রেডি মিক্স কংক্রিটের শক্তি নির্ণয় পরীক্ষা

সিমেন্ট, বালি, পাথর/খোয়া এবং পানির সমন্বয়ে প্রস্তুতকৃত মিক্সচারই রেডি মিক্স কংক্রিট, যা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত মিক্সিং প্ল্যান্টে প্রস্তুত করা হয়। এটি তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারের উপযোগী অবস্থায় কংক্রিটবাহী ট্রাকে করে নির্মাণ সাইটে পেঁৗঁছে দেওয়া হয়।

ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কংক্রিটে সিমেন্ট, বালু, পানির অনুপাত ঠিক রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব উপাদানের সঠিক সমন্বয় না হলে ভবন হয়ে ওঠে ত্রæটিপূর্ণ, যা মানুষের জীবনের জন্যও মারাত্মক ঝুঁকির কারণ। এ ত্রæটি রোধেই উন্নত বিশ্বে রেডি মিক্সের আবির্ভাব। সব উপাদান পরিমাণ মতো ব্যবহৃত হয় বলে রেডি মিক্স কনক্রিটে বানানো ভবন শক্ত ও মজবুত। স্বাভাবিকভাবেই তাই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে রেডি মিক্স কংক্রিট (আরএমসি)। উন্নত বিশ্বে ভবন নির্মাণে অনেক আগে থেকেই এর ব্যবহার হয়ে আসছে। 

বর্তমানে আমাদের দেশে ভবন ঢালাইয়ে যে অনুপাতে কংক্রিট, সিমেন্ট, বালু ও পানি ব্যবহার করা হয় তা অত্যন্ত পুরনো পদ্ধতি। এখানে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কংক্রিট, সিমেন্ট, বালু ও পানি মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু রেডি মিক্স কংক্রিটে অনুমানের কোনো স্থান নেই। কারখানায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট মানের রেডি মিক্স কংক্রিট তৈরি হয়। রেডি মিক্স কনক্রিটের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম পাথর, বালু ও সিমেন্ট। এগুলোর গুণ ও মানের ওপর রেডি মিক্স কংক্রিটের মান ও দাম নির্ভর করে। সিমেন্ট ও বালুর ওপরও অনেক সময় মানের হেরফের হয়ে থাকে। তাই রেডি মিক্স কংক্রিটের ক্ষেত্রে অবশ্যই মানসম্পন্ন পাথর, বালু ও সিমেন্ট ব্যবহার করতে হবে।

নির্মাণ প্রকৌশলীদের মতে, বহুতল ভবন তৈরিতে অবশ্যই রেডি মিক্স কংক্রিট ব্যবহার প্রয়োজন। কারণ ভবন যত বেশি উঁচু হয়, ঝুঁকির মাত্রাও তত বেড়ে যায়। আর এ ঝুঁকি কমাতেই এর ব্যবহার অপরিহার্য। 

রেডি মিক্স কংক্রিটের টেস্ট

রেডি মিক্স কংক্রিট প্রস্তুতের পর এর শক্তি পরীক্ষা করা হয়। প্রস্তুতকৃত রেডি মিক্স কংক্রিট শক্তির নিশ্চয়তার জন্য ব্যবহার করা হয়। আর সেই নির্দিষ্ট শক্তিমাত্রা ৩০০০ পিএসআই থেকে আরও উচ্চতর পিএসআই পর্যন্ত শক্তি অর্জন করেছে কিনা তা বুঝবার জন্য এটি টেস্ট করা হয়। এই টেস্ট করা হয় যখন কংক্রিট প্রস্তুত করা হয় তখন এর থেকে কিছু পরিমাণ কংক্রিট দ্বারা সিলিন্ডার অথবা কিউব (বর্গাকৃতির ঘনক) প্রস্তুত করা হয়। এই সিলিন্ডার বা কিউব প্রস্তুত করা হয় মোল্ডের সাহায্যে। প্রস্তুতকৃত সিলিন্ডার বা কিউবগুলো শুকানোর পর এগুলোর সাহায্যে শক্তি পরীক্ষা করা হয়। সাধারণত এই টেস্টটি সিলিন্ডার তৈরির চৌদ্দ, একুশ অথবা আটাশতম দিনে করা হয়। তবে সাতদিনে যে টেস্টটি করা হয় তা মূলত সাটারিং খোলা যাবে কিনা তা পরীক্ষার জন্য করা হয়। আর নির্দিষ্ট শক্তি অর্জন করেছে কিনা তা বোঝার জন্য আটাশতম দিনে সিলিন্ডারটি টেস্ট করা হয়। আর এই কম্প্রেসিভ টেস্টটি ইউনিভার্সাল টেস্টিং মেশিনে  করা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে কিউব টেস্টের চেয়ে সিলিন্ডার টেস্টকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়।

