বলার অপেক্ষা রাখে না, ভয়াবহ যানজটই রাজধানী ঢাকার এখনকার প্রধান সমস্যা। স্বাধীনতা-উত্তর সময় থেকে বিশেষত আশির দশকে ক্রমবর্ধমান এই সমস্যা নিরসনে দীর্ঘদিন ধরেই অনেক কিছু করার কথা হচ্ছে। কিন্তু দেশের ধারাবাহিক অস্থিতিশীলতা ও নেতৃত্বের অনৈক্য, যথাযথ সমীক্ষা ব্যতীত প্রকল্প গ্রহণ, সিদ্ধান্তহীনতা, প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান ও সমন্বয়হীনতার কারণে প্রস্তাবিত এসব প্রকল্প আলোর মুখ দেখছে না। নগরায়নের বিভিন্ন সূচকের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমানে নগর ঢাকা কার্যত এক অচল নগর! আগে যেখানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে ১০-১৫ মিনিট লাগত এখন সেখানে দেড়-দুই ঘণ্টায়ও পৌঁছানো যায় না। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সর্বশেষ প্রকাশিত জরিপ অনুসারে, বসবাসের অযোগ্যতার বিবেচনায় যোগাযোগব্যবস্থা, স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, অপরাধ-সংঘটন প্রভৃতি সূচকে ঢাকাকে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহর (An Utterly Non-habitable Township) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে, ৪০০ বছরের পুরোনো প্রাচীন নগর ঢাকা মূলত অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এক জনপদ। আঁকাবাঁকা সড়ক নেটওয়ার্ক, ঘিঞ্জি নগরায়ন, মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা ও এলোপাতাড়ি ইমারত বা স্থাপনা নির্মাণের কারণে রাজধানী ঢাকায় এখন সড়ক রয়েছে মাত্র ৭-৮ শতাংশ, নগরায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে যা থাকা উচিত ছিল ২০-২৫ শতাংশ। বর্তমানে নগর অভ্যন্তরস্থ অবস্থা এমন যে এখন আর কোনো সড়ক নেটওয়ার্কের প্রশস্তকরণ বা সম্প্রসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। জমির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এই সমস্যা রূপ নিয়েছে প্রকটতর। অবকাঠামো উন্নয়নের চেয়ে জমির মূল্য অনেক বেশি হওয়ায় কোনো উন্নয়ন প্রকল্পই Feasible হয় না। যার কারণে দীর্ঘদিন ধরে গৃহীত পরিকল্পিত সব সড়ককে নির্মাণ বা প্রশস্ত করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় অনেক জায়গায় প্রভাবশালীদের কারণেও সড়ক নেটওয়ার্ক ওলট-পালট হয়েছে বা বাধাগ্রস্ত হয়ে সংকুচিত পরিসরে নির্মিত হচ্ছে সড়ক। যার উদাহরণ মৌচাক মোড়, মালিবাগ মোড়, নর্থ-সাউথ রোডের দুই মাথা, সোবহানবাগ মসজিদের অবস্থানগত ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। একই কারণে রাজধানীর বুকে অনেক জায়গায় রেললাইনও অনাকাক্সিক্ষতভাবে এঁকেবেঁকে গেছে।

তা ছাড়া নগরজুড়ে সমন্বয়হীন উন্নয়ন তো রয়েছেই। ফলে ঢাকার মহাপরিকল্পনা এবং পরিবহন পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও ভূ-পৃষ্ঠের ওপর এখন সহজে কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। এই অবস্থায় সরকার ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নয়নে মনোরেল, স্কাইরেল, মেট্রোরেল, পাতালরেল, কমিউটার ট্রেন, সার্কুলার ট্রেন, ওয়াটার ওয়েস, এলিভেটেড রোড, ফ্লাইওভার, টানেল রোড, আন্ডারপাস, ওভারপাসের মতো পরিবহনকন্দ্রিক স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু যেহেতু এমন বিষয়াদি উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর ও বাস্তবায়নে বিশাল অর্থায়নের পাশাপাশি প্রয়োজন সময়ের, তাই কোনো সরকারের মেয়াদেই বাস্তবায়িত হচ্ছে না এসব প্রকল্প। