প্রকৌশল পেশাটি হোক সেবামূলক

নিজের প্রকৌশল পেশাকে একটা সেবা হিসেবে দেখেন। যার ফলে যার যা দেওয়ার সামর্থ্য, তা নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। কাউকে চাপ দিয়ে বাড়তি টাকা নিতে তিনি নারাজ। স্থাপনা ডিজাইনের সম্মানি নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো বাঁধাধরা হার নেই। সেবা করার মানসিকতা নিয়েই কাজ করেন। তিনি চান মানুষ যেন ভবন নির্মাণে সচেতন হয়। অজ্ঞ রাজমিস্ত্রির বদলে একজন দক্ষ প্রকৌশলীকে দিয়েই স্বপ্নের ভবনটি নির্মাণ করে। সেবামূলক মানসিকতা নিয়ে কাজ করা এ প্রকৌশলীর নাম মোফাজ্জল হোসেন। তিনি ময়মনসিংহ গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত। পাশাপাশি নেত্রকোনার মোক্তারপাড়ায় অবস্থিত গোল্ডেন পালস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং- এ খন্ডকালীন প্রকৌশল কাজ পরিচালনা করেন।

বন্ধনের নিয়মিত আয়োজন ‘প্রকৌশলীর গল্প’ পর্বে স্বনামধন্য এ প্রকৌশলীর কথোপকথন জানাচ্ছেন মাহফুজ ফারুক

প্রকৌশলী মোফাজ্জল হোসেন ১৯৭৪ সালের ৩১ অক্টোবর ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আব্দুল মান্নান সরকার ও মা আনোয়ারা বেগম। তিনি ১৯৯০ সালে কালিরবাজার উচ্চবিদ্যালয়, ত্রিশাল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৯৩ সালে ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। এরপর একটি বেসরকারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। পরবর্তী ১০ বছরে একে একে বেশ কিছু নির্মাণ প্রকল্পে সাইট ও প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়েও চালিয়ে যান ড্রয়িং-ডিজাইন ও কনসালট্যান্সি। ২০০৪ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরে যোগ দেন। প্রথমে নেত্রকোনা ও পরে বদলি হন ময়মনসিংহে। সপ্তাহে এক দিন গোল্ডেন পালস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে করছেন ব্যক্তিগত প্রকৌশল চর্চা তথা কনসালট্যান্সি।

এমদাদুল হক ভবন, সাতপাই, নেত্রকোনা

নেত্রকোনায় গিয়ে মোফাজ্জল হোসেন উপলব্ধি করেন শহরটিতে উন্নয়নের ছোঁয়া খুব কমই লেগেছে। বহুতল ভবন একেবারে হাতে গোনা। তা ছাড়া ভবনগুলোও গতানুগতিক, তাতে নান্দনিকতার কোনো ছাপ নেই। প্রকৌশলীকে দিয়ে তেমন কেউ ভবন ডিজাইন ও নির্মাণ করত না। অধিকাংশ ভবনের নির্মাণকাজ করত রাজমিস্ত্রি ও ঠিকাদারেরা। ফলে ভবনগুলো যেমন হতো সৌন্দর্যহীন, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ। এই উপলব্ধি থেকে তিনি শহরবাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, একজন দক্ষ প্রকৌশলীকে দিয়ে ভবন ডিজাইন করালে যেমন হবে নান্দনিক তেমনি টেকসই ও নিরাপদ। এই প্রচেষ্টায় তিনি খুব যে সাড়া পেতেন, তা কিন্তু নয়। প্রকৌলশীকে বাড়তি টাকা দিয়ে ডিজাইন-ড্রয়িং করাতে তেমন কেউ রাজি ছিলেন না।

মোফাজ্জল হোসেন এই বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। শুরু করেন কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই ড্রয়িং-ডিজাইন। কখনো-বা এক কাপ চা বা নাশতার বিনিময়েও অনেক মানুষকে ভবনের ডিজাইন করে দিয়েছেন। আর সেসব ডিজাইন অনুসরণ করে যখন ভবনগুলো নির্মিত হতে থাকল, তখন সেগুলো হয়ে উঠল গতানুগতিক ভবন থেকে আলাদা; নান্দনিক। চমৎকার এসব ভবন দেখে নিজেদের স্থাপনাটিও মোফাজ্জল হোসেনকে দিয়ে ডিজাইন করাতে অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠল। এভাবে অসংখ্য ভবন তিনি ডিজাইন করেছেন। নেত্রকোনা শহর উন্নয়নের পেছনে তাঁর রয়েছে অসামান্য অবদান। এমনকি জেলাটির প্রতিটি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল, পার্শ্ববর্তী জেলা ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জেও রয়েছে তাঁর ডিজাইন করা ভবন।

