আগে সকালবেলায় ঘুম ভাঙত পাখির ডাকে। এরপর এল ঘড়ি; তারপরও সেলফোন বা মোবাইল। একঘেয়ে অ্যালার্ম বাজিয়ে এখন পাখির ভূমিকায় এরা। ঘড়ির আবেদন সময় ও অ্যালার্মে সীমিত থাকলেও মুঠোফোনের রয়েছে বহুমুখী কার্যকারিতা। ডিজিটাল ওয়্যারলেস সিস্টেম আর উন্নত প্রযুক্তিযোগে অনুষঙ্গটি যোগাযোগে এনেছে বৈপ্লবিকতা; যাপিত জীবনকে করেছে সহজ থেকে আরও সহজতর। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে মুঠোফোন ছাড়া এক দিনও কল্পনা করা যায় না। দিনের শুরুটা মুঠোফোনে, শেষটাও তা-ই। আর সারাক্ষণ যন্ত্রটি তো থাকছে আমাদেরই সঙ্গে। কিন্তু মুঠোফোনের যত্রতত্র ব্যবহার সবার অজান্তেই ফেলছে ঝুঁকিতে। এর মধ্যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিই প্রধান। আর এর জন্য দায়ী মুঠোফোনের টাওয়ারের ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন। যদিও এই ক্ষতির পক্ষে রয়েছে যথেষ্ট তথ্য ও উপাত্ত; হয়েছে বিস্তর গবেষণাও। তবুও সেলফোন কোম্পানি ও তাদের নিয়োজিত কিছু প্রতিষ্ঠান এটা পুরোপুরি স্বীকার করছে না। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও গবেষকদের মতামত এবং তার সঙ্গে আপনার অনুসন্ধানী সমীকরণটি হয়তো বা আগেরটির পক্ষেই যাবে।
বিশ্বব্যাপীই বেড়েছে মুঠোফোনের ব্যবহার। নভেম্বর, ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক সংগঠন International Agency for Research on Cancer (IARC)-এর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে মুঠোফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছয় বিলিয়নেরও বেশি। বাংলাদেশে মুঠোফোনের আগমন নব্বইয়ের দশকে। ধীরে ধীরেই বাড়েছে এর গ্রাহক। কিন্তু ২০০৫ সালের পর মুঠোফোনের দাম এবং কলচার্জ কমায় নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায় এর ব্যবহার। শহর, নগর, বন্দরের গণ্ডি ছাড়িয়ে মুঠোফোন পৌঁছেছে গ্রামে-গঞ্জে; হাটে-মাঠে; দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ফলে দেশে যোগাযোগব্যবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক উন্নয়ন। এর পেছনে দেশের টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে এখানে সেবাদানের থেকে ব্যবসাই মুখ্য। যেহেতু প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিযোগিতা, তাই কে কত দ্রুত উন্নতমানের ও আধুনিক সেবা দিতে পারে, সেটাই তাদের অগ্রাধিকার। কারণ, একটি থেকে আরেক ফোনে সংযোগ পেতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত সিগনাল বা নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে এসব প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর স্থাপন করেছে নেটওয়ার্ক টাওয়ার। একের পর এক গড়ে ওঠা এসব টাওয়ার ব্যবহৃত হচ্ছে বেজ স্টেশন হিসেবে। টাওয়ারে ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের দুই ধরনের রেডিও এন্টেনা সংযুক্ত থাকে। তার মধ্যে একটি রিসিভিং লো-ফ্রিকোয়েন্সি এন্টেনা (৭৯০-২১৮০ মেগাহার্জ) এবং অপরটি সাধারণ হাই-ফ্রিকোয়েন্সি এন্টেনা, যেটি ব্যাকবোন পয়েন্ট টু পয়েন্ট (৮-৮০ গিগাহার্জ)। এসব এন্টেনা আলাদা আলাদা তরঙ্গ ব্যবহার করে, যাকে বলে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (RF) সিগনাল (waves)। উঁচু ভবনের ছাদ, উঁচু পাহাড় অথবা সরাসরি মাটিতে উঁচু টাওয়ার স্থাপন করে মোবাইল টাওয়ার লিঙ্ক স্থাপন করা হয়। কারণ, সিগনাল পেতে ও এলাকা কাভার করতে এন্টেনাকে যথেষ্ট উঁচু হতে হয়। সাধারণত সে ক্ষেত্রে ৫০-২৫০ ফুট করা হয়। এগুলো স্থাপনের আগে পরিবেশের জন্য কতটুকু নিরাপদ তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করা হয়েছে কি না তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। ভবনের ওপর মুঠোফোনের টাওয়ার লিঙ্কযোগে রেডিয়েশন ওয়েভ তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ায় মানবদেহসহ আমাদের পরিবেশ ক্রমেই হয়ে উঠছে বসবাসের অনুপযুক্ত। রেডিয়েশন ওয়েভের থাবায় অনেকেই অসুস্থ হচ্ছে। কারণ, এখনো অধিকাংশ মানুষ মোবাইল রেডিয়েশন বা এ সংক্রান্ত তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কে অবগত নয়। এই রেডিয়েশন মানুষের জীবন ধারণের জন্য হুমকিস্বরূপ।