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ শুরু হলেও থেমে যায় মাঝপথেই। অন্যদিকে ইদানীং যার দায়িত্ব নয় এমন সংস্থাও আগ বাড়িয়ে নগরের বিভিন্ন অবকাঠামোগত কাজ বাস্তবায়নে যুক্ত হচ্ছে। যেমন- ঢাকা সিটি করপোরেশন যেখানে শহরের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, সেখানে তারা এখন যুক্ত হয়েছে ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজে। অনুরূপভাবে স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরও শহর-গ্রামের উন্নয়নকাজ বাদ দিয়ে ঢাকার ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আর সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর তো কিছুই মানছে না। রাজধানীর অভ্যন্তরে তাদের কাজ করার এখতিয়ার নেই জেনেও এ ক্ষেত্রে রয়েছে তাদের অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ। এভাবে অসমন্বিত প্রক্রিয়ায় যেখানে যা হওয়ার নয়, সেখানে তা-ই করা হচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ঘটছে ডুপ্লিকেসির মতো ঘটনা।
বাংলাদেশের আরেকটা অদ্ভুত নিয়ম, যখন যে কাজ করা প্রয়োজন তখন তা না করে কিংবা যার কাজ তাকে দিয়ে বাস্তবায়ন না করিয়ে অন্য দপ্তরকে দিয়ে করানো। এতে প্রায় ক্ষেত্রে পরিকল্পনা মোতাবেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় না, অনেক ক্ষেত্রে অবকাঠামো নির্মিত হয় অপরিকল্পিতভাবে, যা কাক্সিক্ষত উপকারে আসে না; বাড়ায় নির্মাণব্যয়ও। যেমন- মহাখালী ফ্লাইওভার। ১৯৮২-৮৩ সালে রাজউকের উদ্যোগে তেজগাঁও-মহাখালী-বনানী ও মহাখালী থেকে ক্যান্টনমেন্টের জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত তখন প্রস্তাবিত বিজয় সরণিকে সংযুক্ত করে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। ওই সময় প্রকল্পটির সম্ভাব্য নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৫০ কোটি টাকা। কিন্তু ঢাকার তৎকালীন মেয়র মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের অদূরদর্শিতা বা অজ্ঞতার কারণে তখন সেটি বন্ধ হয়ে যায়। অথচ দীর্ঘদিন পর ২০০৪ সালে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনে ওই পরিকল্পনার শুধু কিয়দংশে অর্থাৎ মহাখালী রেলক্রসিংয়ের ওপর একটি ওভারপাস নির্মাণে ব্যয় হয় ১২০ কোটি টাকা। একইভাবে ১৯৮৮-৯০ সালে রাজউক কর্তৃক সোনারগাঁও হোটেলের সামনে দিয়ে ‘পান্থপথ’ সড়কের পূর্বমুখী সম্প্রসারণকালে মগবাজার টঙ্গী ডাইভারশন রোড থেকে রামপুরা সড়ক পর্যন্ত সড়কটির নির্মাণে মাত্র ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু ১৯৯১ সালের গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসে স্বৈরাচার সরকারের আমলে গৃহীত প্রকল্পটি বাদ দেয়, সম্প্রতি যেটি নির্মাণে (হাতির ঝিল এলাকার উন্নয়নের সঙ্গে) ব্যয় হয়েছে অনেকগুণ বেশি।

প্রসঙ্গক্রমে স্বাধীনতার পর এরশাদের শাসনামলে ঢাকায় প্রথম কিছু সড়ক নেটওয়ার্ক নির্মিত হয়, যা না হলে নগরে এখন চলাচলই দায় হতো। কিন্তু তখন এসব সড়ক নির্মাণের জন্য নগরের অনেক খাল-নালা ও নিচু ভূমি ভরাট করা হয়। ফলে ঢাকায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার, বৃষ্টি না হতেই দেখা দেয় বন্যা। ১৯৮৮ সালে রাজধানী ঢাকাতে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার প্রেক্ষাপটে গৃহীত Flood Action Plan-এর আওতায় বাস্তবায়িত কিছু কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে এই সমস্যা রূপ নেয় ব্যাপকতায়। টঙ্গী থেকে তুরাগ-বুড়িগঙ্গা-বালু নদীর ধার ঘেঁষে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের প্রস্তাবিত একটা প্ল্যানের ভিত্তিতে তড়িঘড়ি করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ কাম দেয়াল ও বক্স কালভার্ট নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকার নগরায়নের পাশাপাশি পরিবেশে সৃষ্টি হয় বড় ধরনের বিপর্যয়ের। তখন স্বার্থান্বেষী