নির্মাণ শিল্পের অন্যতম একটি উপাদান কনক্রিট, যা সিমেন্ট-বালি-খোয়ার সাথে পানির সংমিশ্রণে প্রস্তুত হয়। খড়-কাঠ-বাঁশের পরিবর্তে যখন পাকা বাড়ি বা দালান তৈরীর প্রচলন শুরু হলো তখন থেকেই কনক্রিট প্রধান একটি নির্মাণ উপাদান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমান স্থাপত্য শিল্প, নির্মাণ শিল্পকে কনক্রিটের অবদান হিসেবে বলা হয়।
রেডি মিক্স কনক্রিট কি
সাধারণ কনক্রিট হলো সিমেন্ট-বালি-খোয়া ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানির একটি সুষম মিশ্রণ। এটি হাতেও মিশ্রিত করা যায় অথবা ‘মিক্সার মেশিন’-এর সাহায্যেও মিশ্রিত করা যায়। সাধারণত নির্মাণস্থল বা সাইটে কনক্রিট মিশ্রিত করে ঢালাইয়ের কাজ করা হয়। মূলত এই নিয়মেই কনক্রিট প্রস্তুত করা হয়।
সাধারণ কনক্রিটের ক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, এতে অনেক ক্ষেত্রে সিমেন্ট-বালির অনুপাত, পানির পরিমাণ এগুলো বজায় রাখা সম্ভব হয় না। আবার ঢালাই চলাকালে মিক্সার মেশিন চালনার কারণে শব্দ দূষণ হয়। অনেক ক্ষেত্রে সাইটে মিক্সার মেশিন, কাঁচামাল রেখে কনক্রিট প্রস্তুত করার মত স্থান সংকুলান হয় না। তখন মিক্সার মেশিনের সাহায্যে কনক্রিট প্রস্তুত করে ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার হয়।
এসব বিড়ম্বনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ‘রেডি মিক্স কনক্রিট’ ধারণার উদ্ভব হয়েছে। রেডি মিক্স কনক্রিট হলো সাধারণ কনক্রিটের মতোই কনক্রিট তবে এটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় মেশিনে মিক্সিং প্লান্টে প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তীতে কনক্রিট পরিবাহী ট্রাকে করে নির্মাণস্থলে সরবরাহ করা হয়।
প্রচলিত কনক্রিট প্রস্তুতিতে এর উপাদানসমূহের মিশ্রণ অনুপাত, পানির পরিমাণ, উপাদান সমূহের মান ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। আবার অনেক সময় অদক্ষ শ্রমিকের কারণেও কনক্রিটের মান সঠিক হয় না।
নির্মাণস্থলটি যদি রাস্তার পাশে হয় বা এর অবস্থান এমন হয় যে-যেখানে কাঁচামালগুলো রেখে কনক্রিট প্রস্তুত করার মতো স্থান পাওয়া যায় না। তাহলে কনক্রিট প্রস্তুতকরণ কঠিন হয়ে পড়ে।
আবার কনক্রিট মিক্সার মেশিন চলাকালে যে শব্দ হয়, নির্মাণস্থলটি যদি আবাসিক এলাকা বা এমন স্থানে হয় যেখানে শব্দ দূষণ গ্রহনীয় নয় তাহলে কনক্রিট প্রস্তুত করণ অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এসব সমস্যার থেকে রক্ষা পেয়ে কাক্সিক্ষত মানের কনক্রিট পাওয়ার জন্য বর্তমানে রেডি মিক্স কনক্রিট ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
রেডি মিক্স কনক্রিট প্রস্তুতি
কনক্রিট প্রস্তুতিতে একটি অনুপাত অনুসরণ করা হয়। এই অনুপাতটি হলো সিমেন্ট, বালি এবং খোয়ার (ইটের খোয়া বা পাথরের খোয়া)। সাধারণত ঢালাইয়ের কাজে ১:২:৩ বা ১:২:৪ বা ১:১.৫:৩ ইত্যাদি অনুপাত ব্যবহৃত হয়; সেই সাথে থাকে সিমেন্ট ও পানির অনুপাত।
রেডি মিক্স কনক্রিটের ক্ষেত্রে পূর্বে পরীক্ষাগারে কাক্সিক্ষত শক্তিমাত্রা বা কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন অনুপাত (সিমেন্ট, বালি, খোয়ার) এবং সিমেন্ট-পানির বিভিন্ন অনুপাত নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। যে অনুপাতটিতে কাক্সিক্ষত শক্তিমাত্রা বা এর সবচেয়ে কাছাকাছি মান পাওয়া যাবে। সেই শক্তিমাত্রার জন্য ঐ অনুপাতগুলোকে নির্ধারণ করা হবে।
