কোনো পরিস্থিতিতেই হাল ছাড়া নয়

প্রাকৃতিক নৈসর্গের লীলাভ‚মি সিলেট। তবে এই এলাকার মৌলভীবাজার জেলার সৌন্দর্য সে তুলনায় অনেকটাই বেশি। এখানকার চা বাগান, অরণ্য, লেক, পাহাড়, ঝরনা সবকিছুর মাঝেই রয়েছে মনকাড়া মাদকতা। এই এলাকার জনবসতি বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় বেশ কম। কখনো দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ, কখনো আবার চায়ের সুসজ্জিত বাগান মনকে এনে দেয় এক অনাবিল প্রশান্তি। বন্ধনের নিয়মিত আয়োজন ‘সফল যারা কেমন তারা’ পর্বটির জন্য এবার ঘুরে এলাম মৌলভীবাজারের শমসেরনগর নামক জায়গা থেকে। একজন মানুষের জীবন কতটা সংগ্রামময় হতে পারে, সেই জীবন গাঁথার কিছুটা রইল পাঠকদের জন্য।

ঢাকা থেকে মৌলভীবাজারে পৌঁছানোর পর আমার সঙ্গী হলেন আকিজ সিমেন্টের অত্র এলাকার টেরিটরি অফিসার মিথুন কুমার চ্যাটার্জি। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন শমসেরনগরের মেসার্স সুমিতা ট্রেডার্সে। যেতে যেতে চোখ ভরে উপভোগ করলাম এই এলাকার সৌন্দর্য। দোকানটির মালিক মোঃ সগির উদ্দিন মাস্টার আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। সেখানে আর উপস্থিত ছিলেন আকিজ সিমেন্টের ওই এলাকার এসআই মি. রাকিব। দোকানে তখন বেশকিছু স্থানীয় মানুষের খোশগল্প চলছিল। পুরো দোকান নানা ধরনের মালামালে সজ্জিত। তিনি বিনয়ের সাথে বললেন, তিনি সাধারণ একজন ব্যবসায়ী, তাকে নিয়ে লেখালেখির কিছু নেই। তবুও জানতে চাইলাম তার জীবনের কিছু কথা। খুব খেটে খাওয়া মানুষ তিনি। সংসারের অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। সে কারণেই খুব ছোট বয়সেই জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার শমসেরনগর ইউনিয়নের সিংরাউলি গ্রামে তার জš§। তার পিতার নাম মৃত ইন্তাজ মিয়া এবং মায়ের নাম সুমিতা বেগম। ৫ ভাই ও ৩ বোনের সংসারে তিনিই সবার বড়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার কাঁধে সংসারের দায়িত্বটা চলে আসে। ছোট থাকতেই শুরু করেন কেরোসিন, সরিসাসহ বিভিন্ন ধরনের তেলের ব্যবসা। এলাকার হাটগুলোতে প্রতি হাটবারে দোকান নিয়ে বসতেন। এতে প্রতিহাটে ৫০-১০০ টাকার মত লাভ থাকত। আস্তে আস্তে ভাল মুনাফা আসতে থাকে এই ব্যবসায়। দেড় থেকে দুবছর পর আগের ব্যবসার মুনাফার টাকা দিয়ে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। শ্রীমঙ্গল থেকে কাপড় কিনে মৌলভীবাজারের বিভিন্ন হাটে ফেরি করে কাপড় বিক্রি করতেন। তার বাবাও এই ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি তাকে উৎসাহ দিতেন। এভাবে ব্যবসা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে তিনি শুধু ব্যবসায় করেননি। হালচাষ, ফসল ফলানোসহ বাড়ির অন্যান্য কাজগুলোও করতেন। এগুলো মধ্যেই তিনি থেমে থেকেছেন তা কিন্তু নয়। পাশাপাশি চালিয়ে গিয়েছেন নিজের পড়াশোনা। এই ব্যবসার মধ্যদিয়েই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুল ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৭০ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন মৌলভীবাজার কলেজে। এইসএসসি পরীক্ষার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশন পদে পরীক্ষা দেন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় তিনি কৃতকার্য হন। কিন্তু আইএসএসবি থেকে বাদ পড়ে যান। সে সময়ে খুব খারাপ লেগেছিল তার। সফল হলে হয়ত তার জীবনটা অন্যরকম হতে পারত।

এসবের মাঝেই বেশ ভালই চলছিল তার সংগ্রামী জীবন। সময়টা ছিল ১৯৭১, দেশে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। গ্রামের সবার মত তিনিও সীমানা পেরিয়ে ভারতে চলে যান। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেখানে বেশি দিন থাকতে পারেননি। ফিরে আসতে হয় দেশে। তখন শমসেরনগরে যুদ্ধের ভয়াবহতা বর্ণনাতীত। বাধ্য হয়ে মামার বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে তখন হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কয়েকজন যুবক একত্রে চলাফেরার কারণে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর মনে করে স্থানীয় কিছু পাকিস্থানি দালাল ক্যাম্পে অভিযোগ করেন। ফলে সেখান থেকে আবার নিজ এলাকায় চলে আসতে হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন।