কিছু মহল কর্তৃক বাঁধের অভ্যন্তরস্থ প্রায় নিচু জমি দখল ও রাতারাতি ভরাট করার কারণে ঢাকার নগর পরিবেশ ও জলবায়ুতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। বাঁধসংলগ্ন নদীর জমি দখল শুরু হলে নদীগুলোও হতে থাকে সংকুচিত, যার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চতুর্দিকে আজ একটি নদীও যথাযথভাবে পরিবহনযোগ্য অবস্থায় নেই। একদা ঢাকা শহরে জালের মতো বিস্তৃত ৪০-৪৫ খাল-নদীর প্রায়ই ইতিমধ্যে নগর মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। অথচ সে সময় ওই নদীগুলোই ছিল নগরের প্রধান পরিবহন পথ। এসব নদীর সঙ্গে ঢাকা শহরের ওপর বিস্তৃত একগুচ্ছ খালের সংযোগ ছিল, যা দিয়ে নগরের অভ্যন্তরীণ পরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিত হতো। তুরাগ নদ থেকে কল্যাণপুর-ধানমন্ডি-কলাবাগান-বেগুনবাড়ি-হাতির ঝিল-রামপুরা খাল দিয়ে বালু-শীতলক্ষ্যা নদীর মধ্যে যে সংযোগ ছিল আজ তা বিলীন প্রায়। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত রামপুরা ও হাতির ঝিলের মগবাজার এলাকায় ঢাকার আশপাশের জায়গা থেকে খাল-নদীপথ দিয়ে ব্যবসায়ীরা শহরে তরিতরকারি নিয়ে আসতেন, যা বর্তমান প্রজন্মের কাছে একই সঙ্গে অবিশ্বাস্য ও দিবাস্বপ্নের মতো। তবুও, দীর্ঘদিন পর হাতির ঝিলের পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে নগরবাসীর বিনোদনের একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। যদি তখন ঢাকার সব খাল-নদীর ধারে এভাবে সড়ক বা ফুটপাত নির্মাণ করে তা সংরক্ষণ করা হতো, তবে ঢাকা আজ পেত কম-বেশি প্রাচ্যের ‘ভেনিস’ শহরের অবয়ব।
১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পর ধারণা করা হয়েছিল, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, পরিকল্পিত ও সমন্বিত উন্নয়ন হবে। কিন্তু, তা হয়নি। বরং এই দীর্ঘ সময় ধরে নেতৃত্বের মধ্যে ক্ষমতার দ্ব›দ্ব ও পারস্পরিক বৈরিতায় দেশের উন্নয়ন পরিবেশ ও পরিস্থিতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অধিক মাত্রায়। এক সরকার যা পরিকল্পনা করে, প্রায় ক্ষেত্রে পরের সরকার ক্ষমতায় এসে তা স্থগিত করে। অনেক ক্ষেত্রে বাতিল পর্যন্ত করে দেয়; গ্রহণ করে নতুন পরিকল্পনা। এতে খুব কম পরিকল্পনা ও প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৯৭-২০০১ মেয়াদের তৎকালীন আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে গৃহীত অনেক কর্মপরিকল্পনা বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ১০টি মিসিং লিংক বা সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও মনোরেল বা স্কাইরেল নির্মাণের পরিকল্পনা ২০০২-২০০৬ মেয়াদের বিএনপি জোট সরকারের আমলে বাস্তবায়নের তালিকায় ছিল না। তবে তখন শোনা গিয়েছিল যে জাপান সরকার তার নিজস্ব কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় ঢাকায় পাতাল বা মেট্রোরেল নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল, যার ওপর ভিত্তি করে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা প্রায়ই বলতেন, অচিরে ঢাকায় পাতালরেল নির্মিত হচ্ছে এবং ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে রাজধানী ঢাকার উত্তর থেকে দক্ষিণে আসা-যাওয়া করা যাবে। কিন্তু, অজ্ঞাত কারণে তখন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি। আবার বিএনপি জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণে গৃহীত প্রকল্পটি দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৭ সালের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাতিল করা হয়। তবে তখন বৃহত্তর ঢাকায় পরিচালিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (Strategic Transport Plan) বা এসটিপি অনুমোদিত হয়। যার আলোকে ওই সময় বিজয় সরণির পূর্বমুখী সম্প্রসারণ ও তেজগাঁও বিমানবন্দরের দক্ষিণে রিংরোডটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। কিন্তু এই পরিকল্পনার প্রধান প্রস্তাবনাগুলো; যেমন- ঢাকা গণপরিবহন উন্নয়ন প্রকল্প ‘MRT’, ‘LRT’ ও ‘BRT’ বাস্তবায়নে আজ অবধি কিছুই করা হয়নি।

