংখ্যা ১০ লাখে উন্নীত হয়েছিল, তা নেমে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ৬৮ হাজারে। তবে ব্রিটিশ শাসনামলের শেষদিকে পূর্ব বাংলার মানুষের চরম অসন্তুষ্টি ও নেতাদের চাপে ঢাকা জেলা বোর্ড ও পৌরসভা গঠন, পুরান ও নতুন ঢাকার মধ্যবর্তী স্থানে কয়েকটি (ওয়ারি, গোপীবাগ) আবাসিক এলাকার পত্তন, বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে পানি শোধনাগার স্থাপন, নগরীতে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং রেল সার্ভিস চালুর মাধ্যমে নগরীর সংস্কার ও পুনঃ উন্নয়নের কিছুটা উদ্যোগ গৃহীত হয়। এরপর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের (Partition of Bengal) মাধ্যমে ঢাকাকে নবগঠিত পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানী ঘোষণার প্রেক্ষাপটে নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে আরও বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়।

কিন্তু ঢাকা নিয়ে ভূ-রাজনীতি বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার বনেদি হিন্দুদের ষড়যন্ত্রীদের চাপে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ঢাকার কপালে আবারও দুঃখ নেমে আসে। ১৯০৫ সালে ঢাকাকে প্রাদেশিক রাজধানী করার প্রেক্ষাপটে একে নবরূপে গড়ার লক্ষ্যে ইউরোপীয় পরিকল্পনার ধাঁচে তৎকালীন পুরান ঢাকাসংলগ্ন রমনা-তেজগাঁও এলাকাকে Garden City হিসেবে গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা গৃহীত হয়, কিছুদিনের মধ্যে তা ভেস্তে যায়। ওই পরিকল্পনার কোনো কপি বা পরিলেখ এখন কোথাও সংরক্ষিত না থাকলেও এটা লক্ষ করলে দেখা যায়, নগরীর দক্ষিণ-পূর্বে গুলিস্তান-হাটখোলা-দিলকুশা-ঝিলপাড়, পশ্চিমে নীলক্ষেত হয়ে উত্তরে ইস্কাটন পর্যন্ত এলাকাটিকে ব্রিটিশ Garden City Movement-এর দর্শনে কলকাতার Eden Garden Suburb-এর আদলে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যার অবয়ব এখনো দৃশ্যমান। কিন্তু ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ করার মাধ্যমে ঢাকা থেকে রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরের কারণে নগরীর বিভিন্ন স্থানে প্রস্তাবিত ও নির্মাণাধীন ইমারত-স্থাপনা ও অবকাঠামোর কাজ থমকে যায়। পরে সীমিত পরিসরে কিছু ইমারত নির্মিত হলেও এগুলোর ব্যবহার অন্য ব্যবহারে চলে যায়। যেমন রমনার কেন্দ্রে প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েট কাম আইন সভার জন্য পরিকল্পিত ভবনাদি চলে যায় প্রথমে লাটসাহেব বা গভর্নরের বাসভবন হিসেবে, অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (কার্জন হল) অনেক স্থানই অন্যান্য ব্যবহারে চলে যায়, যার উল্লেখযোগ্য অংশের অবস্থান এখন হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে।
ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তরের পর পূর্ব বাংলার নবাব পরিবার ও সুধীসমাজের চরম অসন্তোষে তখন, ‘Imperial Concessions’ হিসেবে নগরীর যৎকিঞ্চিত পুনরুন্নয়ন তথা ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে ব্রিটিশ পরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গ্যাডেসকে একটি উন্নয়ন প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯১৭ সালে দাখিলকৃত ‘Report on Town Planning, Dhaka’ শীর্ষক গ্যাডেসের প্রতিবেদনে ঢাকার উন্নয়ন ও স¤প্রসারণে অনেক সুপারিশ থাকলেও এটির অনুমোদন ও বরাদ্দ নিয়ে ছিল অস্পষ্টতা। অর্থাৎ গ্যাডেসের প্রস্তাবনাসমূহের বাস্তবায়নের কোনো রেকর্ড দেখা যায় না। তবে সে সময় ঢাকার নবাব পরিবার ও উদীয়মান অন্যান্য মুসলিম নেতৃত্বের চাপে রমনা এলাকায় বিদ্যমান প্রাক্-ঐতিহাসিক অনেক স্থাপনা, কবর ইত্যাদি গুঁড়িয়ে দিয়ে সীমিত পরিসরে ‘রমনা নিউ টাউন’ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা করা হয়। এ জন্য অনেকে তো রমনা এলাকায় বিদ্যমান কবর-মাজার ইত্যাদিকে গুঁড়িয়ে সেখানে নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করাকে ‘ঢাকার ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত’ বলে মনে করেন! বাস্তবে ঢাকার উন্নয়নে গৃহীত কোনো পরিকল্পনাই অজ্ঞাত কারণে পেশাজীবীদের প্রস্তাবনা মোতাবেক বাস্তবায়িত হয়নি। সব কাজেই ছিল নানা ধরনের সমস্যা জর্জরিত।
