প্রারম্ভিক কথা
উন্নয়ন, নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ তথা বিভিন্ন অবকাঠামোগত সেবার স¤প্রসারণ আর সংস্কারের জন্য প্রয়োজন খননের (Excavation)। কিন্তু এ কাজটি ত্বরিত গতিতে বাস্তবায়ন করা না হলে এর জন্য যদি মানুষের অতিমাত্রায় ভোগান্তি হয়, ঘটে ধৈর্য্যচ্যুতি; তখন এটি আর উন্নয়ন হিসেবে বিবেচিত হয় না। হয় হিতে বিপরীত। ক্ষুন্ন হয় সরকারের ভাবমূর্তি, যা এখন ঘটছে রাজধানী ঢাকায়। গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে পুরো ঢাকাজুড়ে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির তান্ডব। সড়ক, ফুটপাত কিছুই বাদ নেই এ থেকে। কেটে ফেলা হয়েছে অসংখ্য গাছ। মাসের পর মাস ধরে খোঁড়াখুঁড়িতে নগরজীবন হয়ে পড়েছে বিপন্ন। যানজট রূপ নিয়েছে ভয়াবহ। অনেক জায়গার বাসিন্দারা ঘর থেকে বের হতে পারছে না, অফিসে যেতে পারছে না সময়মতো। ছাত্ররা সময়মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে পারছে না। অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্যও স্থবির হওয়ার উপক্রম। পাশাপাশি এ বছর প্রচন্ড গরম ও খননে মাটি-বর্জ্যরে ধুলোবালিতে পরিবেশদূষণের কারণে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের রোগবালাই। কিন্তু কোথাও কেউ নেই বিষয়গুলো দেখার।
প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, রাজধানীজুড়ে বর্তমানে ৫০০টির বেশি সড়কে বিভিন্ন সেবা সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। তন্মধ্যে উত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে প্রায় চার শতাধিক এবং অবশিষ্ট সড়কগুলো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায়। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা হবে আরও বেশি। কারণ, নগরজুড়েই চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। দৃশ্যত, এবার বেশির ভাগ সড়কে সিটি করপোরেশনের স্ট্রম ড্রেনেজের সংস্কার ও উন্নয়নের কাজ হলেও অনেক জায়গায় ওয়াসার স্যুয়ারেজ ও ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেমের উন্নয়ন এবং কিছু সড়কে বিটিসিএল, তিতাস ও ডেসকোর লাইনের মেরামত ও স¤প্রসারণের কাজ চলছে। কিন্তু পুরো কাজটি চলছে সম্পূর্ণ অসমন্বিতভাবে। কারও সঙ্গে কারও কোনো ধরনের সমন্বয় আছে বলে মনে হয় না। কিছু সড়কে আবার পাশাপাশি একই সঙ্গে কয়েকটি সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। অনেক জায়গায় এক সংস্থার খননকাজ শেষ না হতেই আরেক সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। আবার কিছু সড়কে একই সংস্থা কর্তৃক এক পাশে খননের কয়েক দিন পর আরেক পাশে বা সড়কের মাঝখানে খননকাজ শুরু হয়। আরও আশ্চর্য ব্যাপার কিছু সড়কে খনন-উত্তর মেরামত এমনকি বিটুমিনাস পেভমেন্ট কাজ পর্যন্ত হওয়ার পরও সেখানে নতুন করে একই বা অন্য সংস্থার আবার খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। এভাবে অসমন্বিত সড়ক খোঁড়াখুঁড়িতে জনদুর্ভোগ বাড়ছে অতিমাত্রায়।

বিদ্যমান খনন-প্রক্রিয়া