পরবর্তীতে ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্ট্র্রেন্থের যে কনক্রিট প্রস্তুত করা হবে তা পূর্বে নির্ধারিত অনুপাত অনুযায়ী এর পরিমাণ অনুযায়ী (ক্লায়েন্ট যতটুকু সিএফটি কনক্রিটের অর্ডার দেবেন) এর উপাদান কাঁচামালসমূহ অর্থাৎ সিমেন্ট, বালি, খোয়া, পানি এদের পরিমাণগুলো নির্ণয় করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট পরিমাণের উপাদান সমূহ রেডি মিক্স প্ল্যান্টে স্বয়ংক্রিয় মিক্সিং মেশিনে কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে সরবরাহ করে মিশ্রিত করা হয়। এরপর মিশ্রিত কনক্রিট রেডি মিক্স কনক্রিট ক্যারিয়ারে নেয়া হয় ক্লায়েন্টের সাইটে পৌঁছানোর জন্য।
এক্ষেত্রে অনেক সময় কনক্রিটের গুণগতমান কিছুটা পরিবর্তন করার জন্য যেমন এর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, স্থাপন সময় বাড়ানো ইত্যাদি কারণে অ্যাডমিক্সার যোগ করা হয়। অ্যাডমিক্সার (অফসরীঃঁৎব) হলো এক প্রকার রাসায়নিক উপাদান, যা কনক্রিটে যোগ করে কনক্রিটের বিভিন্ন ভৌত বা রাসায়নিক ধর্ম পরিবর্তন করা হয়।
বাংলাদেশে রেডি মিক্স কনক্রিটের ধারণার উৎপত্তি
প্রাচীনকালে উপমহাদেশে মানুষের আবাসস্থল তৈরীর মূল উপাদান ছিল খড়, বাঁশ, ছন, টিন, মাটি, কাঠ ইত্যাদি। এরপর ধীরে ধীরে সেই স্থান দখল করল সিমেন্ট, বালি, ইট, পাথর ইত্যাদি।
উন্নত বিশ্বে রেডি মিক্স কনক্রিটের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৩০ সালে। কিন্তু শুরুর দিকে এটা খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৯৬০ সালের পর ইউরোপ ও আমেরিকায় যখন বড় বড় হাইওয়ে ও সুউচ্চ ভবন নির্মাণ শুরু হয়, তখনই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রেডি-মিক্স কনক্রিট। বিশ্বের বড় বড় সিমেন্ট কোম্পানিই মূলত রেডি-মিক্সের জন্য বিখ্যাত। এর মধ্যে মেক্সিকান সিমেন্ট কোম্পানি সিমেক্স, ফ্রান্সের লাফার্জ ও মধ্যপ্রাচ্যের ইউনিবেটন রেডি মিক্স অন্যতম।
ব্রিটিশ আমলে ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে সিমেন্ট আমদানী করা হতো। যা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে সে সময়ে পাকা বাড়ি অর্থাৎ ইট, বালি, সিমেন্ট দ্বারা তৈরী স্থাপনার সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।
পরবর্তীতে বাংলাদেশে প্রথম ছাতক সিমেন্ট কোম্পানী লিঃ নামে এদেশের প্রথম সিমেন্ট ফ্যাক্টরী ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে সরকারী বেসরকারী মিলিয়ে ৪০(চল্লিশ) টির ও বেশী সিমেন্ট কারখানা গড়ে উঠেছে। ফলে এক সময় যে সিমেন্ট বাংলাদেশে আমদানী করা হতো, সেই সিমেন্ট-ই এখন পৃথিবীর অন্য দেশে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানী করা হচ্ছে। প্রারম্ভিক পর্যায়ে এদেশে সিমেন্টের বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রায় ১,৩৫,০০০ মেট্রিক টনের মতো। বর্তমানে এই উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২,১১,৮৩,০০০ মেট্রিক টনে।
বর্তমানে এদেশে প্রায় সকল স্থাপনাই ইট, সিমেন্ট, বালির দ্বারা তৈরী হয়। এসব স্থাপনা নির্মাণে কনক্রিট একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ‘রেডি মিক্স কনক্রিট’ ধারনার উৎপত্তি ঘটে।
ভোক্তারা এখন প্রতিটি পণ্যের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। তারা চান নিখুঁত মানের সঠিক অনুপাতের মানসম্পন্ন পণ্য। কনক্রিটের ক্ষেত্রেও এর ব্যক্তিক্রম নয়। স্থাপনা নির্মানকারীরা চান মানসম্পন্ন উপাদানের সমন্বয়ে সঠিক অনুপাতে প্রস্তুত কনক্রিট যা অনেক সময় অদক্ষ শ্রমিক বা অন্যান্য নানা কারণে নির্মাণ সাইটে পাওয়া যায় না। এসব বিষয় বিবেচনা করেই উদ্ভব রেডি মিক্স কনক্রিট-এর।