এই অবস্থায় ২০০৯ সালে বিশাল ম্যান্ডেটে নির্বাচিত সরকারের শুরুতে ঢাকায় ভয়াবহ যানজট সমস্যা নিরসনে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় যেমন- সরকারি ও দাতা সংস্থার অর্থায়নে ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে (PPP), BOT, BOOT-টির ভিত্তিতে কিছু অবকাঠামোগত পরিবহন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তন্মধ্যে পূর্বে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান হয়ে পলাশী পর্যন্ত বিওটি ভিত্তিতে ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ পুনরায় শুরু হয়। পিপিপির মাধ্যমে ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনবিশিষ্ট একটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য ‘ইতাল-থাই’ নামক একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়। জাপানের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় মেট্রোরেল নির্মাণের সমীক্ষা সম্পন্ন হয়, যার ভিত্তিতে তখন প্রথম পর্যায়ে উত্তরা থেকে কমলাপুর হয়ে সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মেট্রোরেল রুট (MRT-6) নির্মাণের জন্য জাপান সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাশাপাশি সরকারি অর্থায়নে তুরাগ ও বুড়িগঙ্গা নদী ড্রেজিং করে টঙ্গীর আশুলিয়া থেকে সদরঘাট পর্যন্ত একটি ওয়াটার ওয়েস (Water Ways) চালুর ব্যবস্থা করা হয়। নগরের গুরুত্বপূর্ণ সব রেলওয়ে ক্রসিংয়ে আন্ডারপাস বা ওভারপাস নির্মাণের কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়, যার ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে বিমানবন্দর সড়কে কুড়িল মোড়ে রাজউকের নিজস্ব অর্থায়নে একটি ‘Interchange Flyover/Overpass’ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়। সেনাবাহিনীর প্রকৌশল কোরের তত্ত্বাবধানে বনানী রেলক্রসিং ও স্টাফ রোড়ের মোড়ে আরেকটি ওভারপাস কাম ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। চালু করা হয় নির্মাণাধীন যাত্রাবাড়ী-পলাশী ফ্লাইওভারের আংশিক। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে তেজগাঁওয়ে সাত রাস্তার মোড় থেকে মগবাজার-ইস্কাটন-মৌচাক সড়কে কুয়েত সরকারের অর্থায়নে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। পাশাপাশি রাজউকের অধীনে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) মাধ্যমে শান্তিনগর থেকে গুলিস্তান (গোলাপশাহ মাজার) ও বাবুবাজার হয়ে ঝিলমিল বা কেরানীগঞ্জ প্রকল্প পর্যন্ত আরও একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে, যা বর্তমানে বিনিয়োগকারী নিযুক্তির পর্যায়ে রয়েছে।
সমস্যাটা হলো, বিষয়গুলোর সমন্বয় ও কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করার জন্য কোনো দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নেই। বিআইডব্লিউটিএর অধীনে তুরাগ-বুড়িগঙ্গা নদীর ড্রেজিং করে সীমিত আকারে একটি ‘ওয়াটার ওয়েস’ চালু করা হলেও অল্প কিছুদিনের মাথায় তা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। যে কটা সড়ক মোড়ে ওভারপাস বা ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে, সেখানে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও নগরের যানজট সমস্যার