খননের বিষয়টি নির্মাণের ঠিক বিপরীত এবং অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণও বটে। তাই পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা (Adequate Safety Measures) গ্রহণ করে কাজটি সম্পাদন করতে হয়। আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে খননকাজ সম্পন্ন ও ত্বরিত মাটি-রাবিশ অপসারণ করতে হয়। খননাধীন সড়ক কিংবা এলাকায় যাতে জনগণ ও গাড়ি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা এবং যানজটের সৃষ্টি না হয়, সে জন্য Special Traffic Management Plan প্রণয়ন করতে হয়। যথাত্বরিত সড়কের পুনর্বাসন (Restoration) ও সংস্কার করে যোগাযোগব্যবস্থা সচল রাখতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমনকি খোদ রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রবিন্দুতে এখনো সেই গতানুগতিক নিয়মে খননের কাজ চলে। কিছু সড়কে এক্সাভেটর দিয়ে খননকাজ পরিচালিত হলেও কোনো সাইট থেকে মাটি-রাবিশ সঙ্গে সঙ্গে বা সহজে অপসারণ করা হয় না। সড়কের পুনর্বাসন ও মেরামতেও বিলম্ব ঘটে। অনেক স্থানে তো খননে অত্যধিক সময় ব্যয়সহ খননকৃত সড়ক বা ফুটপাত উন্মুক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়।
দৃশ্যত, প্রায় ক্ষেত্রে যেনতেনভাবে খননকাজ শুরু করা হয়। কখন কোন সড়কে খনন হবে, কোন পাশে বা কী কাজের জন্য, তা এলাকাবাসীর জানা থাকে না বা জানানো হয় না। দেখা যায়, আকস্মিক কোনো এক সকালে বা রাতে ঘরের সমানে ধুপধাপ আওয়াজে শুরু হয় খোঁড়াখুঁড়ি। ফলে ঘর থেকে গাড়ি বের করা যায় না, বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না, এমনকি অনেক সময় অফিসেও যাওয়া যায় না।
লক্ষণীয়, কোনো খনন সাইট যথাযথভাবে ঘেরাও (Cordoning) করা হয় না এবং তেমন কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থাও (Signage, Protection, Shoring System etc) নেওয়া হয় না। প্রায়ই অদক্ষ শ্রমিক নিয়ে কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মাটির গভীর পর্যন্ত খননকাজ চলে। যার কারণে, অনেক খনন সাইটে ঘটে নানা ধরনের দুর্ঘটনা, শ্রমিক চাপা পড়েও মারা যায়। আর পথচারী তথা এলাকাবাসীর তো দুর্ভোগের শেষ নেই। প্রায় খনন সাইট স্তূপীকৃত মাটি-রাবিশ গড়িয়ে স্ট্রম ড্রেনে পড়ে তা ব্লক হয়ে যায়। সড়কে ধুলোবালি বা কর্দমাক্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় শুরু হয়েছে কালবৈশাখী, ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টি, যাতে অনেক জায়গায় গাছ পড়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। অনুরূপ, খননকৃত সড়কের সংস্কার-মেরামতে গড়িমসি বা বিলম্বের কারণে গাড়ি চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে, সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের। আবার অনেক সময় তড়িঘড়ি করে সড়কের পুনর্বাসন করে বাড়তি সমস্যারও সৃষ্টি করা হয়, যা জনসাধারণ ও গাড়ি চলাচলে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে অনেক খনন সাইটে গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে, সৃষ্টি হয় লম্বা যানজটের, আহত হয় পথচারী এবং অনেক সময় দুর্ঘটনায় বরণ করে পঙ্গুত্বও।

প্রায়ই ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। কয়েক দিন আগে বনানীর ২৩ নম্বর সড়কে অসমন্বিতভাবে খননের ফলে গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ ঘটায় খনন সাইটের পাশের পুরো একটি আবাসিক ভবন বিধ্বস্ত হয়। জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃক সেখানে স্ট্রম ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে এক্সাভেটরে লাগিয়ে একতরফাভাবে খননকাজ পরিচালনাকালে বিদ্যমান গ্যাস ও পয়োপ্রণালির লাইন বিচ্ছিন্ন বা ঢিলা হয়ে যায়। সিটি করপোরেশনের উচিত ছিল সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনা, কিন্তু