এদেশে সিমেন্টের উৎপাদন ও ব্যবহার সবচেয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে আশির দশকে। পরবর্তীতে নব্বই এর দশকে রেডি মিক্স কনক্রিট উৎপাদন শুরু হয় যা সর্ব প্রথম শুরু হয় কনকর্ড গ্রুপের দ্বারা। তারা বাংলাদেশে সর্বপ্রথম রেডি মিক্স কনক্রিট এর গোড়াপত্তন করেন।
বর্তমানে রেডি মিক্স কনক্রিট উৎপাদন ও ব্যবহার ধারা
কনকর্ড গ্রুপ এদেশের প্রথম রেডি মিক্স কনক্রিট। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকাশ করার পর ধীরে ধীরে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, আব্দুল মোমেনগ্রুপ, বেসটেক, ডোম-ইনো, নাভানা, শাহ্, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারস্ (এনডিই), মীর কনক্রিট প্রোডাক্ট লিঃ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (বিডিসি), এ্যাডভান্স ডেভেলপমেন্ট টেকনোলজিস, আকিজ সিমেন্ট রেডি মিক্স কোম্পানী লিঃ ইত্যাদি বিভিন্ন কোম্পানী। এসব কোম্পানীর উৎপাদিত রেডি মিক্স কনক্রিট মূলত বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট র্ফাম, ডেভেলপার র্ফামগুলোতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এবং সেই সাথে ব্যক্তি মালিকানাধীন স্থাপনা নির্মাণেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব রেডি মিক্স কনক্রিট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাসিক উৎপাদন ক্ষমতা সর্বমোট প্রায় ৪৬,০০,০০০ সিএফটি এবং প্রতি মাসের দৈনিক সরবরাহকৃত ক্ষমতা প্রায় ১৯,৫০,০০০ সিএফটি।
রেডি মিক্স কনক্রিট ব্যবহারের সুবিধা
নির্মাণ সাইট থেকে দূরে মিক্সিং প্ল্যান্টেই কাঁচামাল সংরক্ষন ও মিশ্রন করা হয়। ফলে নির্মাণ সাইটে পরিবেশ ও শব্দ দূষনের সুযোগ নেই এবং নির্মাণ প্রক্রিয়া সহজ হয়।
উন্নত মানের কাঁচামাল স্বয়ংক্রিয়ভাবে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে সঠিক পরিমানে ব্যবহৃত হয় বলে এতে উচ্চমানের কংক্রিট তৈরি হয়, যা কনস্টিন্টিং স্ট্রেংথ এর নিশ্চয়তা দেয়।
ঢালাইয়ের প্রয়োজন অনুযায়ী রেডি মিক্স কংক্রিট ধারাবাহিকভাবে সরবরাহ করা হয়, ফলে ঢালাইয়ে আলাদা কোন সময় লাগে না। সনাতন মিক্সচার মেশিনের তুলনায় রেডি মিক্স প্ল্যান্টে প্রতি ব্যাচে প্রায় ১০ গুণ বেশি কংক্রিট উৎপন্ন হয়। যা গ্রাহকের সময় ও খরচ দুটোই সাশ্রয় করে।
রেডি মিক্স কংক্রিট ব্যবহারে যে কোন সময় বিশেষত বর্ষা মৌসুমেও ঢালাইয়ের কাজ অব্যাহত রাখা যায়।
রেডি মিক্স এ তৈরি ভবন শক্ত ও মজবুত হয়।
রেডি মিক্স দিয়ে ভবন নির্মাণ করলে ভূমিকম্পে ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম হবে।
রেডি মিক্স কনক্রিট ব্যবহারের অসুবিধা
পরিবহন রেডি মিক্সের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা।
রেডি মিক্সে পানি দেয়ার ১ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তা না হলে এটি গুণাগুণ হারিয়ে ফেলে। যদিও বিশেষ কেমিক্যাল ব্যবহার করে এটি ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়, তারপরও ১ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করাই উত্তম।
ছোট ও কম বাজেটে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রেডি-মিক্স ব্যবহার ব্যয়বহুল।
শেষের আগে
বর্তমান বিশ্বে নিত্য নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হচ্ছে নির্মাণ ক্ষেত্রে। তারই একটি অংশ হলো রেডি মিক্স কনক্রিট। ভবিষ্যতে এই রেডি মিক্স কনক্রিট যেন আরও অধিক পরিমাণে উৎপাদিত হয় দেশের নির্মাণ শিল্পকে যেন আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় তাই হোক আমাদের পাথেয়।
প্রকাশকাল: বন্ধন ২১ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১২