যে কোনো স্থাপনা নির্মাণের আগে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি দেখা অত্যন্ত জরুরি সেটা হচ্ছে যে জায়গাটিতে স্থাপনাটি হবে তার ধরন এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা। প্রকৃতিগতভাবে জলবায়ুর দিক থেকে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত আরামদায়ক। আমাদের জলবায়ুকে সাধারণত ট্রপিক্যাল ক্লাইমেট বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং বছরের বিভিন্ন সময়ে আমরা প্রায় ৪টি ঋতু খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করি। আমাদের মাটি, জল, বাতাস যেমন পরিপূর্ণ, ঠিক তেমনি এদের সাথে বেড়ে ওঠে বিভিন্ন প্রকার গাছপালাও। সবুজ ছাদ (Green Roof) বর্তমানে বহুল আলোচিত বিষয় এবং বর্তমানে অনেক স্থাপনাকে জলবায়ু এবং পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলার জন্য বাড়ির ছাদে বিভিন্ন প্রকার বৃক্ষায়ন (Green Plantation) করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই সবুজ ছাদ করতে গেলে সাধারণত বিশেষ কিছু পদ্ধতি মেনে চলতে হয়। যদি কেউ ৫ ইঞ্চি RCC (ছাদের)-এর উপর সরাসরি মাটি ফেলে গাছ লাগিয়ে থাকে তাহলে সেটা হবে বিপজ্জনক। কারণ মাটি, পানির সরাসরি সংস্পর্শে ছাদের ঢালাই (Layer) রড থেকে থাকলে সেটি পরিবেশবান্ধব না হয়ে বরং বিল্ডিংয়ের কাঠামোর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে তাই এই সবুজ ছাদ ডিজাইনের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় লক্ষণীয়।
সাধারণত ৬টি মূল স্তর দিয়ে গঠিত হয় এই সবুজ ছাদ (Green Roof)-
- ওয়াটার প্রুফ মেমব্রেন (যা সাধারণত পানি থেকে ছাদের মূল কাঠামোকে আলাদা করে রাখে)
- প্রোটেকটিভ মেমব্রেন (সাধারণত এই অংশটি গাছ এবং ছাদের মূল কাঠামো থেকে পৃথককরণ সেল)
- পানি নিষ্কাশনের জন্য ২ ইঞ্চি-৩ ইঞ্চি ড্র্রেনেজ বোর্ড (Drainage Board)
- ময়েশ্চার রিটেনশন লেয়ার (Moisture retention Layer)
- ৪ ইঞ্চি /৫ ইঞ্চি Soil material (মাটির স্তর যেখানে গাছগুলো রোপিত হবে)
- সবুজ বৃক্ষ (অবশ্যই স্থান-কাল ভেদে গাছগুলো নির্বাচন করতে হবে)
সবুজ ছাদ নকশা করার সময় খেয়াল করতে হবে ছাদের ভৌত কাঠামো (structural design) যেন কম ভারসম্পন্ন এবং যে মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা যেন আবর্জনা এবং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানমুক্ত হয়। তা না হলে গাছগুলো সঠিকভাবে বেড়ে উঠবে না।
বৃষ্টির পানি সবুজ ছাদের জন্য মাঝে মধ্যে ক্ষতিকারক হতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকলে ছাদে পানি জমে সেখানে মশা-মাছিসহ অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে। খেয়াল করতে হবে ১০০০ বর্গফুট ছাদের ১ ইঞ্চি পরিমাণ বৃষ্টিপাত প্রায় ৬০০ গ্যালন পানি জমা করতে পারে। সেগুলো প্রয়োজনীয় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পরবর্তীকালে ব্যবহার করা যেতে পারে, এতে পানির অপচয় কমবে।
সবুজ ছাদের কিছু ক্ষতিকারক দিক সব সময় মাথায় রাখতে হবে। যেমন-
পুরনেঠ কোনো স্থাপনায় সবুজ ছাদ নতুনভাবে প্রস্তুতকরণ যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনি ব্যয়বহুল এবং কাঠামোর জন্য অতিরিক্ত ভার বিপজ্জনক। মাঝে মাঝে অনেকে অতিরিক্ত ভারবহনের জন্য সাপোর্ট ব্যবহার করে থাকে যা সাধারণত পরবর্তীতে মূল কাঠামোর ক্ষয়ের কারণ হয়ে থাকে।
