কী ছিল, আর কী হয়েছে। এলাকার চেহারাটাই পাল্টে গেছে। কাজ শেষ হয়নি। এখন/তবুও এ এলাকা দিয়ে হাঁটলে মনে হয় এটাই ঢাকার সবচেয়ে ভালো জায়গা। লেকের পানি ঠিক হলে এ এলাকা ঢাকাবাসীর প্রিয় জায়গায় পরিণত হবেÑ কথাগুলো বলছিলেন হাতিরঝিল প্রকল্প সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা লুৎফুল কবীর নয়ন। এমন বক্তব্যের সঙ্গে এখন একমত পোষণ করেন এলাকার অনেকেই। এলাকার আরেক বাসিন্দা আবদুল হাই বলেন, কয়েক বছর আগেও ছিলাম দ্বীপান্তরের মতো। বর্ষায় বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে হতো নৌকায়। এখন সব কিছুই স্বপ্নের মতো লাগে। এত দ্রুত এত পরিবর্তন হবে, ভাবতেও পারিনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এটি নিঃসন্দেহে ঢাকার স্বর্গে পরিণত হবে।
হাতিরঝিল এবং বেগুনবাড়ী খালকে পুনরুজ্জীবিত করা ও যানজট নিরসনসহ বেশ কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয় বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল প্রকল্পের কাজ। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কাজের দ্রুত অগ্রগতির জন্য এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় রাজউক, এলজিইডি, ওয়াসা এবং বুয়েটকে। ২০১২ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে এর মেয়াদ ৬ মাস বৃদ্ধি করা হয়। এর পরও প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দিহান খোদ প্রকল্প কর্মকর্তারা। কারণ উচ্চ আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় থাকা ৭২টি মামলার জন্য এখনো প্রায় ৭০ একর জমি হস্তান্তর করতে পারেনি রাজউক।
এই তো সেদিন মোটরসাইকেল চেপে তেজগাঁও, সাতরাস্তা হয়ে যাচ্ছিলাম রামপুরা। মগবাজার রেলক্রসিং বরাবর আসতেই ভয়াবহ যানজট। যানজট এড়াতে বিকল্প রাস্তায় ঢুকে পড়লাম বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায়। বাহ! কী সুন্দর ম্যাকাডাম করা প্রশস্ত রাস্তা। একটানে সাত মিনিটে রামপুরা ব্রিজে। সময় বাঁচাতে, যানজট এড়াতে অন্য যানবাহন চালকরাও সুযোগ পেলে প্রায়ই এই রাস্তা ব্যবহার করেন। অসমাপ্ত এই রাস্তাটি অতিক্রম করার সময় উপলব্ধি করলাম এ প্রকল্পের উন্নয়ন কর্মকাÐ। প্রকল্পের পুরো এলাকায় স্থাপত্যের নান্দনিকতায় সাজানোর প্রক্রিয়া চলছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী লেক সংলগ্ন অবস্থানে নির্মাণ করা হচ্ছে নান্দনিক নকশার ব্রিজ। স্থাপত্যের কাঠামোতে ব্যতিক্রমধর্মী কিন্তু দৃষ্টিনন্দন অবয়ব আনয়নের কলাকৌশল চলছে এসবে। ঢাকা মানেই যানজটে আবদ্ধ আকাশছোঁয়া ভবনের এক শহর। তবে এ প্রকল্পের তৎপরতায় মনে হয়েছে এমন দুর্নাম থেকে ঢাকাকে বের করে আনার প্রচেষ্টা চলছে। ঢাকা নতুন পরিচিতি পেতে যাচ্ছে বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল প্রকল্পের সুবাদে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কোলাহলপূর্ণ ঢাকা কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে। প্রকল্পটি বিশেষ করে যানজট প্রশমনে ভ‚মিকা পালন করবে। মগবাজার রেলক্রসিং এলাকা সংলগ্ন যানজট অনেকটাই প্রশমিত হবে। সেই সঙ্গে মালিবাগ-রামপুরা রোডেরও। এতে মধ্য ঢাকার সঙ্গে নতুন ঢাকার সড়ক যোগাযোগ অনেকটা সহজ হবে। মগবাজার, বাংলামটর, ইস্কাটন, পান্থপথ, রমনা এলাকার যানবাহন বাড্ডা, প্রগতি সরণি, গুলশান, কুড়িল, বিশ্বরোড এলাকায় যানজট এড়িয়ে চলাচল করতে পারবে। ইতোমধ্যে পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব এ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে