ডুবন্ত সূর্যের রক্তিম আভায় পশ্চিম আকাশ যখন আচ্ছন্ন, তখন বালিয়াড়ির ঝাঁকেদের ঘরে ফেরার পালা। বিকেলের শেষ রোদটুকু গায়ে মেখে খেলার মাঠে ডানপিঠেপনায় বন্ধুদের পিঠে দিনের শেষ কিল বসিয়ে হাত-পা ধুয়ে সন্ধ্যার প্রস্তুতি। (কিছুটা হুজুরের চোখ রাঙানি, কিছুটা অভ্যাসবশত, কিছুটা বাবা-মায়ের শুনিয়ে দেওয়া স্রষ্টার আদেশ পালনের কৈশোরিক অনুভ‚তি নিয়ে আমরা কেউ কেউ মসজিদেও যেতাম।) ক্লান্ত-অবসন্ন দেহে পড়ার সঙ্গে পরম আকাঙ্খিত ঘুমের লড়াই চলত কয়েক ঘণ্টা। এসএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত এই ছিল নিত্যদিনের দিনপঞ্জিকা। কলেজের আঙিনা পার হতেই ইট-পাথরের জটিল এক গোলক ধাঁধায় ছিটকে পড়ে সে কী ত্রাহি অবস্থা!

বিকেল চারটা বেজেছে তো আর রক্ষে নেই। ফার্মগেট যেন হালাকু খানের রণোন্মত্ত সেনাদের পদভারে কম্পিত উত্তপ্ত ময়দান। কত দিন হাঁটতে হাঁটতে উল্টো দিকে কাওরানবাজার সার্ক ফোয়ারা পার হয়ে আরও সামনে এগিয়ে গিয়েছি, যদি একটু আগে বাসে ওঠা যায় তাহলে ফার্মগেট এসে কিছু লোক নেমে যাবে, খালি পাওয়া যাবে এক-আধজন পিঠ ঠেকানোর মতো একটা সিট। যেদিন পারিনি, সেদিন চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে জামার বোতাম খুলে পালিশ করা চকচকে জুতোয় অগণিত পদচিহ্ন আর ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া কানে আঙুল নিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে থেকেছি কখন স্টেশন আসে। আলুথালু বেশে বাস থেকে নামার পরে ঢাকার বিষাক্ত বাতাসই যেন জান্নাতি সুখ।
শুক্রবার মানেই পরম আকাঙ্খার দিন। আজ আর যেতে হবে না ফার্মগেট। প্রশ্বাস, ঘাম আর সিগারেটের গন্ধ সহ্য করে ঘাড় বাঁকিয়ে বসে থাকতে হবে না। অনেক দূর তবু হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই আগারগাঁও। আরেকটু সামনে এগোলে পরিষ্কার বাতাসের ছোঁয়া পাই। অতঃপর চন্দ্রিমা উদ্যানের সন্ধানী প্রাণের মেলায় ক্ষণিকের তরে জীবন জুড়াই। কখনো চলে যাই শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, শানবাঁধানো চওড়া সিঁড়িতে নিরালা বিকেলের সৌন্দর্যের মধ্যে খুঁজি শহীদদের না দেখা স্মৃতিগুলো। চিড়িয়াখানা কি বোটানিক্যাল গার্ডেন বারবার হাতছানি দেয় প্রশান্তির আশা দিয়ে। ভাবি, আমি না হয় কষ্ট করে সপ্তাহে এক দিন হলেও মনের ক্ষুধা মেটাতাম, আমার যে কয়েকটি ভাগনে-ভাগনি বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে মুক্ত পৃথিবীর সন্ধান করে, কখনো বা বাড়ির সামনের ১০ ফুটি গলির মধ্যে ক্রিকেট ব্যাটে বল পিটিয়ে দুরন্ত কৈশোরের জানান দেয়, ওরা কি মোটেও পাবে এ সুযোগ? কে নিয়ে যাবে ওদের? কোথায় নিয়ে যাবে?

প্রতিদিন কত খবর আসে কত, কিছু প্ল্যান হয়; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। রাজধানীতে কোটি কোটি মানুষ থাকবে, দালান-কোঠা থাকবে, গাড়ি থাকবে, শব্দ থাকবে, লাল-নীল বাতির ঝিলিক থাকবে, উত্তাপ থাকবে, তাই বলে কি গাছ থাকবে না! রুগ্ণ ওসমানী উদ্যানে দাঁড়িয়ে ভাবতে হয় এই ঢাকা কি কোনোকালে ঢাকবে না সবুজের চাদরে। মৃত বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়ালে সুশীতল বাতাসে কখনো কি জুড়াবে না অতৃপ্ত দেহ-মন!
স্থপতি খালিদ মাহমুদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫০ তম সংখ্যা, জুন ২০১৪