মাইক্রো রেডিয়েশন ওয়েভ
মাইক্রো রেডিয়েশন ওয়েভ বা তেজস্ক্রিয়তা ইতিপূর্বে নানাভাবে নির্গমন হলেও সম্প্রতি এই হার বেড়েছে বহুগুণে। রেডিয়েশন ওয়েভ ভূমি প্রেরণ কেন্দ্র থেকে তারবার্তার সংকেতগুলো মহাশূন্যে ঘূর্ণায়মান বিভিন্ন কৃত্রিম উপগ্রহে তরঙ্গমালা পাঠানো হয়। আর প্রেরিত তারবার্তার তরঙ্গমালা কাঁপতে কাঁপতে আবার ভূমিতে ফিরে আসে গ্রাহক কেন্দ্রে। সেই তরঙ্গমালার কাঁপিয়ে যাওয়াটাই মাইক্রো রেডিয়েশন ওয়েভ। তরঙ্গ চলাচল করার সময় তার আশপাশে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করে, যা থেকে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন উৎপন্ন হয়। যেহেতু মোবাইল টাওয়ারের দ্বারা তরঙ্গ ব্যবহৃত হয় তাই এখানে একটি শক্তিশালী রেডিয়েশন তৈরি হয় এর চারপাশকে কেন্দ্র করে। তরঙ্গ ব্যবহৃত হয়, এমন সব (মোবাইল, ব্লু-টুথ, ওয়াইফাই, জিপিএস, ল্যাপটপ, রেডিও টিভি) যন্ত্রেই ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড এবং ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন উৎপন্ন হয়। এই ওয়েভ শরীরের জন্য খুব ক্ষতি হবে না, যদি তা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় থাকে। প্রতিমুহূর্তে কী পরিমাণ ফোন কল সংঘটিত হচ্ছে তা নিয়ে যদি একটু ভাবা যায়, তাহলে দেখা যাবে, প্রতিমুহূর্তে লাখ লাখ ফোনকল সংঘটিত হচ্ছে। একবার ভাবুন তার থেকে কী পরিমাণ রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়ছে। এই রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (RF) ওয়েভ শরীরের টিস্যুকে উত্তপ্ত করাসহ নানা রকম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। যদিও এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মত রয়েছে। তবে মানবজাতিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার্থে সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন বিস্তর গবেষণা।

বাংলাদেশে মুঠোফোন ব্যবহারকারীর হার দেশের অর্থনীতির তুলনায় অনেক বেশি। এ দেশে ছয়টি মোবাইল ফোন অপারেটরের ৩০ হাজারেরও বেশি টাওয়ার আছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আবাসিক এলাকা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে অনেক দূরে এবং অনেক উঁচুতে টাওয়ার স্থাপন করা হয়। অথচ আমাদের দেশে মোবাইল ফোনের ৯০ শতাংশ টাওয়ার লোকালয়, বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি হাসপাতালের ছাদেও স্থাপন করা হয়েছে। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের হেড অব ডিপার্টমেন্ট ড. প্রাণ কানাই সাহা মুঠোফোনের টাওয়ার রেডিয়েশনবিষয়ক তাঁর গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বন্ধনকে বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে মোবাইল রেডিয়েশন দ্বারা একটি অঞ্চলের মানুষ কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয় তা এক দিনে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কারণ, এই ক্ষতির ব্যাপ্তিকাল দীর্ঘস্থায়ী। এটা ধীরে ধীরে মানবদেহের ক্ষতি করে। আমাদের গবেষণায় এমনটাই উপলব্ধি করেছি।’ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশনের মাত্রা মনিটর করা হলেও আমাদের দেশে তা হচ্ছে না। যেসব আবাসনসহ ভবনের ছাদে মোবাইল টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে, এতে রেডিয়েশনের ঝুঁকিতে শুধু ওই ভবনের লোকজনই নয় বরং পার্শ্ববর্তী ভবনসমূহের লোকজনও আক্রান্ত হয়। ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে, এই বিকিরণের প্রভাব বংশানুক্রমিক। দেশের মোবাইল কোম্পানিগুলো সঠিক ফ্রিকোয়েন্সি দ্বারা নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করছে কি না? এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড. প্রাণ কানাই সাহা আরও বলেন, ‘মোবাইল কোম্পানিগুলোকে এ বিষয়ে দোষারোপ না করে আমাদের ভাবা উচিত, আমাদের দেশে এ বিষয়ে কোনো আইন বলবৎ আছে কি না সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা।’ এসব সমস্যার পাশাপাশি টাওয়ারগুলো আবাসিক এলাকার সৌন্দর্য অনেকাংশেই নষ্ট করছে।
মানবস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
বিশ্বের কিছু স্বেচ্ছাসেবী ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেলুলার ফোন টাওয়ারের তেজস্ক্রিয়তার কোনো ক্ষতিকর প্রভাব আছে কি না সে বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছে। এটা গন্ধ, বর্ণ ও শব্দহীন এবং অদৃশ্য এক রশ্মি। মানবদেহ ও জীবজগতের জন্য এটা মারাত্মক ক্ষতিকর; অনেকটা স্লো পয়জনিংয়ের মতো। ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন নিউক্লিয়ার রেডিয়েশনের মতো এত দ্রুত প্রভাবিত করে না। এটা প্রাণীদেহে ধীরে ধীরে নানা রকম জেনেটিক পরিবর্তন ঘটায়। যেমন- ডিএনএ পরিবর্তন করে, টিস্যু সেল নষ্ট করে। তবে এই রেডিয়েশনের সবচেয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা ক্যানসার। বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চলছে বিস্তারিত গবেষণা। তবে এযাবৎকালের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে রেডিয়েশনের সঙ্গে ক্যানসারের সম্পর্ক কিছুটা প্রমাণও হয়েছে। যত্রতত্র টাওয়ারের এই তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণে অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকিও নেহাত কম নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে প্রমাণিত হয়েছে, এক লাখ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর মধ্যে ১০ জনই ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা, এ সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়ছে। এ ছাড়া প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট, বন্ধ্যত্ব, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথা, ডিপ্রেশন, কিছুই ভালো না লাগার মতো ব্যাপারগুলোও ঘটছে। বিকলাঙ্গ, কম ওজন, কম বুদ্ধিসম্পন্ন সন্তান প্রসব ও অকাল গর্ভপাতের ওপরও এই ইলেকট্রো ম্যাগনেট বিকিরণের ব্যাপক ভূমিকা, যা নানা গবেষণায় প্রমাণিত। ঘুমহীনতা, হঠাৎ মানসিক উত্তেজনা, ক্ষুধাহীনতা, উদাসীনতা এসব অনেকটা সাধারণ সমস্যা। মূলত রেডিয়েশনের প্রভাবে পরিপূর্ণ পুষ্টি দেহকোষের ভেতরে ঢুকতে পারে না এবং বিষাক্ত দ্রব্য বের হতেও পারে না। ফলে কোষ বিষাক্ত হয়ে যায়। তখন জেনেটিক পরিবর্তন ত্বরান্বিত হয় যেমন- অল্প বয়সে বৃদ্ধ হওয়া, চুল পাকা, স্মরণশক্তি লোপ, লিউকেমিয়ার মতো মারাত্মক রোগ ইত্যাদি। গবেষণায় দেখা গেছে, মোবাইল ফোন ব্যবহারের আগে ১৯৭০ সালে ১০ হাজার শিশুর মধ্যে অটিজম (মানসিক প্রতিবন্ধী) সংখ্যা পাওয়া যেত মাত্র একজন। ২০০৩ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৬ জন শিশুর মধ্যে একজন। বর্তমানে গবেষণায় অনেক বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক এই ইঙ্গিত পাচ্ছেন যে তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণের আঘাতে শিশুদের দেহকোষ ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। ফলে জেনেটিক ড্যামেজ সংঘটিত হচ্ছে, যা অটিজম থেকেও বেশি মারাত্মক। দেশের গবেষকেরা গবেষণায় দেখেছেন, পেশাগত দায়িত্ব পালন করার জন্য যাঁরা শক্তিশালী তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণে বেশিক্ষণ অবস্থান করছেন, তাঁরাই ব্রেন ক্যানসার, লিউকেমিয়া ও লিমফোম্মিয়ায় অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষত টেলিফোন লাইনম্যান, ইলেকট্রিক রেলওয়ে অপারেটর, ইলেকট্রিসিয়ান, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।

১৯৭৯ সালে আমেরিকান জার্নাল অব ইপিডেমিওলজিতে প্রকাশিত ড. নেনসি ভিওরথিমের গবেষণা থেকে দেখা যায়, আমেরিকার ডেনবার ও কলোরাডো এলাকায় উচ্চ তড়িৎ প্রবাহ লাইনের কাছে অবস্থিত ভবনসমূহে অবস্থানকারী শিশুদের মধ্যে লিউকেমিয়া ও ব্রেন ক্যানসারের মাত্রা নিম্ন তড়িৎ প্রবাহ লাইনের পাশের বাড়ির শিশুদের চেয়ে দুই গুণের বেশি। অন্যদিকে ৩৪৪ জন ক্যানসার আক্রান্ত শিশুর সঙ্গে প্রায় সমবয়সী কিন্তু তড়িৎ লাইনের নিকটে বসবাস করছে না এমন ৩৪৪ জন শিশুর তুলনা করে দেখেন যে পরবর্তী শিশুদের কোনো রকম ক্যানসার সৃষ্টি হয়নি। স্টকহোমের কারোলিনসা ইনস্টিটিউটের ড. মারিয়া ফেসিটিং এবং তাঁর সহকর্মীরা ১৯৯০ সালে একটি গবেষণায় দেখেন, যেসব বাড়িতে চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিমাণ তিন মিলিগাউসের বেশি, তাদের লিউকোমিয়া হওয়ার ঝুঁকি চার গুণেরও বেশি। এ ছাড়া ব্রিটিশ জার্নাল অব মেডিসিন, স্কানডেনেভিয়ান জার্নাল অব মেডিসিন এবং বায়ো ইলেকট্রো মেগনেটিকস জার্নালেও এ রকম আরও অনেক গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।
প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের ওপর প্রভাব
সেলফোন টাওয়ারের তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ যে শুধু মানুষেরই ক্ষতি করছে তা নয় বরং পশুপাখি ও উদ্ভিদকুলের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি সম্প্রতি আমাদের ইকো সিস্টেমে এই প্রভাব ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যেখানে ফোন টাওয়ার রয়েছে তার আশপাশের বসবাসকারী পাখিরা অন্যত্র চলে গেছে। এমনকি মৌমাছি, চড়ুই, কবুতর ও অন্যান্য উড়ন্ত পাখিরাও স্থানটিকে এড়িয়ে চলে। অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাও ঘটছে। যেমন- বাদুড় চোখে দেখে না, দিক নির্ণয়ের জন্য একধরনের শব্দ তরঙ্গ (সেন্সর) ব্যবহার করে যেন গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, ভবন, বৈদ্যুতিক খুঁটি বা উঁচু কিছুর সঙ্গে ধাক্কা না লাগে। কিন্তু এখন টাওয়ার এলাকায় ওড়ার সময় বাদুড়ের মনে হয় পথজুড়ে কিছু যেন গতি রোধ করে আছে। তাই তো বাদুড় মোবাইল টাওয়ার এলাকায় না এসে অনেক ওপর দিয়ে চলাফেরা করে। এ ছাড়া কবুতর, অতিথিসহ অন্য যেসব পাখি গন্তব্যে যেতে মস্তিষ্কের বিশেষ দিক নির্ণয়ক সেন্সর ব্যবহার করে, তারাও তরঙ্গের জালে নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে কাজটি করতে পারছে না; দিক নির্ণয়ে হচ্ছে সমস্যার সম্মুখীন। এমনকি অসংখ্য পাখি টাওয়ারকে কাকতাড়ুয়ার মতো মনে করে। ফলে টাওয়ার এলাকায় বাদুড় ও পাখির সংখ্যা কমছে উদ্বেগজনকভাবে। প্রজাপতি, মৌমাছি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গরা ফুলের পরাগায়ণ ঘটিয়ে ফল সৃষ্টিতে সহায়তা করে। কিন্তু রেডিয়েশনের প্রভাবে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন হচ্ছে বাধাপ্রাপ্ত। বর্তমানে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ মৌচাক কমে গেছে। এ ছাড়া ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