অনেকে স্বর্গস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। খোদ গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান এ প্রকল্প নিয়ে তার স্বপ্নের কথা প্রকাশ করেছেন। প্রকল্পের কাজ সরেজমিনে দেখে ঘোষণা দিয়েছেন হাতিরঝিলকে স্বর্গ বানানো হবে। এ সময় প্রতিমন্ত্রী বলেন, নেতিবাচক ঢাকাকে ইতিবাচক করা ও ঢাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর কাজ শেষ হলে এর সৌন্দর্য ফ্রান্সের প্যারিসের মতো নান্দনিক হবে।
রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসন, সৌন্দর্যবর্ধনসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য ২০০৭ সালের ৮ অক্টোবর সরকার বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল এলাকার সমন্বিত প্রকল্পটি অনুমোদন করে। ১ হাজার ৪৮০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের মূল তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনীর ১৬ ইসিবিসহ কাজ করছে সরকারের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। ২০১২ সালের জুন মাসের মধ্যে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে এর মেয়াদ ৬ মাস বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু ভ‚মি অধিগ্রহণ নিয়ে সমস্যার কারণে বর্ধিত সময়েও কাজ শেষ করা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সেনাবাহিনীর ১৬ ইসিবির প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল আবু সাঈদ মোঃ মাসুদ। এখন পর্যন্ত যেহেতু রাজউক জমি হস্তান্তরে ব্যর্থ, সেহেতু নিশ্চিতভাবেই প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সময়সীমা অতিক্রম করবে।
সেনাবাহিনীর প্রকল্প কর্মকর্তা মেজর মোঃ খিজির খান জানান, প্রকল্পের আওতাধীন মোট জমির পরিমাণ ২৯৯.২৪ একর হলেও রাজউক এখন পর্যন্ত হস্তান্তর করেছে ২৩০.০৭৬৯ একর। অবশিষ্ট ৬৯.১৬৩১ একর জমির উপর উচ্চ আদালতে বিচারের অপেক্ষায় ছিল ৭২টি মামলা। উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকায় এখন পর্যন্ত এসব জমির ওপর কোনো কাজেই হাত দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরো জানান, ইতোমধ্যে ৮টি মামলার রায় তাদের পক্ষে এসেছে। সময়সাপেক্ষ হলেও বাকি মামলার রায়ও তাদের পক্ষে আসবে বলে তিনি আশা করেন।
প্রকল্পের সার্বিক অবস্থা
কাজের সুবিধার জন্য সম্পূর্ণ প্রকল্পটিকে ২টি অংশে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশে রয়েছে সোনারগাঁও হোটেল থেকে টঙ্গী ডাইভারশন এবং দ্বিতীয় অংশটি টঙ্গী ডাইভারশন থেকে শুরু হয়ে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত। প্রকল্পের প্রথম অংশে বেগুনবাড়ী খাল এবং দ্বিতীয় অংশে হাতিরঝিল খালকে কেন্দ্র করেই এ কার্যক্রম। প্রকল্প কর্মকর্তা মোঃ খিজির খান জানান, ‘এ প্রকল্পের আওতায় বেগুনবাড়ী খাল সংস্কার ও পূর্ণ রাস্তা ছাড়াও খালের উত্তর দিকে থাকবে নয়নাভিরাম সারিবদ্ধ বিভিন্ন প্রকার গাছপালা। অন্যদিকে টঙ্গী ডাইভারশন থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত একটি অত্যন্ত আধুনিক রোড নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে। যেখানে একদিকে চলাচলের জন্য এক্সপ্রেস ওয়ে এবং পাশাপাশি টু ওয়ে সার্ভিস রোড থাকবে। খালের দুপারের মধ্যে সংযোগ রক্ষার জন্য ৪টি ব্রিজ, ২টি ভায়াডাক্ট ও ৪টি নয়নাভিরাম ওভারপাস থাকছে। সংযোগ রক্ষাকারী রাস্তা থেকে মূলত মগবাজার, মধুবাগ, উলন, মহানগর, দাসপাড়া, রামপুরা, মেরুলবাড্ডা, গুলশান, তেজগাঁও, বেগুনবাড়ী এলাকার যাতায়াতকারীরা সুবিধা পাবেন।
