নান্দনিক স্থাপত্যের ষাট গম্বুজ মসজিদ

বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ মুসলিম স্থাপত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম স্থাপত্যের সর্বোকৃষ্ট উদাহরন। দেশসহ বিদেশের হাজার-হাজার দর্শনার্থীদের কাছে এটি আকর্ষনীয় স্থাপনা। ৫৪৬ বছর পূর্বে খানজাহান আলী তার অমরকীর্তি এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। দেশের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম ও বৃহত্তম। মসজিদের স্থাপত্যশৈলী কাছ থেকে দেখলে যে কেউ ফিরে যাবে শত বছর পেছনে। এর নির্মাণশৈলী যে কাউকে মুগ্ধ করবে।

ষাট গম্বুজ মসজিদ মোঘল আমলের এক নান্দনিক স্থাপত্যকর্ম। রূপসা-বাগেরহাট মহাসড়কের পার্শ্বে খানজাহান (রাঃ) মাজার শরীফ থেকে প্রায় দেড় মাইল উত্তর পশ্চিমে সুন্দরঘোনায় মসজিদটির অবস্থিত। মসজিদের উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব পার্শ্বে পাকা সড়ক, পশ্চিম পার্শ্বে ঐতিহাসিক ঘোড়াদীঘি মসজিদ। স্থাপত্য কলার নিদর্শন আর লাল পোড়ামাটির উপর সুনিপুন লতাপাতার অলংকরনে নানান ধরনের কারুকার্য খচিত মসজিদের ভিতর বাহিরে অভাবনীয় সৌন্দর্যের সমাবেশ ঘটেছে। বাংলাদেশে এত বড় ঐতিহাসিক মসজিদ আর নেই। মসজিদটির দৈঘ্য ১৬০ ফুট এবং প্রস্থ ১০৮ ফুট। আর এর উচ্চতা ২২ ফুট। গম্বুজের উচ্চতা ২৯ ফুট। এর সামনের দিকে একটি খিলান এবং দু পাশে ৫টা করে খিলান রয়েছে। দেয়াল প্রায় ৯ ফুট পুরু। পূর্ব পশ্চিমে ৭টি করে ১১টি সারিতে মোট ৭৭টি গম্বুজ রয়েছে। এর মধ্যে মাঝের এক সারিতে ৭টি গম্বুজের উপরিভাগ চৌকনা, বাকি ৭০টির উপরিভাগ গোলাকার। মসজিদের ভিতরে পূর্ব পশ্চিমে ১০টি সারিতে ৬টি করে মোট ৬০টি স্তম্ভ রয়েছে। প্রতিটি স্তম্ভই পাথর কেটে বানানো, শুধু ৫টি স্তম্ভ বাইরে থেকে ইট দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। এই ৬০টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের ওপর তৈরি করা হয়েছে গম্বুজ। স্থানীয় লবনাক্ত জলবায়ুর প্রভাবে যাতে ভবনটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য মসজিদের স্তম্ভের নিচে ৪ ফুট পর্যন্ত চার পাশে পাথরের আস্তরন দেয়া হয়েছে। মসজিদের ভিতরে এমন জ্যামিতিক পদ্ধতিতে স্তম্ভগুলো বিন্যাস করা হয়েছে যে ইমাম সাহেবের দৃষ্টি মসজিদের যে কোন প্রান্ত পর্যন্ত কোন বাঁধা ছাড়াই পৌঁছাতে পারে। মিনারের উপর যাওয়ার জন্য ভিতর থেকে সামনের দুটি মিনারে প্যাঁচানো সিঁড়ি আছে এবং এখান থেকে আযান দেবার ব্যবস্থা ছিলো। এদের একটির নাম রওশন কোঠা, অপরটির নাম আন্ধার কোঠা।

ঐতিহাসিকদের ধারণা, হজরত খানজাহান (রাঃ) জৌন পুরের দক্ষ  নির্মাণ শিল্পী এনে এই সুরম্য মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে কত লোক এর নির্মাণ কাজে যুক্ত ছিলেন তা জানা যায়নি। এটি নির্মান করতে প্রায় ২০ বছর লেগেছিল। এ মসজিদে তিন হাজার লোক এক সাথে নামাজ পড়তে পারে। চার কোনে চারটি গম্বুজসহ ৭৭টি গম্বুজ থাকা স্বত্তে¡ও নাম ‘ষাট গম্বুজ’ কেন ? প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। মসজিদটির ছাদ গম্বুজ দিয়ে তৈরি সে কারণেই ছাদ থেকে ‘ষাট গম্বুজ’। আবার কারো কারো মতে ৬০টি স্তম্ভের উপর মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত বলে এটির নাম ‘ষাট গম্বুজ’। তবে, এটি শুধু মসজিদ ছিল না খানজাহান (রাঃ) এর দরবার হিসাবেও ব্যবহৃত হত। এখান থেকেই তৎকালীন দক্ষিণাঞ্চলীয় স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামী কল্যান রাষ্ট্র্র হাবেলী পরগনা বা খলিফাতাবাদ রাষ্ট্র পরিচালিত হত। ইউনেস্কোর অধীন World heritage এর অংশ হিসাবে ১৯৮৩ সালে স্বীকৃিতর পর শত বছরের পুরাতন এ মসজিদের গুরুত্ব এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। প্রতিদিন এ মসজিদ দেখার জন্য দেশ বিদেশের হাজার হাজার পর্যটন এখানে ভিড় জমায়।

মেহেদী হাসান সুমন

প্রকাশকাল: বন্ধন ২২ তম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top