কোনো উন্নয়ন হয়নি। নগরের প্রবেশপথে বনানী রেলক্রসিং ওভারপাস অতিক্রম করার পর টানা যানজট আগের মতোই রয়েছে। এই সমস্যা নিরসন হতো যদি কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ী-কুতুবখালী পর্যন্ত টানা এলিভেটেড রোড কিংবা ফ্লাইওভারটি নির্মিত হতো। ‘ইতাল-থাই’ গ্রুপের সঙ্গে সম্পাদিত ‘কনসেশন চুক্তি’ অনুসারে ২০১১ সালে কুর্মিটোলা থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত প্রস্তাবিত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ২০১৪-১৫ সালের মধ্যে তা শেষ হয়ে চালু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান অর্থের সংকুলান না করতে পারায় ও জমি অধিগ্রহণকেন্দ্রিক জটিলতায় অদ্যাবধি কাজটি শুরুই করা যায়নি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ৪০ একর ভূমি অধিগ্রহণের কোনো অগ্রগতি নেই। এই অবস্থায় গত বছরের (২০১৩ সালে) ডিসেম্বরে ‘ইতাল-থাই’ গ্রুপের সঙ্গে সংশোধিত ‘কনসেশন চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। অপেক্ষা এখন কখন এই কাজটি শুরু হবে।

‘ইতাল-থাই’ গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর বলা হয়েছিল, এই এলিভেটেড রোডটিকে রাজধানী ঢাকার অপরাপর সব কয়টি প্রবেশমুখের (উত্তরে জয়দেবপুর চৌরাস্তা, দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ, পূর্বে কাঁচপুর ও পশ্চিমে মাওয়া ঘাটে পদ্মা ব্রিজ) সঙ্গে বিস্তৃত করা হবে। একইভাবে মিরপুর-গাবতলী এবং সাভারকেও এলিভেটেড রোডের আওতায় আনার কথাও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু, অদ্যাবধি এসব ব্যাপারে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। একইভাবে অনেক দূর এগিয়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল বা যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত মেট্রোরেল রুটটির বাস্তবায়নের কাজও আজ পর্যন্ত শুরু করা যায়নি। অবশ্য এর পেছনে প্রধান অন্তরায় এই সব পরিকল্পনার রুট প্ল্যান বা এলাইনমেন্টকেন্দ্রিক জটিলতা। আগেই উল্লেখ করেছি, আমাদের দেশে একেক সময় বা সরকারের আমলে ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার অধীনে দাতা দেশ বা গোষ্ঠীর মাধ্যমে কিছু সমীক্ষা চালানো হয়, অতঃপর সরকার পরিবর্তনের পর তা থেমে যায় বা রুট পরিবর্তিত হয়। কখনো কখনো আবার নতুন কারও মাধ্যমেও ভিন্নভাবে সমীক্ষা পরিচালিত হয়, যার কারণে কখনো কোনো বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা পাওয়া যায় না। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কাজ হলেও তা কাক্সিক্ষতমাত্রায় হয় না। বাস্তবায়নাধীন যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান-পলাশী ফ্লাইওভারটির আংশিক চালু হলেও কখন এটির পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হবে তা এখনো নগরবাসীর কাছে স্পষ্ট নয়। তা ছাড়া এই ফ্লাইওভারটির নির্মাণে সমন্বয়হীনতার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে নানা সমস্যার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘ওরিয়ন-বেলহাসা গ্রুপ’ যাত্রাবাড়ী অংশে যেভাবে ফ্লাইওভারটির কাজ বাস্তবায়ন করেছে, তাতে সেখানে প্রস্তাবিত অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। মেট্রোরেল প্রকল্পের জাপানি বিশেষজ্ঞ তথা জাইকা বিষয়টি সরকারকে জানানোর পরও সেখানে ফ্লাইওভারটির একতরফা নির্মাণকাজ চালিয়ে যাওয়া হয়, ফলে যাত্রাবাড়ী দিয়ে ‘ইতাল-থাই’ গ্রুপের এলিভেটেড রোডটি আর নির্মাণ করা সম্ভব কি না এতে রয়েছে দারুণ সন্দেহ! অনুরূপভাবে কুড়িল মোড় ও মহাখালীতে নির্মিত ওভারপাসের কারণে বিমানবন্দর থেকে আগত এলিভেটেড রোডের বাস্তবায়ন নিয়েও রয়েছে সংশয়!