পাঁচ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেনাবাহিনীর ১৬ ইসিবিকে এ প্রকল্পে সহযোগিতা করছে রাজউক, এলজিইডি, ওয়াসা ও বুয়েট। এরা প্রত্যেকে সমন্বিতভাবে নিজ নিজ অংশের কাজ সম্পাদন করছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল আবু সাঈদ মোঃ মাসুদ জানান, আমরা এ প্রকল্পে সরকারের আরো ৪টি প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি। মূলত এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করা এবং নিয়মিত কাজের অগ্রগতির ওপর নজর রাখাই আমাদের কাজ। পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সফল কার্য সম্পাদনের পর ২০০৭ সালের ৪ ডিসেম্বর আমাদেরকে বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল প্রকল্প সম্পাদনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পর থেকে আমরা সবাইকে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে একমাত্র ভ‚মি অধিগ্রহণ ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। উচ্চ আদালতের রায়ের অপেক্ষায় থাকা মামলাগুলোর কারণে ৩২০ মি. এলাকায় আমরা কোনো কাজ করতে পারছি না। ২০০৭ সালের মধ্যে রাজউকের ভ‚মি হস্তান্তর করার কথা থাকলেও প্রায় ৭০ একরের মতো জমি এখনো আমরা পাইনি।
রাজউক
বর্তমানে হাতিরঝিল প্রকল্পের একমাত্র বাধা ভ‚মি অধিগ্রহণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অসহায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। উচ্চ আদালতে ৭২টি মামলার কারণে এখনো বেশ কিছু জমি পাওয়া যায়নি বলে জানালেন রাজউকের প্রকল্প পরিচালক রায়হান আল ফেরদৌস। তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে ৮টি মামলার রায় আমাদের পক্ষে এসেছে। আশা করছি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সবগুলোর রায় পেয়ে যাব। মূলত এই সঙ্কট নিরসনের জন্য আমরা মামলাগুলোকে একটি কোর্টে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ৪২ জনের একটি তালিকা করেছি। এই তালিকায় যাদের স্থাপনা এবং জমি দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শুধু তাদেরই রাখা হয়েছে। এদের প্রত্যেককেই সরকারের পক্ষ থেকে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হবে।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, রাজউকের ৭.১২ কোটি ঘনফুট সøাজ তৈরির কথা থাকলেও সম্পন্ন হয়েছে ৩.১৪ কোটি ঘনফুট, যা মোট কাজের ৪৪.১০ শতাংশ।
এলজিইডি
এ প্রকল্পে সবচেয়ে বড় অংশের কাজ রয়েছে এলজিইডির হাতে। রাস্তার বালু ও মাটি ভরাটের মোট ৯.৮০০ কি.মি. কাজের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে ৯৭.৭৫ শতাংশ কাজ। বেস, আইএসজি, সাববেজ, ট্রি-প্লান্টেশন ও টার্ফিং, কার্বস্ট্রোন/কার্বস্টোন এবং রেইন ওয়াটার ক্রম ড্রেনের প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা যায়। ৪টি ব্রিজ ও ২টি ভায়াডাক্টের কাজও চলছে পূর্ণ গতিতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ৪টি ওভারপাসের কাজ শুরু হয়নি।
ওয়াসা
ঢাকা ওয়াসা এই প্রকল্পে মেইন এবং লোকাল স্যুয়ারেজ লাইনের কাজসহ দুটি নলক‚প বসানোর কাজ করছে। কিন্তু মেইন স্যুয়ারেজের ৮.৮০ কি.মির মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে ১.৩০৫ কি.মি. এবং লোকাল স্যুয়ারেজের ৭ কি.মির মধ্যে ১.০০৫ কি.মি. কাজ সম্পন্ন হয়েছে; যা মোট কাজের মাত্র ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া দুটি নলক‚পের মধ্যে একটি বসানোর কাজ চলছে।