কিন্তু ব্যবসা যেন তার রক্তে মেশা। শিক্ষকতার পাশাপাশি শমসেরনগর বাজারে দোকান নিয়ে স্টেশনারি ও গ্রসারীর ব্যবসা শুরু করেন। বেশ ভালভাবেই তিনি ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকেন। ধীরে ধীরে ব্যবসা প্রসার হতে থাকে। ১৯৮৪ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বর্তমানে তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। মেয়ে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করে। ছেলে সবেমাত্র এইসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এক কথায় বলা যায় ছোট্ট সুখের সংসার। তবে নিজের সংসার ছাড়াও সব ভাইদের পড়াশোনার ব্যাপারেও যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। তারা সবাই আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে সাবলম্বী। ব্যবসার মুনাফার টাকা দিয়ে বাজারে আরো একটি দোকান ক্রয় করেন। নতুন দোকানটিতে হার্ডওয়্যারের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু দোকানটি কিনেছিলেন তার ভাইদের নামে। ভাইয়েরা বিভিন্ন কৌশলে তার কাছ থেকে দোকানটি তাদের নিজের করে নেয়। কষ্ট পেলেও পারিবারিক কারণে তিনি তাদেরকে তা দিয়ে দেন। এছাড়াও আরেক ভাইকে বিদেশ পাঠানোর জন্য ৩০-৩৫ লাখ টাকা খরচ করেন। ফলে তিনি প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েন এবং তার অর্থনৈতিক অবস্থা হয়ে পড়ে শোচনীয়। এত কিছুর পরও থেমে থাকেননি তিনি। সুমিতা হার্ডওয়্যার নামেই আবার নতুন উদ্যমে ব্যবসা শুরু করেন। একপাশে হার্ডওয়্যার অন্যপাশে স্টেশনারি। সে সময়ে তিনি সিমেন্ট ব্যবসার সাথেও যুক্ত হন। সেই দুঃসহ সময়ে পাশে এসে দাঁড়ান লন্ডন প্রবাসী তার এক বন্ধু। প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ধার দেন তাকে ব্যবসা দাঁড় করাতে। এছাড়াও পুরোনো ব্যবসায়ীরা ধারে মাল দিয়ে তাকে সহযোগিতা করেন। তার সেই বন্ধুটির প্রতি কৃতজ্ঞা প্রকাশ করতে একবারও কুণ্ঠাবোধ করেননি। দিনে দিনে আবারো তার ব্যবসা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সিমেন্ট ও রডের ব্যবসায় এসেছে সফলতা। চা বাগানে ডানকান ব্রাদার্স নামক কোম্পানিতে স্টেশনারি দ্রব্যাদি সরবরাহ করতেন। এখনো তা সুনামের সাথে অব্যাহত রেখেছেন।

ছেলেবেলার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পিতার সম্পদ বলতে তেমনকিছু ছিল না। সম্পূর্ণ পরিশ্রম ও মেধার বলেই আজকের এই অবস্থানে আসতে পেরেছেন। তবে এতকিছুর পরও নানা রকম খেলাধুলা করতেন। কাবাডি, ফুটবল তার পছন্দের খেলা। বিল থেকে প্রচুর মাছ ধরতেন। ঘুড়িও উড়িয়েছেন অনেক। কলেজ জীবনে নাটক করতেন। বিভিন্ন সামাজিক নাটক করতে তার দল নিয়ে চলে যেতেন মৌলভীবাজারে। পরবর্তীতে নাটক পরিচালনাও করতেন। এগুলোর স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন নানা পুরস্কার। যাত্রাপালা তার বেশ প্রিয় ছিল। সে সময়ে বিভিন্ন চা বাগানে যাত্রাপালার আয়োজন করা হত। সেখানে চলে যেতেন যাত্রা পালা দেখতে। সিনেমা দেখতে সিলেটেও গিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। তার দোকানে বিভিন্ন বয়সী মানুষ আসে। তারা এখানে গল্প-গুজবে মেতে থাকেন। প্রতিদিন দোকানে অন্তত ৪-৫টি পত্রিকা রাখা চাইই। কারণ পত্রিকা পড়তে তিনি খুব ভালবাসেন। এছাড়াও টিভিতে টকশোগুলো তার বেশ ভাল লাগে। ব্যবসায় ব্যস্ততার পাশাপাশি অবসরে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যান। এসব কর্মকাণ্ড তার সাংস্কৃতিক মনেরই পরিচয় বহন করে। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজের সাথে জড়িত। এতিমখানা, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ অসহায় মানুষকে তিনি নানাভাবে সহযোগিতা করেন।

একজন মানুষ কিভাবে সফল ব্যবসায়ী হতে পারে প্রশ্ন করেছিলাম তাকে। তিনি বলেছিলেন, কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। পাশাপাশি সততা থাকতে হবে। এছাড়াও কাস্টমারের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখা, সঠিক ওজন, ন্যায্যমূল্য, গুণগত মানসম্মত পণ্য বিক্রয় ইত্যাদি বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।

তার জীবনের কথনগুলো বলতে বলতে একসময়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। মনের অজান্তেই কখনো কখনো তিনি সেই দুঃসহ পুরনো দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছিলেন। যেখানে ছিল জীবনে বেঁচে থাকার দারুণ এক সংগ্রাম। নিজেকে তখন খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল তার অতীত জীবনের স্মৃতিগুলো সম্পর্কে জানতে চাওয়ায়। জীবনে সফলতা কাকে বলে ঠিক বলতে পারব না। তবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষটির সংগ্রামী জীবনকে মাথা নত করে সম্মান জানাই।

মাহফুজ ফারুক

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৬ তম সংখ্যা, জুন ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top