একইভাবে সংকটে আছে ঢাকার মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পটিও। জাপান সরকারের কারিগরি সহায়তায় ওই প্রকল্পের MRT-6 রুটের বাস্তবায়নের জন্য ডিজাইন কাজ ঠিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) বিশেষজ্ঞরা দুই বছর যাবৎ সমীক্ষা করে এই রুটটি চূড়ান্ত করেন। প্রকল্প ব্যয়ের ৮০ শতাংশ অর্থাৎ কম-বেশি ১৮০ কোটি ডলার সহজ শর্তে অনুদান প্রদানে জাপান সরকার সম্মত হয় এবং ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কাজটির বাস্তবায়নে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এই প্রস্তাবিত রুটটি বিজয় সরণি দিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে অল্প কিছু জায়গার ওপর দিয়ে স্থাপনের পরিকল্পনা হওয়ায় বিমানবাহিনী থেকে জোর আপত্তি ওঠে। তদস্থলে এটি জাতীয় সংসদ ভবনের কমপ্লেক্সের পূর্বদিকের জমির (খেজুরবাগানের) ওপর দিয়ে নির্মাণ করা নিয়ে সৃষ্টি হয় বিতর্কের। এর আগে মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার অভিযোগে পল্লবী এলাকায় ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় অসমন্বিতভাবে ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণে সেখানে ওই রুটটিতে সংশোধনী আনা হয়। প্রকাশ, বিমানবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সরকারকে এই মর্মে জানায় যে তারা বিজয় সরণি ও তেজগাঁও বিমানবন্দরের নিচ বা পাশ দিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণ করতে দেবে না। তাদের কথা, পরিত্যক্ত এই বিমানবন্দরটির দক্ষিণে বিজয় সরণির ওপর দিয়ে মেট্রোরেলের রুট গেলে তাতে সেখানে যুদ্ধবিমান উড্ডয়ন ও নামতে পারবে না, এতে বিঘ্নিত হবে ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তা। এসব বিষয় তুলে ধরে তারা প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করায় বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ করা রুটটিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করে। ওই অবস্থায় সংশোধিত রুটটি জাতীয় সংসদ ভবনের পূর্বদিকে খেজুরবাগান ও খামারবাড়ী-ইন্দিরা রোড়ের ওপর দিয়ে পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এতে জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের সৌন্দর্যহানি তথা সংসদ ভবনে শব্দদূষণ সমস্যাসহ খামারবাড়ী-ইন্দিরা রোড় ও ফার্মগেট এলাকায় অনেক ইমারত ও স্থাপনা ভাঙতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, কীভাবে রোকেয়া সরণি থেকে সংসদ ভবন প্লাজা হয়ে ইন্দিরা রোডের মোড়ে দ্রুতচালিত মেট্রোরেল ট্রেনকে উপযুক্ত টার্নিং রেডিয়াসে স্থাপন ও নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তা অস্পষ্ট! উল্লেখ্য, রোকেয়া সরণি থেকে খামারবাড়ী-ইন্দিরা রোডে প্রয়োজনীয় টার্নিং রেডিয়াস নিয়ে মেট্রোরেল লাইন নির্মাণে সংসদ প্লাজার পূর্ব দিকের ৫৫ মিটার (প্রায় ১৮০ ফুট) মতো জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হবে (সূত্র : ডেইলি স্টার, ১১ অক্টোবর ২০১১)। এতে সংসদ ভবনের পূর্ব প্লাজার সমগ্র খেজুরবাগানটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে! তা ছাড়া পরিবর্তিত রুটে মেট্রোরেল নির্মাণ করা হলে খামারবাড়ী এলাকায় জমির হুকুম-দখল, ইন্দিরা রোডে অবস্থিত ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালসহ আরও অনেক সরকারি-বেসরকারি ইমারত ও স্থাপনা ভাঙা এবং এগুলোর ক্ষতিপূরণ বাবদ ও পুনর্নির্মাণে সরকারকে বিশাল ব্যয় মেটাতে হবে।

অন্যদিকে বিশ্ব ঐতিহ্য (World Heritage) হিসেবে স্বীকৃত বাংলাদেশ সংসদ ভবনের জায়গার ওপর দিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণের ঘোষণার পর থেকে দেশের প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ, স্থপতি ও সুশীল সমাজ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। তাদের বক্তব্য, বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের ডিজাইন করা জাতীয় সংসদ ভবন না নগরের অভ্যন্তরস্থ পরিত্যক্ত বিমানবন্দরটি গুরুত্বপূর্ণ? বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদেও কয়েক দফায় তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। সাবেক স্পিকার আবদুল হামিদ বলেছিলেন, ‘সংসদ ভবনের জমির ওপর দিয়ে মেট্রোরেল নেওয়ার বিষয়ে কেউ কখনো তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেননি। জাতীয় সংসদ ভবনের এক ইঞ্চি জমিও মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য দেওয়া হবে না’ (দৈনিক আমাদের সময়, ৪ অক্টোবর, ২০১১)। আবার পরের দিনই বললেন ভিন্ন