একজন শিল্পীর আঁকা ছবির মতোই স্থাপত্য তার ভালোবাসা। যখন কোনো স্পেস ডিজাইন করেন, সূর্যের আলো, দখিনা বাতাস, খোলা আকাশ ও প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে মিশিয়ে একাকার করতে চান। দেশের ঐতিহ্যবাহী ও সমৃদ্ধ স্থাপত্যিক নিদর্শন তাকে দারুণভাবে আন্দোলিত করে। এগুলো থেকে তিনি শুধু অনুপ্রেরণাই পান না, তা তার কর্মে ধারণও করেন। এ দেশে যে ক’জন উদীয়মান স্থপতি স্থাপত্যিক অঙ্গনে অবদান রেখে চলেছেন তাদেরই একজন স্থপতি জামাল উদ্দীন শেখ।
স্থপতি হিসেবে ইতোমধ্যেই তিনি সমাদৃত হয়েছেন নিজ কর্মগুণে। জন্ম ১৯৮০ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিক্রমপুরের ডহরী গ্রামে। পিতা মঈন উদ্দীন শেখ ও মাতা রবেদা বেগম। ৩ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি ৫ম। ১৯৯৭ সালে কলমা এল. কে. উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৯৯ সালে কবি নজরুল সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন। এর পর বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি হন। সেখান থেকে ২০০৬ সালে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার পাস করেন। এর পর প্রায় ৩ মাস ডিজাইন ল্যাব আর্কিটেক্টস নামক স্থাপত্য ফার্মে স্থপতি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এর কিছুদিন পর নিয়োজিত হন শিক্ষকতার মতন মহান পেশায়। বর্তমানে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠা করেন নিজস্ব স্থাপত্য ফার্ম, আইসোভিস্টস (ISOVISTS)। তিনিই এ ফার্মটির প্রিন্সিপাল ডিজাইনার। এ ছাড়াও তিনি ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ, রাজউক এবং সিডিএ’র একজন সক্রিয় সদস্য।
দিগন্ত বিস্তৃত শস্যক্ষেতে সারাদিন ছোটাছুটি, গ্রামের পুকুরে ডুব সাঁতার, স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলেই কেটেছে তার ছেলেবেলা। স্কুলে তিনি ছিলেন শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্র। প্রতিটি শ্রেণীতেই প্রথম স্থান পেতেন বলে ভালো ছাত্র হিসেবে এলাকায় তার বেশ নামডাক ছিল। স্কুল ও কলেজ থেকে সর্বোচ্চ মার্ক নিয়ে যথাক্রমে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করেন। সে সুবাদেই স্কুল থেকে পেয়েছেন বইসহ নানা পুরস্কার। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় স্কুল জীবন থেকেই জিতেছেন পুরস্কার। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা, মৌসুমী শিশু প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিয়ে পুরস্কৃত হয়েছেন বহুবার। ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত মৌসুমী শিশু প্রতিযোগিতার উপস্থিত বিতর্কে থানা পর্যায়ে ১ম এবং জেলা পর্যায়ে ৩য় স্থান অধিকার করেন।
ছবি আঁকা তার খুবই পছন্দের বিষয়। সব সময় চাইতেন তার কাজের সাথে যেন এই আঁকার বিষয়টা যুক্ত থাকে। বাংলাদেশের স্থাপত্য বিষয়ক ধারণাটা পেয়েছিলেন স্কুল জীবনে। তখনই এ বিষয়টি তার ভালো লেগে যায় এবং সিদ্ধান্ত নেন এটি নিয়েই পড়াশোনা করবেন। ভালো ছাত্র এবং ভালো ফলাফলের সুবাদে পছন্দের বিভাগটিতেই পড়ার সুযোগ পেয়ে যান। পড়ালেখাকালে শিক্ষকদের সাথে বিভিন্ন স্থাপত্যিক কাজে যুক্ত হন। ছাত্রজীবনে ডিজাইন করেছেন বিভিন্ন ধরনের আবাসিক স্থাপনা এবং ল্যান্ডস্কেপের। তিনি তখন থেকেই প্রতিটি কাজে এবং পড়াশোনায় মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। বুয়েটের ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার পরীক্ষায় ১ম শ্রেণীতে ৫ম স্থান লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে ৫ম বর্ষে তার থিসিসের বিষয় ছিল দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য নগরী পানাম নগর। থিসিসটি করতে গিয়ে দেশের স্থাপত্যিক ঐতিহ্য যে কত সমৃদ্ধিশালী তা পরতে পরতে উপলব্ধি করেন। সে সময় সরকারের অধীনে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর এই নগরীকে সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এই সংস্কার কাজ পরিচালিত হয় অদক্ষ মিস্ত্রি এবং কতিপয় বিশেষজ্ঞের দ্বারা। ফলে হুমকির মুখে পড়ে প্রকৃত শৈল্পিক কারুকাজ সমৃৃদ্ধ এখানকার ভবনগুলো। সঠিক উপায়ে সংস্কার ও সংরক্ষণ কাজ হচ্ছিল না। এই বিষয়টিকে স্থপতি হিসেবে শেখ জামাল কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তাই বি. আর্ক (B. Arch) সম্পন্ন হওয়ার পর পানাম নগরকে রক্ষা করার কথা ভাবতে থাকেন। তিনি ছিলেন ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের হেরিটেজ সেলের একজন সক্রিয় সদস্য। তিনি এবং হেরিটেজ সেলের সদস্যগণ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত মহলে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেন। এ ছাড়াও দেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলোতে বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রতিবেদনও তুলে ধরেন। ইউনেস্কো থেকে প্রকাশিত ওল্ড বাট নিউ নিউ : বাট ওল্ড (old but new new: but old) নামক একটি স্থাপত্য ঐতিহ্য বিষয়ক বইয়ে পানাম নগরী বিষয়ক তার গবেষণা নিয়ে একটি লেখাও প্রকাশিত হয়। অবশেষে তিনি এবং তার সহকর্মীরা এই ভুল কাজটি থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়।