কনক্রিটের কার্যকারীতা পরীক্ষায় স্টাম্প টেস্ট:

রেডি মিক্স কংক্রিট সাধারণত কংক্রিট ট্রানজিট মিক্সারে নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করে গ্রাহকদের চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ করে থাকে। তাই কংক্রিট এর কার্যকারিতা (ডড়ৎশধনরষরঃু) নির্ণয়ের জন্য উৎপাদন স্থানে এবং ঢালাই-এর স্থানে একটি পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষাটিকে “স্টাম্প টেস্ট” (ঝষঁসঢ় ঞবংঃ) বলে। এই পরীক্ষাটি ফ্রেশ কংক্রিট এর কার্যকারিতা নির্ণয় করতে সাহায্য করে।

ঝষঁসঢ় ঞবংঃ করার জন্যে স্টাম্প কোণ নামক মোল্ড ব্যবহার করা হয়। স্টাম্প কোণটির উপরের এবং নীচের অংশের ব্যসার্ধ যথাক্রমে ৪” এবং ৮”, এবং এর উচ্চতা ১২” স্টাম্প কোণটির উপরের অংশে দুই পাশে দুটি হাতল লাগানো থাকে। পুরো স্টাম্প কোণটি একটি মসৃণ, সমান্তরাল ষ্টিল প্লেট (ঝঃববষ চষধঃব) এর উপরে স্থাপন করে করা হয়। পরীক্ষা করার জন্যে ‘স্টাম কোণ’ (ঝষঁসঢ় ঈড়হব) মোল্ডটিকে দুই পায়ের মাঝ খানে শক্ত করে স্থাপন করে এর মধ্যে তিনটি সমান ধাপে কংক্রিট দ্বারা পূর্ণ করা হয়। প্রতিটি ফাকে ‘টেম্পিং রড’ দিয়ে সমান ভাবে পাঁচশত বার করে টেম্পিং করা হয়। মোল্ডটি কংক্রিট দ্বারা পূর্ণ হলে উপরের অংশটি ট্রাওয়েল (ঞৎড়বিষ) অথবা লেভেলার (খবাবষষবৎ) দিয়ে সমান করা হয়। এরপর মোল্ডটির উপরের দুইটি হাতল ধরে উলম্ব ভাবে ধীরে ধীরে তুলে ফেলা হয়। এরপর লক্ষ্য করা হয় কি পরিমাণ কংক্রিট নীচে অথবা আশে পাশে পড়ে গিয়েছে। মোল্ডটির উচ্চতা থেকে মোল্ডটি তুলে ফেলার পর কংক্রিটের উচ্চতাকে বাদ দিলে স্টাম্প সাইজ এর উচ্চতা পাওয়া যায়। সাধারণত স্টাম্প এর এই উচ্চতা ভেদে তিন ভাগে ভাগ করা হয় একে। ২”-৪” স্টাম্প উচ্চতা পর্যন্ত কংক্রিটের কার্যকারিতা ভালো বলে মনে করা হয়। তবে অবস্থান, দূরত্ব, সময়, শক্তিমত্তা ভেদে স্টাম্প এর উচ্চতা বিভিন্ন হতে পারে।

সিলিন্ডার প্রস্তুত প্রণালী 

সাধারণত অঝঞগ মেথড অনুসারে সিলিন্ডারের কম্প্রেসিভ টেস্ট করার জন্য ৬”ঢ২” অথবা ৪”ঢ৮” ইঞ্চি দুটি সাইজেরই সিলিন্ডারের মোল্ড তৈরি করা হয়।