কথা, ‘জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশনে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৬ অক্টোবর, ২০১১)। কেউ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে সংসদে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলে সংসদ নেতার বিরাগভাজন হতে চাননি? এতদ্প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নিজে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বিমানবাহিনীর পক্ষে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন এবং যাঁরা বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করছেন তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে মত দেন। প্রধানমন্ত্রীর কথা, ‘একটা বিমানবন্দর বড়, নাকি কয়েকটা খেজুরগাছ বড়?’ এর আগে জাতীয় সংসদে সাবেক বিমানবাহিনীর প্রধান ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার জানান, তেজগাঁও বিমানবন্দরটি ১৯৯৮ সালে বিমানবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক বিমানবাহিনীর প্রধানের ওই বক্তব্য পেশাজীবী ও পরিবেশবাদীদের ভীষণভাবে আলোড়িত করে।
এর আগেও অনুরূপ এক খোঁড়া যুক্তিতে সংশ্লিষ্ট মহলবিশেষ কর্তৃক মহাখালী থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দরের নিচ দিয়ে রোকেয়া সরণি পর্যন্ত একটি টানেল নির্মাণের উদ্যোগকেও বাধাগ্রস্ত করা হয়। অথচ বিশ্বের অনেক দেশের বিমানবন্দরসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিচ কিংবা ওপর দিয়ে বা পাশঘেঁষে টানেল, পাতালরেল, মেট্রোরেল, স্কাইরেল ইত্যাদি স্থাপিত হয়েছে। লন্ডনে বার্মিংহাম রাজপ্রাসাদের নিচ দিয়ে লন্ডন পাতালরেলের রুট গেছে। কই, এ জন্য তো সেখানে রানি বা রাজপরিবারকে কখনো শঙ্কিত হওয়ার কথা শোনা যায়নি? কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর, লন্ডন, ভ্যানকুভারসহ বিশ্বের অনেক দেশের প্রধান বিমানবন্দরঘেঁষে ও বিমানবন্দরের নিচ দিয়ে তাদের বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা নির্মিত হয়েছে। আর ইউরোপের ছোট্ট দেশ জিব্রালটারে তাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাঝখান দিয়ে নগরের প্রধান সড়কটিই (উইনস্টন চার্চিল রোড) চলে গেছে, কই সেখানে তো কারও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। একটি পরিত্যক্ত বিমানবন্দরকে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্থাপনা জাতীয় সংসদ ভবনের জায়গা ও ল্যান্ডস্কেপিং নষ্ট করে মেট্রোরেল নির্মাণ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত এবং জনমনে যে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে তা সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখেছেন কি? কেউ চায় না কুচক্রীমহলের ষড়যন্ত্রে বা অদূরদর্শিতায় মেট্রোরেল প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে আরেকটি ‘আড়িয়াল বিলের’ পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক। ১৯৫৯ সালে ঢাকার প্রথম মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে নগর বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন যে নগরের অভ্যন্তর থেকে বিডিআর, ক্যান্টনমেন্ট, জেলখানা ইত্যাদি স্থাপনাগুলো বাইরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য, কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতিতে কোনো সরকারই তা বাস্তবায়ন করেনি। জাতি এর মূল্য দিচ্ছে ৪২ বছর ধরে। সর্বশেষ ২০০৯ সালে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের তদন্তে বলা হয়েছে, নগরের ভয়াবহ যানজটের কারণে (ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনারা মুভ করতে না পারায়!) তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে সেনা পাঠিয়ে ওই বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, পুরান ঢাকায় জেলখানা, পিলখানায় বিডিআর আর উত্তরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিশাল সংরক্ষিত জায়গার কারণেই আজকের ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থার এত দুর্গতি। এভাবে ব্যক্তি বা মহলবিশেষের স্বার্থে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা তথা দেশের উন্নয়নে গৃহীত আরও অনেক প্রকল্প ও প্রস্তাবনা ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে আছে।

