চার দেয়ালে ঘেরা কংক্রিটের একটি ঘর, যাতে নেই কোনো জানালা। তবুও দিনের ঝলমলে রোদ, আর চাঁদনি রাতের জোছনার আলো ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়, যা সম্ভব হয়েছে দেয়ালের কংক্রিট স্বচ্ছ বলেই। প্রাচীনকালে খেয়ালি রাজারা এ রকম আবদার করত হরহামেশাই। আর এমন আবদার যদি ভুলেও কোনো রাজা করত, তবে রাজ্যের নকশাকারদের রাতের ঘুম হারাম তো হতোই, ভয় থাকতে শিরচ্ছেদ হওয়ার। ভাবতে পারেন পাগল এ রাজার রাজ্যে না থাকাই ভালো। কংক্রিটের দেয়াল ভেদ করে আলো প্রবেশ করার স্বপ্ন দেখাটা কেবলই রূপকথার গল্পে সম্ভব; বাস্তবে নয়। তবে কয়েক বছর আগেও স্বচ্ছ কংক্রিটের ধারণাটি রূপকথার কল্পকাহিনি মনে হলেও এখন তা রূপ নিয়েছে বাস্তবে। নান্দনিক সব স্থাপনায় লাগছে স্বচ্ছ এ কংক্রিট।

‘কোনো সূর্যই আর আমার দিনকে করবে না আলোকিত, রাতের সুউচ্চ আকাশের সেই হলদে চাঁদ আর উদীত হবে না আমার সঙ্গে খেলতে, আমি বলছি আঁধারে ঢাকা পড়েছে আমার আলো, যা পরিণত করেছে রাত্রিতে আমার দিনকে।’ ‘বব মার্লে ‘কংক্রিট জঙ্গল’ (Bob Marley-“Concrete Jungle”)। বিশ্বখ্যাত এ গায়কের মতো অনেকেরই হয়তো কংক্রিটের চার দেয়ালের মাঝে থেকে জীবনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হয়। হয়তো ভাবেন কংক্রিটের সনাতন এ দেয়াল ভেদ করে যদি একটু সূর্যের আলো প্রবেশ করত, তবে কতই না ভালো হতো! কংক্রিট, যা ঐতিহ্যগতভাবে কঠিন ও অভেদ্য নির্মাণসামগ্রী হিসেবে সুপরিচিত, খুব দ্রুতই বদলাতে শুরু করেছে এ ধারণা। আর এই কৃতিত্বের দাবিদার একজন হাঙ্গেরিয়ান স্থপতি; যাঁর হাত ধরে ২০০১ সালে আবিষ্কৃত হয়েছে স্বচ্ছ কংক্রিট। স্বচ্ছ এ কংক্রিট মিশ্রণে আয়তন হিসেবে যোগ করা হয়েছে শতকরা ৪-৫ শতাংশ আলোকসংবেদী তন্তু (Optical Fiber)।
স্বচ্ছ কংক্রিট কী?
কংক্রিট মানেই আমরা বুঝি ভারী, শক্ত ও মজবুত নির্মাণ উপকরণকে। কিন্তু গবেষকদের অক্লান্ত গবেষণায় এই কংক্রিট আজ আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে নানা রূপ ও আকৃতিতে। এমনি এক নব আবিষ্কার স্বচ্ছ কংক্রিট (Translucent Concrete)। স্বচ্ছ কংক্রিট বাড়ি নির্মাণসামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত নতুন ধরনের কংক্রিট, যার মধ্যে রয়েছে আলোকসংবেদী উপাদান (আলোকসংবেদী তন্তু)। যার ফলে কংক্রিটের মধ্য দিয়ে সহজে আলো যেতে পারে। ঘরও হয়ে ওঠে প্রকৃতির আলোয় আলোকময়। সম্পূর্ণ স্বচ্ছ না হলেও এই কংক্রিটের মধ্য দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ আলো প্রবেশ করতে পারে। এর এক পৃষ্ঠে আলো পড়লে তা আলোকসংবেদী তন্তুর মধ্য দিয়ে আরেক পৃষ্ঠে পৌঁছে। এ জন্য তন্তুগুলোর বিস্তার কংক্রিটের সর্বত্রই। ফলে দেয়ালের অন্য পৃষ্ঠে আলোকসংবেদী তন্তুর বিন্যাসের ওপর ভিত্তি করে হরেক রকমের আলোর নমুনা সৃষ্টি হয়। স্বচ্ছ কংক্রিট স্থাপত্যে একটি ছদ্মবেশী উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা কি না অভ্যন্তরীণ দেয়ালের কারুকার্যের জন্য পাচ্ছে দ্রুতই জনপ্রিয়তা।

যেভাবে এল
স্বচ্ছ কংক্রিটের ধারণাটি একেবারে নতুন নয়। সর্বপ্রথম ১৯৩৫ সালে কানাডিয়ান পেটেন্টে (Canadian Patent) এটির উল্লেখ করা হয়। যদিও তা ছিল কেবল চিন্তার জগতেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু আলোকসংবেদী কাচের তন্তু (Optical Glass Fiber) এবং পলিমারভিত্তিক আলোকসংবেদী তন্তু আবিষ্কারের পর থেকেই ধারণাটির ক্রমবিকাশ ত্বরান্বিত হয়। এ সময় এসব তন্তু ফাটল শনাক্তকরণের প্রযুক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হতো। ১৯৯০-এর দশকে স্বচ্ছ কংক্রিটের মতো বিভিন্ন রূপ ও আকৃতির নানা সামগ্রী তৈরি হতো। তবে এখনকার ব্যবহৃত স্বচ্ছ কংক্রিটের জন্য যার ধন্যবাদ প্রাপ্য তিনি অ্যারন লসনজি (Aron Losonczi), একজন হাঙ্গেরিয়ান স্থপতি, যিনি ২০০১ সালে স্বচ্ছ কংক্রিট উদ্ভাবনে সমর্থ হন। নানা পর্যায়ে এর ব্যবহার শুরু হলেও এখনো এই চমৎকার নির্মাণ উপাদানটি আংশিক হলেও গবেষণাধীন।
কীভাবে তৈরি হয়?