এটি করা হয়নি। বরং সিটি করপোরেশনের খননের লোকজন এটিকে মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়। আর ওই অবস্থায় সেখানে লিকেজড গ্যাস ওয়াসার পয়োলাইন দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহে গৃহস্থালির লাইনে চলে যায় এবং একপর্যায়ে ভবনের রান্নাঘর ও টয়লেটসমূহ গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় ওই দিন গভীর রাতে বিস্ফোরণ ঘটে ভবনে আগুন লেগে যায় এবং তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
বাস্তবে নগরীর বিভিন্ন স্থানে অসমন্বিতভাবে খননের কারণে প্রায়ই এখানে-ওখানে এ ধরনের অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে, যা দেখভালের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কেউ নেই, নেই কোনো সংস্থাও। নগরীর বিভিন্ন সেবার (Utility Lines) এর As-Built Drawings নেই। এই অবস্থায় কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের আবেদনক্রমে সিটি করপোরেশন কর্তৃক তাদের নির্ধারিত হারে ফি আদায় করে অনুমতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ। কখন, কোথায় খননকাজ শুরু হয় কিংবা চলে তা দেখা বা তদারকির জন্য কোনো সংস্থারই অধীনে এর জন্য সুনির্র্দিষ্ট কোনো জনবল নেই। এমনকি সিটি করপোরেশন কর্তৃক সংশ্লিষ্ট সংস্থা থেকে এ কাজের জন্য ক্ষতিপূরণ ও বিভাগীয় চার্জ আদায় এবং অগ্রীম জরিমানা গ্রহণ করেও খনন সাইটে বাড়তি কোনো জনবল নিয়োগ করে না। ফলে কোনো খননকাজের প্রাক্-প্রস্তুতি ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রভাবিত এলাকায় যানবাহন চলাচলের পরিকল্পনা, খননপদ্ধতি, খননকৃত মাটি-রাবিশ অপসারণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ ব্যতিরেকে নগরীর সর্বত্র খননকাজ চলে। বলা যায়, ঠিকাদারের নিজস্ব পরিকল্পনা বা ইচ্ছে অনুসারে বেশির ভাগ খননকাজ বাস্তবায়িত হয়। আর এভাবে অসমন্বিতভাবে ও দীর্ঘ সময় ধরে খোঁড়াখুঁড়ি ও খননকৃত সড়কের পুনর্বাসনে বিলম্বের কারণে বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা-উত্তর পরস্পরের মধ্যে ব্লেম গেম চলে।
নীতিমালা
খনন বা খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়টি অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় এ কাজের সুষ্ঠু ও যথাযথ বাস্তবায়নে বিশেষ ধরনের কিছু নিয়মনীতি ও বিধিবিধান রয়েছে। অনেক দেশে প্রণীত হয়েছে আইনও। Occupational Health & Safety Administration (OHSA) শীর্ষক আইনটি সমগ্র বিশ্বে Mother Act হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আজ অবধি বাংলাদেশে এতদ্বিষয়ে কোনো ধরনের আইন বা বিধিবিধান প্রণীত হয়নি। অথচ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে দেশজুড়ে সবচেয়ে বেশি সড়ক খনন ও বিভিন্ন সেবার সম্পসারণ করতে হয়। হিসাবে করলে হয়তো দেখা যাবে, বিশ্বে বাংলাদেশেই এ কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়। বিভিন্ন সেবা সার্ভিসেসের As-Built Drawings-এর অনুপস্থিতিতে অনুমানভিত্তিক খনন পরিচালনায় বরাবর এ কাজে অত্যধিক ব্যয় হয়। স্বাভাবিকভাবে রাজধানী ঢাকা ও দেশের অন্যান্য নগর এলাকায় বেশি সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কাজ হয়। কিন্তু দেশের কোনো সিটি করপোরেশনের কাছে এ কাজের জন্য এখনো কোনো বিস্তারিত খনন নীতিমালা নেই। ফলে খননকাজের অনুমতি প্রদান, নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ে বরাবরের সমস্যা থাকছেই।