এক সময়ে ঢাকা শহরের অন্যতম মনোরম জায়গা ছিল গুলশান লেক। অবৈধ নানা স্থাপনা এবং এর পাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ভবন থেকে ময়লা ফেলার ফলে এই লেকের অবস্থা হয়ে পড়ে শোচনীয়। একটু পরিকল্পনা নিলেই এই জায়গাটি মানুষের বিনোদন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। এ রকম চিন্তা মাথায় রেখে স্পন্সরসহ ব্যাপারটিকে নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মহলে ধরনা দেন তিনি। কাজটা যে অনেক কঠিন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নানা ঝক্কিঝামেলার পর রাজউক ও পূর্ত মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে রাজি করাতে সক্ষম হন। সবকিছুর পর লেকের ডাম্পিং এলাকাকে পরিণত করা হয়েছে মানুষের হাঁটাচলার পথ (walk way) উপযোগী করে। তিনি এই প্রকল্পটির ডিজাইনার ছিলেন। সেখানে তিনি স্থাপন করেন ৩টি মনোরম ভাস্কর্য এবং ফোয়ারা। এসব ভাস্কর্য, ফোয়ারা, গার্ডেন লাইট, বিভিন্ন জাতের ফুল ও লতা গাছগুলো লেকপাড়টিকে করে তুলেছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। দৈনিক পত্রিকা দি ডেইলি স্টার এ কাজটি নিয়ে একটি ফিচার করেছে।
এসব প্রকল্পের এবং শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থপতি জামাল বেশ কিছু ভবন ডিজাইনের কাজও করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম টাঙ্গাইলে স্থাপিত প্লেটনিক হাউজ (PLATONIC HOUSE) বাড়িটিকে তিনি এমনভাবে ডিজাইন ও নির্মাণ করেছেন যেখানে আকাশ, বাতাস ও প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়েছে। জায়গাটির প্রায় ৭০ ভাগ জায়গা তিনি রেখেছেন উন্মুক্ত। এখানে বাগানকে প্রাধান্য দিয়েছেন। স্থাপত্য ডিজাইনে প্রাধান্য পেয়েছে কিউবিক ফর্ম এবং বাইরের লনের দেয়াল। যেখানে তৈরি হয়েছে স্থাপত্য ফর্মের সাথে দেয়াল এবং প্রকৃতির নিবিড় এক সম্পর্ক। ২০১০ সালে এই বাড়িটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। স্থাপত্যটির নান্দনিকতার জন্য এটি নমিনেশন পেয়েছে আর্ক এশিয়া অ্যাওয়ার্ডে। জাপানের রাজধানী টোকিওর একটি প্রদর্শনীতেও তার এই ডিজাইনটি স্থান পায়। এ ছাড়াও ছোট বড় বিভিন্ন বাণিজ্যিক এবং আবাসিক ভবনসহ বেশ কিছু স্থাপনার ডিজাইন করেছেন। এসব ডিজাইনে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নিজস্ব চিন্তাভাবনা, নিজস্ব ঢং, দেশীয় সংস্কৃতি, আধুনিকতা ও ভালোলাগার বিভিন্ন লুক। এ ছাড়াও তিনি কাজের ফাঁকে অংশ নিয়েছেন জাতীয় প্রতিযোগিতাতেও। আইএবি সেন্টার ডিজাইন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ডিজাইন ইত্যাদি। সম্প্রতি তিনি কোরিয়ান একটি স্থাপত্য ফার্মের সাথে স্থাপত্য নিয়ে কাজ করছেন।
সংসদ ভবনের খোলা চত্বর, রবীন্দ্র সরোবর এ ধরনের আরবান স্পেস তার বেশ ভালো লাগে। তিনি মনে করেন নগর জীবনের ক্লান্ত মানুষের অবসরে কিছুটা স্বস্তি পেতে চাই খোলা প্রান্তর। এ জায়গাগুলো সবটা না হোক অনেকটাই মেটাচ্ছে নাগরিকদের বিনোদন চাহিদা। কিছু স্থপতির স্থাপত্য তার প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে। ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক থেকে এই ভালোলাগা। লুই কানের আলো, শব্দ ও পরিসর (space) নিয়ে যে কাজ ও তার যে দর্শন তা তাকে দারুণভাবে আন্দোলিত করে। সমসাময়িক স্থপতিদের মধ্যে স্থপতি জাহা হাদীদের (Zaha Hadid) কাজ তাকে মুগ্ধ করে। তার দর্শনের দীক্ষা নিয়েই সব সময় চেষ্টা করেন প্রকৃতির সাথে খাপ খায় এমন স্থাপত্য ডিজাইন করতে। তার ডিজাইনে ত্রিমাত্রিক পারসেপশনকে কাজে লাগানো চেষ্টা থাকে সব সময়। ভবিষ্যতে হতে চান ভালো একজন স্থপতি। এমন স্থাপত্য ডিজাইন করতে চান, যা মানুষের মন জয় করবে, ছুঁয়ে যাবে হৃদয়। সব সময় তিনি তাই এই স্বপ্ন দেখেন এবং ভাবতে ভালোবাসেন তার স্থাপনা মানুষের হৃদয় ছুঁতে পেরেছে। মৃত্যুর পরও যেন তার স্থাপত্যটি তাকেই মনে করিয়ে দেবে, জানান দেবে তারই কর্ম স্বীকৃতির কথা।
মাহফুজ ফারুক
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৮ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১২