ছাদে কোনো প্রকার ছিদ্র থাকলে সেটা দীর্ঘসময় পর কাঠামো ধসে (structural failure) রূপ নিতে পারে। তাই কোনো প্রকার ছিদ্র আছে কিনা জানার জন্য electronic leak detectors ব্যবহার করা যেতে পারে।
সবুজ ছাদ তৈরিতে শুধু গাছ লাগানোই মূল কথা নয়। এটাকে প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে। তা না হলে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সবুজ ছাদ জঞ্জালে পরিণত হতে পারে।
সবুজ ছাদের পাশাপাশি আরো যে বিষয়টি নিয়ে একজন স্থপতি কিংবা প্রকৌশলী কাজ করতে পারেন, সেটি হচ্ছে ভার্টিক্যাল দেয়াল (Living wall), যা একদিকে যেমন স্থাপনার সৌন্দর্য বর্ধনে সহায়তা করে, অন্যদিকে স্থাপনার অভ্যন্তরের তাপমাত্রা কমায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ভার্টিক্যাল বাগান তৈরিকল্পে যে বিষয়টি সচেতনতার সাথে দেখতে হবে, তা হচ্ছে ‘মিডিয়াম’, যার উপর সবুজ লতা, গুল্ম, ঘাস ও গাছ বেড়ে উঠবে।
সাধারণত কয়েক রকম মিডিয়াম ব্যবহার করা হয়ে থাকে-
লুজ মিডিয়াম (loose medium)- এ মিডিয়ামকে soil in a bag বলা হয়ে থাকে। মাটির মস্তকে ব্যস বস্ত্র রাখা হয় এবং প্রয়োজনীয় wall-এ install করা হয়। এ পদ্ধতি সাধারণত ঘন বসতি এবং ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার জন্য উপযুক্ত নয়।
ম্যাট মিডিয়াম (mat mediam)
Structural Media- সর্বশেষে যে বিষয়টি Green plantation-এর জন্য সব সময় মাথায় রাখতে হবে সেটি হচ্ছে আমাদের চারপাশে যে সব native গাছপালা বিদ্যমান (flora) সেগুলো আগে ভালোভাবে জানতে বুঝতে হবে। কারণ আমাদের ইকোসিস্টেম এবং বায়োডাইভার্সিটির সুষ্ঠু সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় এবং যথোপযুক্ত বায়োইঞ্জিনিয়ারিং সিস্টেম ব্যবহার করতে হবে, যা হতে হবে পরিবেশবান্ধব এবং স্থানীয়।
প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে সবুজ দেয়ালের (Green wall) প্রস্তুত প্রণালীতেও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু আমাদের দেশে এর ব্যবহার এখনও অনেক অপ্রতুল।
প্রস্তুত প্রণালী
সাধারণত কোনো দেয়ালে যদি Vertical Green wall করতে হয় সে ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার জন্য উক্ত দেয়ালের সামনে স্টিল ফ্রেমের একটি কাঠামো তৈরি করতে হয়, যার নিচের অংশ কংক্রিট ফুটিংয়ের হতে হয়। পরবর্তীতে কাঠামোটিকে কাঠ/প্লাইউড/পিভিসি দিয়ে আবৃত করে দিতে হয়। তার পর সেখানে সবুজ গাছপালা লাগানো হয়ে থাকে। তবে সে ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, গাছ লাগানোর জন্য যে মাটির স্তর (mud bed) প্রয়োজন সেটি বাইরে থেকে প্রস্তুত করে লাগানো যেতে পারে। অথবা উক্ত ফ্রেমে ভার্টিক্যাল মাটির বিছানাসদৃশ প্রস্তুত করা যেতে পারে; যা সাধারণত একটু সময়সাপেক্ষ। সব শেষে সবুজ বৃক্ষরাজিকে সতেজ ও সুন্দর রাখতে একেবারে উপরের দিকে একটি পানির পাইপ দেওয়া হয়ে থাকে, যা water tunnel থেকে পানি সংগ্রহ করে উপর থেকে গাছগুলোর উপর পানি সরবরাহ করবে। অন্যদিকে কোনো স্থাপনাকে Green building-এর লিড সার্টিফিকেশন পেতে হলে এই Green wall ও Green roof-এর জন্য বরাদ্দ প্রায় ১৮ points অর্জন করতে হবে। যা কোনো নতুন স্থাপনাকে বিশ্বের দরবারে গ্রীন বিল্ডিং হিসেবে পরিচিতি দেবে এবং যার ফলে উক্ত স্থাপনা প্রায় ৫০% শক্তির অপচয় কমাবে বলে ধারণা করা হয়।
স্থপতি সজল চৌধুরী
শিক্ষক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৮ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১২