তবে আগে ঢাকা পৌর এলাকায় খননকাজের অনুমতি প্রদানকালে কয়েকটা গৎবাঁধা নির্দেশনা দেওয়া হতো, কিন্তু তা কেউ অনুসরণ করল কি না, তা দেখার বা জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এই পরিস্থিতিতে খনন সাইটে বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা রোধ, যানজট সমস্যার নিরসনসহ সমন্বিতভাবে ও যথাত্বরিত খননকাজ সম্পন্নকরণ এবং জবাবদিহি সৃষ্টি ও দায়বদ্ধতা আনয়নে ২০০৪ সালে প্রণীত হয় একটি সংক্ষিপ্ত নীতিমালা। যখন আমি রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী, তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন সচিব ড. কামাল সিদ্দিকীর আহ্বানে ওই নীতিমালাটির খসড়া প্রণয়ন করি। খসড়াটির ওপর কয়েক দফা আলোচনায় তা চ‚ড়ান্তকরত এটি যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্য সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ প্রদান করা হয়। যতটুক মনে পড়ে, ওই নীতিমালাটি কঠোরভাবে অনুসরণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকেও সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়, কিন্তু বর্তমানে এই নীতিমালাটি কার্যকর আছে কি না, অনুসরণ করা হচ্ছে কি না এবং নবনির্বাচিত মেয়র মহোদয়দ্বয় তা জানেন কি না অস্পষ্ট!
নীতিমালাটিতে খননের অনুমতি প্রদান, প্রাক্-প্রস্তুতি, নিরাপত্তাব্যবস্থা, খননপদ্ধতি, ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রভাবিত এলাকার পরিবহন পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে রয়েছে বিভিন্ন নির্দেশনা। কারও আবেদনের ওপর এককভাবে অনুমতি প্রদান না করে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে নগরীর পরিকল্পনা ও উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর যথোপযুক্ত প্রতিনিধির সমন্বয়ে এক বা একাধিক One-Stop Services কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। খননের নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ের জন্য নগরীতে বিভিন্ন সংস্থার সার্ভিসেসের As-Built Drawings প্রণয়ন করার জন্যও বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে নগরীতে চলমান খননপ্রক্রিয়াদৃষ্টে এটি স্পষ্ট যে সিটি করপোরেশন তথা অন্য কোনো সংস্থা কর্তৃক এই নীতিমালায় বর্ণিত নিয়মকানুন ও পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে না। যার কারণে নগরীর সড়ক খননকাজে এই দুরবস্থা ও জনদুর্ভোগ বাড়ছে। অধিকন্তু কিছু খনন সাইটে দেখা যায়, উত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে গুলশান-বনানী এলাকায় চলমান স্ট্রম ড্রেনেজ কাজে সড়ক বা ফুটপাতে নবনির্মিত ড্রেনে খননকৃত রাবিশ পরিষ্কার না করেই তার ওপরে কাভার স্লাব ও সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে এসব ড্রেনেজ কতটুকু কার্যকর (Functional) হবে তা এখনই প্রশ্নসাপেক্ষ।
সমন্বয়হীনতা ও বাস্তবতা
সার্বিক বিষয়টি পর্যালোচনা করলে এর পেছনে আরও কিছু বহুমাত্রিক সমস্যা ভেসে ওঠে। প্রথমত, রাজধানী ঢাকার মহাপরিকল্পনামতে এখানে যত লোকজন থাকার কথা, তারচেয়ে বর্তমানে বহুগুণ বেশি মানুষের বসবাস ও অবস্থান এবং দিনে দিনে বাড়ছে। বস্তুতপক্ষে দেশের সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় এ সমস্যা এখন প্রকট থেকে প্রকটতর হয়েছে। আর স্বাভাবিকভাবে নগরীর সর্বত্র জনসংখ্যা বাড়ায় সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করে বাড়তি সেবার সম্প্রসারণ ঘটানো হচ্ছে। প্রচলিত নিয়মে, ঢাকায় বিভিন্ন সংস্থার অধীনে উন্নয়নকৃত সড়কের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু সঠিকভাবে প্রাক্কলন প্রণয়ন, বরাদ্দের স্বল্পতার কারণে সিটি করপোরেশনের পক্ষে কখনো খননকৃত সড়ক যথাসময়ে মেরামত ও পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তা ছাড়া লক্ষ করলে দেখা যায়, ঢাকার বেশির ভাগ সড়ক নেটওয়ার্কই আঁকাবাঁকা ও সরু এবং অনেক জায়গায় কিছু সড়ক আবার সংকুচিত হয়ে নির্মিত বা থেমেও গেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনায় বাস্তবায়িত বা অপরিকল্পিত জনপদের (Neighbourhood) স্বতৎস্ফূর্ত বিস্তারকালে নির্মিত এসব কোনো সড়কের ধারে Utility Lines স্থাপনের জন্য জায়গা চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করা হয়নি। আবার বিভিন্ন সময়ে বলা হলেও এমনকি পরিকল্পিত এলাকাসমূহেও Utility Lines-এর সমন্বিত উন্নয়নের জন্য Duct নির্মাণ করা হয়নি। এতে বিভিন্ন সংস্থার অধীনে নগরীতে তাদের স্ব-স্ব পরিকল্পনায় Utility Lines-এর স্থাপন ও সম্প্রসারণ ঘটে চলেছে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোনো সংস্থার কাছে এমনকি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান সিটি করপেরেশনের কাছেও নগরীর কোনো একটি সড়কের Utility Lines-এর As-Built Drawings নেই। এই অবস্থায় ঢাকায় প্রায় ক্ষেত্রে অনুমানের ওপর সড়ক খনন শুরু হয় ও চলে।

দ্বিতীয়ত, রাজধানী ঢাকার উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত প্রতিটা সংস্থার কাজের বাস্তবায়ন, পরিকল্পনা, ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশনে ভিন্নতা রয়েছে। যেমন রাজউকের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের, আবার একই মন্ত্রণালয়াধীন সিটি করপোরেশনের সঙ্গে ঢাকা ওয়াসা বা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (LGED) কার্যক্রমে মিল নেই। একই অবস্থা বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য ক্ষেত্রে। যার কারণে কোনো একটি অবকাঠামোগত কাজের বাস্তবায়ন শেষে তা সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করার পর তাদের পক্ষে এটির সঠিক পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভবপর হয় না। আবার ঢাকায় অনেক কাজের দ্বৈততার (Duplicacy) বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ চলে। যেমন- ঢাকায় সারফেস ও স্ট্রম ড্রেন নির্মাণ ও পরিচালনার সঙ্গে ঢাকা সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা উভয়ে জড়িত, কিন্তু দুটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনায় রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নতা। এসব বিভিন্ন অসংগতির কারণে এখন ঢাকায় বৃষ্টি না হতেই জলাবদ্ধতা, অতঃপর পরস্পরের মধ্যে দোষারোপের খেলা চলে।
তৃতীয়ত, খননপদ্ধতির ভিন্নতা। কেউ গতানুগতিকভাবে শ্রমিক নিয়োগ করে, কেউ শ্রমিক ও কিছু যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে, কিন্তু কোনো সংস্থারই কাছে এ জন্য প্রয়োজনীয় Excavation Set-up & Management Team নেই। ফলে নগরীর সর্বত্র খোঁড়াখুঁড়িতে তথৈবচ অবস্থা। অথচ বিশ্বের অনেক জায়গায় দেখা যায়, সকালে সড়ক খননের পর সমন্বিত প্রচেষ্টায় তা বিকেল বা রাত্রির মধ্যে পূর্বাবস্থায় চলে আসে এবং সড়কটি ব্যবহারযোগ্য হয়ে যায়। প্রসঙ্গক্রমে বর্তমানে বনানী-গুলশানসহ নগরীর অনেক জায়গায় বিভিন্ন