যোগাযোগে ভেনিসের সৌন্দর্য দ্য গ্র্যান্ড ক্যানাল

ইতালির ভেনিসে যাবেন আর বিশ্বের জাদুকরী নগরটি দেখবেন না তা কি হয়! আদ্রিয়াতিক (Adriatic) সাগরের তীরবর্তী স্থানটিতে এলেই এক স্বপ্নময় ও জাদুকরী নগর বলে মনে হয়; এ যেন সমুদ্রের মাঝে ভাসমান কোনো স্বপ্ন নগর। নগরটি এতটাই শিল্পময় ও সংস্কৃতিমনা যে এখানে আপনি আপনার অবারিত স্বপ্ন ও কল্পনাকে বিস্তৃত করতে পারবেন বহুদূর অবধি। জাদুর তৈরি নগর না হলেও ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক এক নগর এটি; যার রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। রয়েছে দ্য গ্র্যান্ড ক্যানালের মতো বিশ্বখ্যাত ঐতিহ্য।

সরু রাস্তায় বাস, ট্রাক ও গাড়ির জট, জনবহুল ফুটপাতের অনেকটাই হকারদের দখলে আর ভিক্ষুকের আনাগোনায় ভেনিস অন্য সাধারণ ঘনবসতিপূর্ণ শহরের মতো আরেকটি শহর মাত্র। তবে অন্য শহর থেকে এর ভিন্নতা পানির ওপর ভাসমান পাথরের ঘরবাড়ি, অসংখ্য ক্যানাল তথা খালে ভাসমান হরেক আকার, আকৃতি ও নকশার বৈচিত্র্যময় নৌকায়। ভেনিসবাসী বাস বা গাড়িতে ভ্রমণের চেয়ে নৌকায় ঘুরে বেড়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বেশি। আর তাই নৌকাই ভেনিসে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম।

দ্য গ্র্যান্ড ক্যানাল প্যানারমা ভিউ

ইতিহাসসমৃদ্ধ ভেনিসের ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে শাখা-প্রশাখার মতো জড়িয়ে আছে  ক্যানালগুলো, যা নগরের চাহিদা অনুযায়ী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আকার-আকৃতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। ভেনিসে মোট ক্যানালের সংখ্যা ১৫০-এরও বেশি, যেগুলোতে ৪০০টিরও বেশি আকার ও নকশাগত ভিন্নতা দৃশ্যমান। ভেনিসের সবচেয়ে বড়, পুরোনো, ঐতিহাসিক, শিল্প-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ‘The Grand Canal’ (দ্য গ্র্যান্ড ক্যানাল), যা স্থানীয়ভাবে ‘Canal Grand’ বা Canalasso নামে পরিচিত। এটি ভেনিসের অন্যতম প্রধান নৌপথ। ভেনিসে বিশালাকারের এ খালে সর্বসাধারণ চলাচল করে নৌবাস, যা স্থানীয়ভাবে Vaporetti নামে পরিচিত। এ ছাড়া আছে ভাড়ায় চালিত নৌ-গ্রাক্সি, তেমনি আছে বিলাসবহুল প্রমোদতরি। ক্যানালটির বিস্তার সান্তা লুসিয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিখ্যাত স্থাপনা সেইন্ট মার্ক বেসিন পর্যন্ত; দেখতে অনেকটাই যা ইংরেজি S অক্ষরের মতো। ভেনিস শহরের প্রাণকেন্দ্র দিয়ে বয়ে চলা খালটি দৈর্ঘ্যে তিন হাজার ৮০০ মিটার, প্রস্থে ৩০ থেকে ৯০ মিটার আর গভীরতা কমবেশি ১৬ দশমিক ৫ ফুট। এর দুই পাড়ে রয়েছে প্রায় ১৭০টির মতো বাড়ি, যেগুলো এয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে নির্মিত, যা ভেনিসের অভিজাত্য, ঐশ্বর্য ও শিল্পকলার নিদর্শন।

ভেনিসে বসবাসরত বিত্তবানেরা তাঁদের সম্পদ ও রুচি প্রদর্শনের জন্য বেছে নিয়েছেন এ ক্যানেলের দুই পাড়কে। আর তাই তো দুই পাড়ের বাড়িগুলোকে বাড়ি না বলে বলা যায় এক-একটা প্রাসাদ। এখানকার প্রতিটি বাড়িরই রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও আভিজাত্য। তারপরও কিছু বাড়ির নাম আলাদাভাবে না বললেই নয়। এর মধ্যে রয়েছে- Palazzi Basbaro, Co’Rezzonico, Ca’d’Oro, Palazzo Dario, Co’Foscari, Palazzo Barbarigo, Palazzo Venies dei leoni। বিশ্বের আর কোথাও একসঙ্গে এত অনুপম সৌকর্যমণ্ডিত শৈল্পিক বাড়ি একসঙ্গে দেখা যাবে না, যেগুলো প্রায় ৬০০ বছরের শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক।

রাতের ভেনিস নগরী ও বাড়িগুলোর মধ্যে সংযোগকারী পুল

দ্য গ্র্যান্ড ক্যানাল শহরের প্রাণকেন্দ্র দিয়ে প্রবাহিত হলেও মজার ব্যাপার হলো ঊনবিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত এর ওপর ছিল মাত্র একটি সেতু; ঐতিহাসিকভাবে যা ‘The Rialto Bridge’ নামে প্রসিদ্ধ। বর্তমানে সেতুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিনটিতে, যার মধ্যে রয়েছে ‘The Ponte Degli Sealzi, The Ponte dell’Accademia এ সময়ের The Ponte della Costituzione. যার নকশা প্রণয়ন করেছেন স্থপতি Santiago Calatrava, যা কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনের সঙ্গে Piazzale Rome-কে সংযুক্ত করেছে। সাশ্রয়ী হওয়ায় এখানকার সাধারণ মানুষ ফেরিতে করে ক্যানাল পার হতে বেশি পছন্দ করে। 