টাওয়ার থেকে নিঃসরিত রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়ছে প্রায় সর্বত্রই। যেহেতু এই রেডিয়েশন অত্যন্ত শক্তিশালী তাই এটা ভেদ করছে ইট-কংক্রিটের দেয়াল, কাচ, কাঠ ও অন্য মাধ্যমও। এমনকি রেডিও সিগনাল চউছ-কে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলে এর থাবা থেকে বাদ যাচ্ছে না গাছের ফলও। বিশেষ করে পানি জাতীয় (নারকেল) জাতীয় ফল। এই রশ্মি ফলের মধ্য দিয়েও চলাচল করছে এবং পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে পানি শুকিয়ে ফেলছে। ফলে আজকাল কচি ডাব আশঙ্কাজনক হারে কমেছে; ডাব হচ্ছে পানিশূন্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরেজমিনে এমন তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ ধরনের সমস্যা আগে কখনো ওইসব জনপদের মানুষ দেখেনি। সাম্প্রতিক গবেষণায় এ প্রমাণও মিলেছে, টাওয়ার এলাকায় গাছে ফুল ও ফল কম হচ্ছে এবং ফলের দাগ ও ঝরে পড়া বেড়েছে।

মোবাইল ও টাওয়ার রেডিয়েশন থেকে রক্ষায় করণীয়
যদিও শক্তিশালী এই তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষা পাওয়া খুব সহজ নয়। তবুও বিশেষজ্ঞরা মুঠোফোন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ও জনাধারণকে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন যেন কিছুটা হলেও আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারি। যেমন-
- আবাসিক এলাকা থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরে লোকালয়ের বাইরে টাওয়ার স্থাপন করতে হবে, অন্যথায় টাওয়ারের বাইরে বসতি গড়তে হবে।
- উচ্চতার হিসেবে কমপক্ষে ৪০ তলা ভবন সমান উঁচুতে মোবাইলের টাওয়ার স্থাপন করতে হবে।
- মোবাইল টাওয়ারে এন্টেনা মাটি থেকে ০০০০০০০০০০০.১ ন্যানোমিটার দূরে স্থাপন করতে হয় আর ওই এন্টেনা থেকে ৪০০ মিটার দূরত্বে মানুষের অবস্থান নিরাপদ।
- টাওয়ার থেকে নিঃসরিত তেজস্ক্রিয়তা যেন পরিমিত মাত্রায় থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
- শিশুদের থেকে কমপক্ষে পাঁচ ফুট দূরে মোবাইল রাখতে হবে।
- রাতে ঘুমানোর সময় মোবাইল কমপক্ষে সাত ফুট দূরে রাখতে হবে।
তেজস্ক্রিয়তা দেখা যায় না, অনুভব করা যায় না। অনেকটাই যেন নীরব ঘাতকের মতোই আমাদের ক্ষতি করে চলেছে। তবে এটা মোকাবিলায় বিশ্বের অনেক দেশই হয়েছে সচেতন; নিয়েছে কিছু পদক্ষেপ। নিয়ম মেনে এবং জনস্বাথ্যের কম ক্ষতি হয় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা নির্দেশনা দিয়েছে। যেমন- ভারতের উচ্চ আদালত ২০১২ সালে তাঁর দেশের জনগণকে রেডিয়েশনের এই মারাত্মক প্রভাব থেকে বাঁচাতে আবাসিক এলাকা, স্কুল, হাসপাতাল এলাকা থেকে টাওয়ার অপসারণের নির্দেশ দেন। বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের টাওয়ার নীতিমালা মেনে স্থাপন করা হয় না বলে রয়েছে অভিযোগ। যদিও তাঁরা বলেছেন, সরকারি বিধিমালা মেনেই তাঁরা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এখন প্রযুক্তির যুগ। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটু উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করলেই এই ঝুঁকির কবল থেকে অনেকটাই রেহায় পেতে পারি। সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়তো কিছুটা ব্যয় বেশি হবে। তারপরও যখন সবার সুস্থতার প্রশ্ন, সেখানে এটুকু মেনে নিয়ে নেটওয়ার্ক টওয়ার প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানো অবশ্যই উচিত। তা না হলে আমরা, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পড়ব মারাত্মক ঝুঁকির অনিষ্টে।
মারুফ আহমেদ
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৬ তম সংখ্যা, ফেবু্রুয়ারি ২০১৪