সংস্থার অধীনে সড়ক খনন চলছে। তন্মধ্যে অনেক জায়গায় খননের দায়িত্বে সিটি করপোরেশন নিজে। বনানীতে সড়কের পার্শ্বস্থ ড্রেনের সংস্কার ও উন্নয়নে উত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশন এই খোঁড়াখুঁড়ি করছে, কিন্তু সরেজমিনে কখনো কোনো জায়গায় সিটি করপোরেশনের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কেউ দেখেছেন কি না সন্দেহ! এতে যথাযথ তদারকির অভাবে নির্মিত ড্রেনে খননের ময়লা-আবর্জনা থাকাবস্থায় (অর্থাৎ ড্রেন পরিষ্কার না করে) কভার স্লাব বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এহেন অবস্থায় এসব ড্রেন কতটুকু কার্যকর হবে তা প্রশ্নবিদ্ধই থাকছে। প্রসঙ্গক্রমে ঢাকায় তথায় বেশির ভাগ ড্রেনের নির্মাণকালে যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা এবং অতঃপর নিয়মিত পরিচর্যার অভাবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা অকার্যকর (Non-Functional) হয়ে যায়।
পরিশেষে
বর্তমানে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় বিশ্বব্যাপী খননপদ্ধতির অনেক উন্নতি হয়েছে। ঢাকায় কিছু খনন সাইটে এসব আধুনিক প্রযুক্তি দেখা গেলেও প্রায় ক্ষেত্রে তা সেভাবে ব্যবহৃত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খনন চলে গতানুগতিক নিয়মে অর্থাৎ Cut & Cover প্রক্রিয়ায়। কতিপয় ক্ষেত্রে Tunneling Technology ব্যবহার করে Utility Lines স্থাপন করতে দেখা যায়। আবার কিছু জায়গায় আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে ত্বরিত খনন সম্পন্ন করা হলেও সড়কের পুনর্বাসন করা হয় গতানুগতিক নিয়মে। কাজেই নগরবাসীকে খননের এই দীর্ঘ দুর্ভোগ থেকে রক্ষার জন্য খননপ্রক্রিয়াকে আধুনিক করার বিকল্প নেই। সে সঙ্গে নগরীর সব Utility Lines-এর ডেটাবেইস তৈরি ও As-Built Drawings প্রণয়নসহ নীতিমালা অনুসরণে যেকোনো খননের অনুমোদন প্রদান, নিয়ন্ত্রণ ও কঠোরভাবে মনিটরিং করা প্রয়োজন।

নাগরিক সুবিধাদির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য সড়ক, ফুটপাত ইত্যাদি খনন করতে হয় বা হবে। কিন্তু তাই বলে তো এই যুগে Free Style-এ খোঁড়াখুঁড়ি করতে দেওয়া যায় না। অবশ্যই কাজটি হতে হবে আধুনিক প্রক্রিয়ায় ও স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এবং পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে। সব ধরনের নিরাপত্তা বিধান করে কাজটির বাস্তবায়ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে মানুষের জন্য উন্নয়ন, উন্নয়নের নামে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা নয়। আর যেহেতু এই কাজটি অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ, সেহেতু যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করে কাজটি পরিচালনা করতে হবে। এ জন্য খননকাজের সার্বিক নিয়ন্ত্রণে একটি কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুম এবং এলাকাভিত্তিক লিয়াজোঁ অফিস স্থাপনসহ কাজটির সুষ্ঠু বাস্তবায়নে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। কয়েক দিন আগে দুটি সিটি করপোরেশন পরিধি সম্প্রসারিত হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে পরিসর দ্বিগুণে উন্নীত হয়েছে। কাজেই সেভাবে সিটি করপোরেশনকে তৈরি করা প্রয়োজন।
প্রকৌশলী মো. এমদাদুল ইসলাম, নগর ও উন্নয়ন বিশ্লেষক সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক
প্রকাশকাল: বন্ধন ৭৪ তম সংখ্যা, জুন ২০১৬