বুয়েট
বুয়েটের একটি দল সামগ্রিকভাবে এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ২০০৪-০৫ সালে সর্বপ্রথম বুয়েটই এই প্রকল্পের সম্ভাবনা যাচাই করে সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করে। বুয়েট প্রধানত এ প্রকল্পের জরিপ সম্পাদন এবং সীমানা নির্ধারণ ও নকশাসহ সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা
ভ‚মি অধিগ্রহণে কালক্ষেপণ, একাধিক মামলা, প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব ও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরের কারণে প্রকল্পটির উন্নয়ন কাজ বিলম্বিত হয়েছে। বেগুনবাড়ী খালসহ হাতিরঝিল এলাকার সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মকর্তা মেজর খিজির খান জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর দায়িত্ব প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করা। আর রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এ কাজ করার যাবতীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি নিয়ে কিছু মামলায় আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় কার্যক্রম সঠিকভাবে চালানো যাচ্ছে না।
প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোঃ নুরুল হুদা বলেন, ভ‚মি অধিগ্রহণে কালক্ষেপণ আর আইনি জটিলতায় প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও হাতিরঝিল প্রকল্পের মোট ভ‚মির ৭৯ একর ছিল মাস্তান ও ভ‚মিদস্যুদের দখলে। ফলে এই ভ‚মিগুলো প্রকল্পের আওতায় আনার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়েছে। এ জন্য সময় একটু বেশি লাগছে।
বিজিএমইএ ভবন নিয়ে জটিলতা
বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল প্রকল্পের মধ্যে অবস্থিত বিজিএমইএ ভবন নিয়ে জটিলতা কাটছে না। এ ভবনটির কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছে রাজউক। এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোঃ নুরুল হুদা বলেন, এ ভবনের কারণে হাতিরঝিল প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ব্যাপারে হাইকোর্টে মামলা রয়েছে। মামলার কারণে ভবনটি আপাতত ভাঙা যাচ্ছে না। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। আদালতের স্থগিতাদেশ রয়েছে। কবে স্থগিতাদেশ উঠবে আর কবে কাজ শুরু হবে তা নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারছেন না।
এ ব্যাপারে বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জানান, তাদের নিজস্ব ভবন সরিয়ে নিতে আদালতের দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবে ।
হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতিবিষয়ক সংবাদ সম্মেলন শেষে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান। সে সময় তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকা থেকে বিজিএমইএ ভবন সরানোর বিষয়ে সরকার আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবে। তবে আমার মনে হয়, এক সময় তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। এ ধরনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে তারা নিজেরাই এখান থেকে সরে যাবে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার মতো কোনো বিষয় এটা নয়। বিজিএমইএ ভবন গত বছর ভাঙার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এর পর আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। এ বিষয়ে আদালত যখন যে নির্দেশনা দেবেন সে অনুযায়ী আমরা কাজ করব। তিনি বলেন, আমরা নির্ধারিত মূল্য পরিশোধের মাধ্যমেই জমি কিনেছিলাম সরকারের কাছ থেকে।