প্রাচীন রোমান সভ্যতা থেকেই কংক্রিটের ব্যবহার দেখা যায়। কালের বিবর্তনে কংক্রিট তৈরিতে আধুনিকতা এলেও এটি তৈরির মূল উপাদান রয়েছে অভিন্ন। কংক্রিট তৈরির মূল উপাদান হচ্ছে- ইটের খোয়া বা পাথরের টুকরো, বালু ও সিমেন্ট। এগুলো সঠিক অনুপাতে মিশিয়ে এতে পানি যোগ করে তৈরি করা হয় কংক্রিট। এসব উপাদানের অনুপাত পরিবর্তন করে কংক্রিটের শক্তিমাত্রায় আনা যায় পরিবর্তন। আর এই উপাদানের পরিবর্তন করে কিংবা তারতম্য ঘটিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন ধরনের কংক্রিট। যেমন- ইট বা পাথরের টুকরো আকারে বড় হলে কংক্রিটের পৃষ্ঠ হবে বেশ খসখসে। বিভিন্ন ধরনের উপাদান ব্যবহার করে কংক্রিটের রঙে পরিবর্তন আনা সম্ভব। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই আবির্ভাব স্বচ্ছ কংক্রিটের।

স্বচ্ছ কংক্রিট তৈরিতে বালু ও সিমেন্টের সঙ্গে পাথর বা ইটের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় আলোকসংবেদী তন্তু (Optical Fiber)। এই কংক্রিট তৈরির প্রক্রিয়া ধীরগতিসম্পন্ন। কারণ সম্পূর্ণ কাজই হয় হাতে। একটি লম্বা ও সরু ছাঁচের মধ্যে কংক্রিট ও আলোকসংবেদী তন্তু একের ওপর আরেকটি বসিয়ে লম্বা বিম তৈরি করা হয়, যা পরে শক্ত হলে ব্লক আকারে কাটা হয়। এই ব্লকগুলোয় কংক্রিটের প্রকৃত বন্ধন ও শক্তি বজায় থাকে। কারণ, আয়তন হিসেবে এতে তন্তুর পরিমাণ খুবই কম, শতকরা ৪-৫ শতাংশ। আলোকতন্তুর পুরুত্ব ২ মাইক্রোমিটার থেকে ২ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এটা নির্ভর করে কী পরিমাণ আলো আসা-যাওয়া করতে দেওয়া হবে তার ওপর। আলোকসংবেদী তন্তু এতটাই কার্যকারিতার সঙ্গে আলো পরিবহনে সক্ষম যে এ ক্ষেত্রে আলোর অপচয় হয় না বললেই চলে। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয় আলোর রংও।
আগে যদিও স্বচ্ছ কংক্রিট হাতে তৈরি করা হতো, যা ছিল একই সঙ্গে সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল, এখন অবশ্য আংশিক-স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে এটি তৈরি হয়। তবে এ ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা তন্তুর পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় তন্তু দিয়ে বোনা অত্যন্ত পাতলা ফেব্রিক (Fabric)। ফেব্রিক ও কংক্রিট পর্যায়ক্রমিকভাবে ছাঁচের মধ্যে ২ মিলিমিটার থেকে ৫ মিলিমিটার অন্তর বসানো হয় আর এভাবেই তৈরি হয় স্বচ্ছ কংক্রিট। শক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন আকারে প্রয়োজন অনুসারে কেটে নিয়ে এর পৃষ্ঠ পালিশ করা হয়, যার ওপর নির্ভর করে এর ঔজ্জ্বল্য।
স্বচ্ছ কংক্রিট তৈরিতে শুধু সূক্ষ্ন পদার্থ (Fine Material) ব্যবহার করা হয়, এতে থাকে না কোনো ইট বা পাথর কণা। এর সংকোচন শক্তি (Compressive Strength) ৭০ মেগা প্যাসকেল (১০০০০ পিএসআইয়ের চেয়ে বেশি), যা উচ্চ শক্তিসম্পন্ন কংক্রিটের সমতুল্য। যদিও এর ব্যবহার কাঠামোগত পর্যায়ে এখনো ব্যাপক পরিসরে শুরু হয়নি।
উৎপাদন ও ব্যবহার
স্বচ্ছ কংক্রিটের বাণিজ্যিক ভিত্তিক উৎপাদন এখনো শুরু হয়নি। বর্তমানে নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানি এর উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, যদিও উৎপাদন প্রক্রিয়াটি প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনুন্নত ও ধীরগতিসম্পন্ন। এটি কেবল কারখানায় তৈরির (Pre-Cast) পর প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা হয়। প্রচলিত কংক্রিটের মতো ব্যবহার স্থানে তৈরি সম্ভব নয়। তৈরি করা ব্লকগুলো বিভিন্ন আকারের হয়, কাচের তন্তু দিয়ে তৈরি ব্লক সর্বোচ্চ ১২০০ X ৪০০ মিমি (৪৭.২ X ১৫.৭ ইঞ্চি) আর এর পুরুত্ব ২৫-৫০০ মিমি (১-২০ ইঞ্চি) পর্যন্ত হতে পারে। ফলে স্বচ্ছ কংক্রিট নানাভাবে ব্যবহার করা যায়- পাতলা তক্তার মতো টাইলের পাশাপাশি কাঠামোগত কাজেও রয়েছে স্বচ্ছ কংক্রিটের ব্যবহার। এ ধরনের কংক্রিট প্রস্তুতকারী জার্মান এক কোম্পানির মতে, এই কংক্রিট দেয়ালে আলো চলাচলের মাধ্যম থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ কারুকার্যেও ব্যবহার করা যেতে পারে। এখন পর্যন্ত স্বচ্ছ কংক্রিট আলো প্রেরণের মাধ্যম, সাইন (Sign), নির্দিষ্ট জায়গায় স্থির বেঞ্চ, ডেস্ক, কাউন্টার ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমেরিকার ‘ন্যাশনাল বিল্ডিং জাদুঘর’-এ স্বচ্ছ কংক্রিটের ব্যবহার লক্ষণীয়।
চীনের সাংহাই এ অনুষ্ঠিত উৎপাদিত দ্রব্যাদির আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী-২০১০ (Shanghai World Expo-2010)-এর ইতালিয়ান প্যাভিলিয়নে (Italian Pavillion) স্টল তৈরিতে স্বচ্ছ কংক্রিটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যবহার করা হয়েছিল। সেখানে স্বচ্ছ কংক্রিট ব্লক ও অস্বচ্ছ কংক্রিট ব্যবহার করে এমন এক কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল, যা সৌন্দর্যের দিক যেমন ছিল নজরকাড়া; রাতের বেলা বাইরে থেকে দেখলে তেমনিই উজ্জ্বল দেখায়। প্যাভিলিয়নের জানালায় ব্যবহার করা হয়েছিল স্বচ্ছ কংক্রিট, যাতে সহজেই আলো প্রবেশ করতে পারে।

সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ কয়েক বছর আগেও স্বচ্ছ কংক্রিটের ব্যবহার সম্পর্কে সাধারণের জানা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু আমেরিকা ও চীনের সাংহাইয়ের প্রদর্শনী স্টলে ব্যবহারের মাধ্যমে এটি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যদিও এখনো এর ব্যবহার অভ্যন্তরস্থ কারুকার্যেই সীমিত, আশা করা যায় খুব শিগগিরই স্বচ্ছ কংক্রিট নির্মাণে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে। কাঠামোগত সৌন্দর্যে এর ব্যবহার দ্রুতই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এ ছাড়া নিরাপত্তাবিষয়ক কাজেও এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন- অভ্যন্তরীণ ফায়ার এসকেপকে (Fire Escape) আলোকিত করতে, যাতে করে জরুরি সময়ে বিদ্যুৎ না থাকলেও সমস্যায় পড়তে না হয় কিংবা রাস্তার গতিরোধকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে যাতে রাতে গাড়িচালকেরা সহজেই গাড়ি চালাতে পারেন। এ ছাড়া নানা কাজে এর রয়েছে বহুল ব্যবহার। আর তাই আশা করা যায় স্বচ্ছ কংক্রিট খুব শিগগিরই বিভিন্ন কাজে দৃশ্যমান হবে- হোক তা কারুকার্যে কিংবা কাঠামোগত সৌন্দর্যবর্ধনে।
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট
মো. নূর বাসিত জামান
প্রভাষক, পুরকৌশল বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৬ তম সংখ্যা, ফেবু্রুয়ারি ২০১৪