দ্য গ্র্যান্ড ক্যানালের উৎপত্তি হয়েছিল প্রাচীন নদীর শাখা (ধারণা করা হয়, সেটি The Brenta নদী) থেকে যা মিশে ছিল উপহ্রদের সঙ্গে। রোমান শাসনামলের আগে Rio Businiacus সম্প্রদায় প্রথম এখানে বসতি স্থাপন করে, যারা পরবর্তী সময়ে Adriotic Veneti নামে পরিচিতি পায়। আদ্রিয়াতিক সাগরের পাড়ে বসবাসের কারণে তাদের এ নামে ডাকা হতো। এরা পেশায় ছিল জেলে ও লবণ ব্যবসায়ী। রোমান শাসনামলে এবং তৎপরবর্তী বাইজানটাইন শাসনামলে জনবহুল অঞ্চলটি ব্যবসার জন্য হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে বিশেষত আটা ও লবণের ব্যবসার কারণে এটি একটি বাণিজ্যিক নগরে রূপান্তরিত হয়। এই সময় ব্যবসায়ীরা গ্র্যান্ড ক্যানালকে তাঁদের বাণিজ্যিক জাহাজ রাখার নিরাপদ স্থান হিসেবে ব্যবহার করতেন। এ সময়টা গ্র্যান্ড ক্যানাল ছিল অনেক বেশি প্রশস্ত ও গভীর।

দ্য গ্র্যান্ড ক্যানাল প্যানারমা ভিউ

 ১১৪১ সালে প্রকৌশলী Nicolo Baratleisi ভেনিসের Rialto ও Mereerie-এর মধ্যে সংযোগকারী সেতু তৈরি করেন, যা গ্র্যান্ড ক্যানালের প্রথম সেতু। পরে অনেকবারই এটির সংস্কারের পাশাপাশি করা হয় সম্প্রসারণ। দুই পাড়ে বসে কিছু দোকান। ব্যবসার পরিসর বাড়ায় ক্যানালের দুই পাড়ে ব্যবসায়ীদের বসবাস বাড়ায় বিলাসবহুল বাড়ি তৈরির প্রবণতাও বাড়তে থাকে। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাঁধানো হয় সম্পূর্ণ গ্র্যান্ড ক্যানালের দুই পাড়। জাহাজ থেকে মালামাল খালাসের জন্য স্থাপন করা হয় একটি ডকইয়ার্ড।

দ্য গ্রান্ড ক্যানালসহ অন্য ক্যানালগুলো বর্তমানে ভেনিসের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম। এখানে যেমন চলছে নৌবাস, নৌ-অ্যাম্বুলেন্স, মালবাহী ও বর্জ্যবাহী নৌকা, নৌ-ট্যাক্সি ও ব্যক্তিগত নৌকা, তেমনি চলছে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ট্রাফিক নৌকা। নৌপথ যেহেতু ভেনিসের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম, তাই এর সঠিক ব্যবস্থাপনায় কর্তৃপক্ষকে নিতে হয়েছে শৃঙ্খলিত ট্রাফিকব্যবস্থা, প্রণয়ন করতে হয়েছে নানা আইনকানুন। প্রচুরসংখ্যক নৌ-ট্রাফিক পুলিশ, নৌ-ট্রাফিক বোট এবং পর্যবেক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ কঠোর তদারকিতে সম্পূর্ণ পরিবহনব্যবস্থাকে রেখেছে ঝামেলামুক্ত ও নিয়ন্ত্রিত।

শহরকে ঘিরে জালের মত বিস্তৃত খাল

ভেনিসের এই ক্যানালগুলোর মাধ্যমে নগরের অভ্যন্তরীণ পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা এখনো পর্যন্ত অনেকটাই সহনশীল। অথচ অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো, নদীমাতৃক এই দেশে আমাদের ঢাকা শহরকে ঘিরে অনেক নদী, শাখা ও উপনদীসহ অসংখ্য খাল থাকা সত্ত্বেও এগুলোর উপযুক্ত ব্যবহার করতে আমরা অপারগ। অযত্ন, অবহেলা ও অবৈধ দখলের কবলে খালগুলো আজ রূপ নিয়েছে ড্রেনে। গাবতলী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ওয়াটারওয়ে ঘিরে নৌবাস সার্ভিস চালু হলেও অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আজ যা পরিণত হয়েছে বোঝায়। ভেনিসবাসী যেখানে কৃত্রিমভাবে ক্যানাল তৈরি করে চমৎকার ও সাশ্রয়ী বিকল্প যোগাযোগ মাধ্যম তৈরি করেছে, সেখানে আমরা প্রাকৃতিকভাবে প্রদত্ত খালগুলোকে ব্যবহার করে একটি বিকল্প যোগাযোগ মাধ্যম তৈরি করতে পারিনি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটু যত্নবান হলে যা খুব সহজেই করা সম্ভব।

আশিক মাহমুদ

[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৮ তম সংখ্যা, এপ্রিল ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top