অভিযোগ রয়েছে, এ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নগর উন্নয়ন আইন, ভবন নির্মাণ আইনও লঙ্ঘন হয়েছে। রাজউক ভবনটির নকশা অনুমোদনও করেনি। এ অভিযোগ অস্বীকার করে সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ভবন নির্মাণের সময় হাতিরঝিল প্রকল্পটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আর প্রকল্পটির সংশোধিত নকশা বিজিএমইএ ভবন বাদ দিয়েই করা হয়েছে।
এলাকাবাসী যা বললেন
রাস্তার পাশে চা দোকানি মোঃ নাসির জানালেন, এক সময় জায়গাটি বিরাট বিল ছিল। ধান চাষ হতো। আমি ধান চাষসহ শাক-সবজি আবাদ করেছি। বছরে ২ থেকে আড়াইশ মণ ধান পেতাম। আর্মিরা কাজ শুরু করার আগেই আমার ধান কাটা শেষ হয়। এখন চা-সিগারেটের দোকান দিয়েছি। আর্মিরা আমাকে বলেছে, আপনার ধানকাটা শেষ হওয়ার পর আমরা কাজ শুরু করব। আর্মিদের যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়েছি।
মোঃ নাসিরের সাথে এসে যোগ দিলেন এলাকার মোঃ চান মিয়া, সাহাবুদ্দিন। তারা বলেন, রাস্তা হওয়াতে অনেক উপকার হয়েছে। এলাকা উন্নত হয়েছে। পরিবেশও ভালো হয়েছে। এখানকার জায়গার দামও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে এক সময় মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের অত্যাচার ছিল। প্রায় সময় ঝিলের মধ্যে লাশ পাওয়া যেত। আর্মিরা কাজ নেওয়াতে ভালো হয়েছে। জনগণের দ্রুত উপকারও হয়েছে। প্রাইভেট কোনো কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হলে বহু খুন-খারাবি হতো। আর্মিদের কাজে আমরা সন্তুষ্ট।
ঝিলের ভেতরের বাসিন্দা নাসিরউদ্দীন বলেন, আসলে জনস্বার্থেই এ প্রকল্পটি শেষ হওয়া প্রয়োজন। এতে সাধারণ মানুষের যেমন উপকার হবে তেমনি আমারও হাঁফ ছেড়ে বাঁচব। সার্ভিসওয়ে খুলে দিলে লোক চলাচল বাড়বে। এখন আমরা সন্ধ্যা হলেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। আর ধুলোর নির্যাতন তো রয়েছেই।
এখানকার আরেক বাসিন্দা ইয়সামীন হক কিছুটা উষ্মা নিয়ে বলেন, গত পাঁচ বছর তো অনেক সময়। এর মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজই শেষ হওয়া উচিত ছিল। এতে আমরা যারা নিজস্ব বাড়িঘর নিয়ে রয়েছি, তারা নিশ্চিন্ত হতাম।
সময় নিয়ে সংশয়
রাজউকের আইনি কর্মকর্তা সালেহ উদ্দিনের সঙ্গে বন্ধন-এর পক্ষ থেকে বার বার চেষ্টা করা হলেও তাকে তার ফোনে পাওয়া যায়নি। নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম মনে করেন, রাজধানীবাসীর সমস্যা নিরসন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সঠিকভাবে প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে হবে। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কেউই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেননি।
এক নজরে
প্রকল্পের নাম : বেগুনবাড়ী-হাতিরঝিল প্রকল্প
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা : বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
প্রকল্প তত্ত্বাবধানকারী : রাজউক, এলজিইডি, ওয়াসা এবং বুয়েট
মোট জমির পরিমাণ : প্রায় ৩০০ একর
প্রকল্পের জরিপ ও নকশা প্রণয়নকারী সংস্থা : বুয়েটমোট বাজেট : প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা
মেহেদী হাসান
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৭ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১২