২০০৯-২০১৩ মেয়াদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার প্রাক্কালে ঢাকার উন্নয়নে একটা ‘রূপকল্প’ (Vision-2021) ঘোষিত হয়। কিন্তু উপরিউক্ত বর্ণনামতে, অসমন্বিত পরিকল্পনা ও বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় জড়িয়ে এত দিন এর কিছুই বাস্তবায়ন করা যায়নি। দেখা যায়, বাংলাদেশে কিছু একটা উদ্যোগ নিলে তাতে বিভিন্নভাবে প্যাঁচ লেগে যায় বা মহলবিশেষ কর্তৃক বিভিন্ন অজুহাতে অঙ্কুরেই তা নষ্ট হয়ে যায়। কে জানে, ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পটির ক্ষেত্রেও অনুরূপ কোনো চক্রান্ত চলছে কি না! পাতালরেল ও মনো বা স্কাইরেল নির্মাণের সম্ভাব্যতার ওপর এ পর্যন্ত অনেক সমীক্ষা হয়েছে, কিন্তু কার্যত কিছুই এগোয়নি। কারণ, দেশের বিবদমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দাতা সংস্থা বা বিনিয়োগকারীদের থেকে সাড়া মেলেনি আশানুরূপ। এ রকম একটা নাজুক অবস্থায় নগরের ভয়াবহ যানজট থেকে পরিত্রাণ লাভে জাপান সরকারের সহায়তায় যে আশার আলো দেখা গিয়েছিল তা অঙ্কুরে বিনষ্ট হোক তা কেউই চায় না। মেট্রোরেল প্রকল্পটির কাক্সিক্ষত বাস্তবায়ন না হলে, ভবিষ্যতে নগরে আর কোনো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে কি না সন্দেহ! তাই সরকার যদি সত্যিই মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যাপারে ‘সিরিয়াস’ হয়, তাহলে কোনো গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থ না দেখে বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ মোতাবেক প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে যা হোক, ঢাকায় প্রস্তাবিত মেট্রোরেল স্থাপনের ক্ষেত্রে যে জাপান সরকার আন্তরিক তা তাদের কার্যক্রম থেকেই বোঝা যায়। উল্লেখিত বিভিন্ন সমস্যার মধ্যেও জাপান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচ্য মেট্রোরেল প্রকল্পের বাস্তবায়নে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। গত বছরের ১৫ নভেম্বর প্রকল্পের বিস্তারিত ডিজাইন তৈরি, নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধায়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বহুমুখী আন্তর্জাতিক পরামর্শক কনসোর্টিয়ামের সঙ্গেও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। জাইকার পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১৫ সালে কাজটি শুরু হয়ে ২০২১ সালের মধ্যে তা শেষ ও চালু হওয়ার কথা।
তাই এখন সবকিছু নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার ওপর। কদিন আগে তাঁর সরকার পুনর্নির্বাচিত হয়েছে। বহুদিন পর দেশে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে নতুন সরকার। আগামী ২০৪১ সালকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক নতুন আরেকটি ‘রূপকল্প’ (Vision-2041) ঘোষণা করেছে। আশার কথা, ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পূর্বেকার রূপকল্পে প্রস্তাবিত মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে বিশেষ নজর দিয়েছেন। তিনি ঢাকার এলিভেটেড রোড ও মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। সার্বিক বিবেচনায় ঢাকার পরিবহন সমস্যা উত্তরণে বর্তমানে সমগ্র নগরজুড়ে ও নগরের বিভিন্ন প্রবেশপথে ক্ষেত্রবিশেষে ফ্লাইওভার কিংবা এলিভেটেড রোড, মেট্রোরেল বা পাতালরেল নির্মাণের বিকল্প নেই। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ অগ্রাধিকার পেলে কোনো প্রকল্পই বাস্তবায়িত হবে না। বিশেষ করে জাপানি আর্থিক সহায়তায় মেট্রোরেল নির্মাণের প্রস্তাবটি কোনো অবস্থায় হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। ইতিপূর্বে আরেকবার (২০০২-০৫ সালে) জাপানি সহায়তায় ঢাকার মধ্যভাগ দিয়ে পাতাল বা মেট্রোরেল নির্মাণের প্রস্তাবনায় সরকারের পক্ষ থেকে সময়মতো সাড়া বা সম্মতি না পাওয়ায় তখন ওই প্রকল্পটি থেকে ঢাকাকে বাদ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। তাই এ ধরনের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নেতৃত্বের মধ্যে মতৈক্যের প্রয়োজন। এ জন্য আরও প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে তাঁর সভাপতিত্বে অথবা একজন অভিজ্ঞ জ্যেষ্ঠমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি বিশেষ সেল প্রতিষ্ঠা করা, যার মাধ্যমে যথাযথ সমন্বয় ও মনিটরিং করা যাবে। পাশাপাশি, সরকারকে ঢাকার অভ্যন্তর থেকে বেশকিছু স্থাপনাকে নগরের বাইরে পাঠিয়ে বা বিকেন্দ্রীকরণে (প্রয়োজনে বাধ্য করে) নিতে হবে সক্রিয় পদক্ষেপ। সবকিছু ঢাকামুখী করার প্রবণতা রোধ করতে হবে। দেশের বিভাগীয় শহর, পৌর এলাকা ও উপজেলাগুলোকে যথাসম্ভব অধিকতর বসবাসযোগ্য ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে উদ্যোগ নিতে হবে এখনই।
মো. এমদাদুল ইসলাম
প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৭ তম সংখ্যা, মার্চ ২০১৪