যা-ক, সে সময় সরকারের দেওয়া কিছু জমি ও মূলত নবাব পরিবারের দান করা জমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর আবার এর ভেতরে প্রতিষ্ঠিত হয় আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে বুয়েট), ঢাকা মেডিকেল কলেজ, আর্ট কলেজ, পিজি হাসপাতাল। ফলে শুরুতে যেভাবে ও আঙ্গিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা অপরাপর কোনো প্রতিষ্ঠানই গড়ে উঠতে পারেনি। তবে এ কথা সত্যি যে ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিকে ঢাকার উন্নয়নে শাসকগোষ্ঠীর কিছুটা আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হলেও প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতবর্ষজুড়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির প্রেক্ষাপটে ধারাবাহিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় তথা ঢাকার উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অনুপস্থিতি ও নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে সে সময় নগরীতে আর তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি, বরং তখন পাকিস্তান-ভারত বিভক্তিকে কেন্দ্র করে ভারত থেকে মুসলিম উদ্বাস্তুদের ঢাকায় যত্রতত্র বসতি স্থাপনের কারণে নগরীতে এলোপাতাড়ি ঘরবাড়ি নির্মাণ ও খাল-নালা ভরাট কিংবা দখলের প্রবণতা শুরু হয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির পর ঢাকার অবস্থা এমনি দাঁড়ায় যে ইমারত নির্মাণ আইন জারি করে এলোপাতাড়ি নির্মাণ রোধে ব্যবস্থা নিতে হয়। কিন্তু ওই আইনটির কার্যকর বাস্তবায়নে সে সময় কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় ডিআইটি প্রতিষ্ঠার পর সংস্থাটির ওপর এই দায়িত্বটি অর্পিত হয়। কিন্তু এই সংস্থাটিকে কখনো ওই কাজের দায়িত্ব পালনে সেভাবে সাজানো হয়নি। তা ছাড়া একটি সংস্থার ওপর পরিকল্পনা প্রণয়ন, নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নের দায়িত্ব অর্পণ করাও ঠিক হয়নি। নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ের দায়িত্ব সর্বত্র একটি স্বতন্ত্র ও আলাদা প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকে, যাতে পেশাগত ও নিরপেক্ষভাবে মনিটরিং করা যায়। আজ নিঃসন্দেহে এটা বলা যায় যে ডিআইটির (বর্তমানে রাজউক) ওপর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটির প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও অসংখ্য সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার দরুন নগরীতে আজকের এই করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

১৯৫৯ সালে ঢাকার প্রথম মহাপরিকল্পনা প্রণয়নকালে ব্রিটিশ উপদেষ্টারা সমস্যটি আঁচ করে তাঁরা ডিআইটির পরিবর্তে Dhaka Planning and Development Authority প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করেছিলেন, যাতে সংস্থাটির নগর পরিকল্পনা শাখা অধিকতর সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু তা করা হয়নি, বরং ডিআইটি পরে রাজউককে পরিকল্পনার চেয়ে অতিমাত্রায় উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
স্বাধীনতার পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নগর বিশেষজ্ঞরা ডিআইটি এবং নগরীর উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাপর সব সংস্থাকে একীভূত করে Dhaka Metropolitan Planning Authority এবং Dhaka Metropolitan Development Authority নামে ভিন্নভাবে দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য সুপারিশ করেছিলেন, কিন্তু তাও হয়নি, বরং তখন থেকে নগরীর উন্নয়নে যোগ হয়েছে আরও অনেক সংস্থা। আর বরাবরের মতো ঢাকায় নগর পরিকল্পনার অবস্থান এখনো ব্যাক বেঞ্চে। অপর দিকে একই ধরনের কাজে জড়িত হয়ে পড়েছে একাধিক সংস্থা। শুধু তা-ই নয়, যেসব সংস্থার ঢাকায় কাজ করার ম্যান্ডেট নেই, এ রকম অনেক সংস্থাও ঢাকার উন্নয়নে জড়িত হয়ে স্ব-স্ব পরিকল্পনায় বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে।
প্রকৌশলী মো. এমদাদুল ইসলাম, নগর ও উন্নয়ন বিশ্লেষক, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭২ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৬