সিলিন্ডার তৈরির জন্য কংক্রিট মিক্সার গাড়ি থেকে ‘হুইল কংক্রিট’এর মাধ্যমে কংক্রিট নিয়ে স্কুপের (ঝপড়ড়ঢ়) মাধ্যমে মিক্সড করে সিলিন্ডার মোল্ডে  কংক্রিট ভর্তি করা হয়। কংক্রিট ভর্তি করার সময় কংক্রিটের মধ্যে যাতে কোনো ফাঁকা জায়গা না থাকে সে জন্য টেম্পিং (ঞবসঢ়রহম জড়ফ) রড দিয়ে ‘টেম্পিং’ করা হয়। সাধারণত ৬ ইঞ্চিঢ১২ ইঞ্চি সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে তিনটি মান ধাপে টেম্পিং করা হয়। প্রতিটি ধাপে পঁচিশ বার টেম্পিং করা হয়। ৪ ইঞ্চিঢ৮ ইঞ্চি সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে দুটি সমান ধাপে টেম্পিং করা হয়। সাধারণত ৬ ইঞ্চিঢ১২ ইঞ্চি সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে ৫/৮ ইঞ্চি (১৫ মিমি) ব্যাসার্ধের এবং ৪ ইঞ্চিঢ৮ ইঞ্চি সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে ৩/৮ ইঞ্চি (১০ মিমি) ব্যাসার্ধের টেম্পিং রড ব্যবহার করা হয়। টেম্পিং করার সময় লক্ষ রাখা হয় যাতে চারদিকে সমানভাবে টেম্পিং করা হয়। সিলিন্ডার মোল্ডটি কংক্রিট দ্বারা পূর্ণ হয়ে গেলে লেভেলার দিয়ে উপরের সার্ফেসটি লেভেল করা হয়। সিলিন্ডার তৈরির সময় খেয়াল রাখা হয় যাতে সিলিন্ডারের মোল্ডটি সমান্তরাল সার্কেলের উপরে থাকে। এরপর কংক্রিটভর্তি মোল্ডটিকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নিরাপদ জায়গায় (ছায়াযুক্ত, উন্মুক্ত) সংরক্ষণ করা হয়। এভাবে মোল্ডটিকে ২৫০ঈ+৫০ঈ তাপমাত্রায় কমপক্ষে (২০) ঘণ্টা রাখা হয় যাতে কংক্রিট ভর্তি সিলিন্ডারটি জমাট বাঁধে। এরপর অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সিলিন্ডারটিকে মোল্ড থেকে মুক্ত করা হয় এবং কিউরিংয়ের জন্য পানি ভর্তি ড্রামে অথবা চৌবাচ্চার নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। এভাবে সিলিন্ডারটি একটানা একুশ দিন অথবা আটাশ দিন কিউরিং করে কম্প্রেসিভ স্ট্রেংথ টেস্ট করা হয়।

সিলিন্ডার টেস্টিং

সিলিন্ডার টেস্টের পূর্বে সিলিন্ডারটির উপরের এবং মাঝের অংশ লম্বভাবে ব্যাসার্ধ পরিমাপ করে গড় মান বের করে সিলিন্ডারটির ‘সার্ফেস এরিয়া’ নির্ণয় করা হয়। যদি ব্যাসার্ধ দুটির পার্থক্য ২% বেশি হয় সে ক্ষেত্রে সিলিন্ডারটি টেস্ট করা হয় না।

সিলিন্ডারের কম্প্রেসিভ স্ট্রেংথ টেস্ট করার পূর্বে সিলিন্ডারটির উপর এবং নিচের সার্ফেসটি ক্যাপিং করা হয়। ক্যাপিং করার জন্য বিটুমিন অথবা সালফার মর্টার (অংঃস প ৬১৭) অথবা নিউপ্রিন প্যাড ক্যাপ (অংঃস প ১২৩১) ব্যবহার করা হয়। সিলিন্ডারের উপর আরোপিত কম্প্রেসিভ লোড যাতে সমানভাবে বিস্তৃৃত হয় সেজন্য ক্যাপিং করা হয়। সাধারণত টেস্টিংয়ের ন্যূনতম দুটি মোল্ড থেকে একদিন পূর্ব পর্যন্ত ক্যাপিং করা হয়ে থাকে।

এরপর সিলিন্ডারটিকে কম্প্রেসন টেস্টিং মেশিনে নিয়ে বল (ভর) প্রয়োগ করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত সিলিন্ডারটি না ভাঙে। এরপর প্রয়োগকৃত ভরকে মোট সিলিন্ডারটির ‘সার্ফেস এরিয়া’ দিয়ে ভাগ করলে সিলিন্ডারটি ভাঙতে প্রয়োজনীয় মোট বল নির্ণয় করা যায়।

বিঃ দ্রঃ কমপক্ষে তিনটি সিলিন্ডার নিয়ে একটি সেট গঠন করে প্রতিটি ভাঙার মান নিয়ে গড় করা হয়। যদি সিলিন্ডার তিনটির সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন মানের পার্থক্য ১০% বেশি হলে গড় মান নেওয়া হয় না। সে ক্ষেত্রে কাছাকাছি দুটি মানের গড় নিয়ে সিলিন্ডার ক্যাপিং স্ট্রেংথ বের করা হয়।

প্রকাশকাল: বন্ধন ২১ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top