সাইফুল ইসলাম ভবন, নেত্রকোনা

প্রকৌশলীকে দিয়ে ডিজাইনের চল শুরু হলেও দেখা দেয় আরেক সমস্যা। নেত্রকোনার বাজার তখন নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রীতে সয়লাব। বেশি দাম দিয়ে কেউ নির্মাণপণ্য কিনতে চাইত না বিধায় ব্যবসায়ীরাও নিম্নমানের সামগ্রীগুলোই বিক্রি করত। এতে ভবনের ডিজাইন ও নির্মাণকাজ যত ভালোই হোক না কেন, নির্মাণত্রুটি ও ঝুঁকি থেকেই যেত। তিনি ব্যবসায়ীদের ভালো মানের পণ্য বিক্রিতে উৎসাহিত করেন। শুধু তা-ই নয়, সেগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ^স্ত করেন। এভাবে তাঁর পরামর্শে প্রকৌশলীর মাধ্যমে ভবন ডিজাইনের পাশাপাশি নির্মাণেও শুরু হয় গুণগতমানের পণ্য বিক্রি। আর যারা কিছু টাকা বাঁচাতে ভালো ব্র্যান্ডের পণ্য ব্যবহার করতে চাইত না, তাদের কাছ থেকে ডিজাইনের জন্য পারিশ্রমিক না নিলেও দাবি করতেন তারা যেন উৎকৃষ্ট মানের পণ্য ব্যবহার করে। এভাবে তিনি গুণগত মানের নির্মাণপণ্য ব্যবহারেও নির্মাতাদের উৎসাহিত করেন।

প্রকৌশলী মোফাজ্জল হোসেন বিয়ে করেছেন ২০০০ সালে। তাঁর স্ত্রী আছমা আক্তার। তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে ঢাকায় কর্মরত। এ দম্পতির এক মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে মায়িশা তাসনিম রাফা, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে আহনাফ ফুয়াদ ফাতিল মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেছে। মোফাজ্জল হোসেন ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি), বাংলাদেশ পিডব্লিউডি ডিপ্লোমা সমিতি ও ময়মনসিংহ আইডিইবির সদস্য।

নরেশ চন্দ্র ভবন, জয়নগর, নেত্রকোনা

প্রকৌশলী মোফাজ্জল হোসেন সেবামূলক মনোভাব নিয়ে সুনামের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রকৌশল চর্চা। অনেক প্রকৌশলী ডিজাইন করেন, কিন্তু ভবন নির্মাণের সময় সুপারভিশন করেন না। ফলে প্রায়ই দেখা যায় মিস্ত্রি বা ঠিকাদারেরা নিজেদের সুবিধার জন্য তা পরিবর্তন করে ফেলে। এ জন্য তিনি ভবনের স্ট্রাকচার নির্মাণের সময় যথাযথভাবে সুপারভিশন করেন/করান। বিশেষ করে ফাউন্ডেশন, ছাদ ও সিঁড়ি নির্মাণের সময় নিজে উপস্থিত থাকেন। কারণ স্ট্রাকচারে কোনো সমস্যা হলে তা ভবনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এখনো তিনি নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ ও ট্রেনিং করেন নিজের প্রকৌশল জ্ঞান বাড়াতে। মোফাজ্জল হোসেনের মতে, বর্তমানে তরুণ প্রকৌশলীদের মধ্যে শেখা, জানা ও সেবার মনোভাবের ঘাটতি রয়েছে। অনেকে বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে এলেও দেখা যায় বাস্তবজ্ঞান সীমিত। এ জন্য যাঁরা নিজেকে একজন সত্যিকারের নির্মাণ প্রকৌশলী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তাঁদের প্রতি মোফাজ্জল হোসেনের আহ্বান, তাঁরা যেন শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই ডিজাইন ও নির্মাণকাজের আদ্যোপান্ত আয়ত্ত করে নেন।

প্রকাশকাল: বন্ধন ১৬৬ তম সংখ্যা, জুন ২০২৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top