নির্মাণ শিল্পের অন্যতম উপাদান কংক্রিট, সিমেন্ট-বালি-খোয়া আর পানির সংমিশ্রণে যা তৈরি। খড়-কাঠ-বাঁশের পরিবর্তে পাকা বাড়ি বা দালান তৈরীর শুরু থেকে প্রধান নির্মাণ উপকরণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ কংক্রিটের। বর্তমানে নির্মাণ ও স্থাপত্য শিল্পে কংক্রিটের ভূমিকা অনেক। রেডিমিক্স কংক্রিট মিক্স কংক্রিটের আদর্শ রূপ। রেডিমিক্স কংক্রিট এমন এক ধরনের বিশেষায়িত কংক্রিট, যা ফ্যাক্টরি বা ব্যাচিং প্লান্টে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত অনুপাতে প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ মিশিয়ে তৈরি করা হয়। অতঃপর প্রস্তুতকৃত রেডিমিক্স কংক্রিট সরাসরি নির্মাণ সাইটে পৌঁছায় ট্রাক বা নির্দিষ্ট পরিবহনব্যবস্থায়। বিশেষ এ পদ্ধতিতে পরিমাণমত ও অধিক শক্তিসম্পন্ন কংক্রিট তৈরি করা যায় খুব সহজেই। অন্যভাবে বলা যায়, নির্মাণ প্রকৌশলীর চাহিদা ও প্রয়োজনমতো রেডিমিক্স কংক্রিট উৎপাদন করে সম্ভব নির্মাণ সাইটে সফলভাবে এর প্রয়োগ করা।
রেডিমিক্স কংক্রিট কি
সাধারণ কংক্রিট সিমেন্ট-বালি-খোয়া ও প্রয়োজনীয় পানির সুষম মিশ্রণ। এটি হাতে কিংবা ‘মিক্সার মেশিন’-এর সাহায্যে মিশানো হয়। সাধারণত নির্মাণস্থল বা সাইটে কংক্রিট মিশিয়ে ঢালাইয়ের কাজ করা হয়। মূলত এভাবেই তৈরি হয় কংক্রিট। সাধারণ কংক্রিটের লক্ষ্যনীয় বিষয়, এতে অনেক সময় সিমেন্ট-বালির অনুপাত, এমন কি পানির পরিমাণও ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। আবার ঢালাই চলাকালে মিক্সার মেশিন স্বশব্দে চলায় ঘটে শব্দ দূষণ। অনেক ক্ষেত্রে সাইটে মিক্সার মেশিন, কাঁচামাল রাখায় কংক্রিট তৈরির স্থান সংকুলান হয় না। এমন সব বিড়ম্বনার হাত থেকে রক্ষা পেতে উদ্ভব ‘রেডিমিক্স কংক্রিট’ এর। রেডিমিক্স কংক্রিট সাধারণ কংক্রিটের মতোই তবে এটি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় মেশিনে মিক্সিং প্লান্টে তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে কংক্রিট পরিবাহী ট্রাকে নির্মাণস্থলে সরবরাহ করা হয়। আর এ কারনেই এখন ধীরে হলেও দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে রেডিমিক্স কংক্রিট।

শুরুর কথা
আগে মানুষের আবাসস্থল তৈরীর মূল উপকরণ ছিল খড়, বাঁশ, ছন, টিন, মাটি, কাঠ ইত্যাদি। এরপর ধীরে ধীরে সেই স্থান দখল করল সিমেন্ট, বালি, ইট, পাথর। উন্নত বিশ্বে রেডিমিক্স কংক্রিটের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৩০ সালে। কিন্তু শুরুর দিকে এটা খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না। ১৯৬০ সালের পর ইউরোপ ও আমেরিকায় যখন বড় বড় হাইওয়ে ও সুউচ্চ ভবন নির্মাণ শুরু হয়, তখন ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রেডিমিক্স কংক্রিট। বিশ্বের বড় বড় সিমেন্ট কোম্পানি যেমন- মেক্সিকান সিমেন্ট কোম্পানি সিমেক্স, ফ্রান্সের লাফার্জ ও মধ্যপ্রাচ্যের ইউনিবেটনই মূলত রেডিমিক্স কংক্রিট উৎপাদনে প্রসিদ্ধ।
বর্তমানে এদেশে প্রায় সকল স্থাপনাই ইট, সিমেন্ট, বালি নির্মিত। এসব স্থাপনা নির্মাণে কংক্রিট এখন অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বহুল প্রচলন রেডিমিক্স কংক্রিট’র। দেশীয় সিমেন্টের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়তে থাকে আশির দশকে। পরবর্তীতে নব্বই এর দশকে এসে এর সাথে যুক্ত হয় রেডিমিক্স কংক্রিট। দেশে সর্বপ্রথম রেডিমিক্স কংক্রিটের যাত্রা শুরু হয় কনকর্ড গ্রুপের হাত ধরে। এরপর রেডিমিক্স কংক্রিট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, আব্দুল মোমেন গ্রুপ, বেসটেক, ডোম-ইনো, নাভানা, শাহ্, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারস্ (এনডিই), মীর কংক্রিট প্রোডাক্ট লিঃ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (বিডিসি), এ্যাডভান্স ডেভেলপমেন্ট টেকনোলজিস, আকিজ সিমেন্ট রেডিমিক্স কোম্পানী লিঃ মত বৃহৎ সব প্রতিষ্ঠান। এসব কোম্পানীর উৎপাদিত রেডিমিক্স কংক্রিট মূলত বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট ও ডেভেলপার র্ফামগুলোতে বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন স্থাপনা নির্মাণেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন দেশে রেডিমিক্স কংক্রিট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর মাসিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৪৬,০০,০০০ সিএফটি এবং প্রতি মাসের দৈনিক সরবরাহকৃত ক্ষমতা প্রায় ১৯,৫০,০০০ সিএফটি।
রেডিমিক্স কংক্রিট প্রস্তুতি
কংক্রিট প্রস্তুতিতে সিমেন্ট, বালি এবং খোয়ার (ইটের খোয়া বা পাথরের খোয়া) একটি অনুপাত অনুসরণ করা হয়। সাধারণত ঢালাইয়ের কাজে ১:২:৩ বা ১:২:৪ বা ১:১.৫:৩ অনুপাত ব্যবহৃত হয়। রেডিমিক্স কংক্রিটের ক্ষেত্রে পূর্বে পরীক্ষাগারে কাক্সিক্ষত শক্তিমাত্রা বা কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ পেতে সিমেন্ট, বালি, খোয়া নিয়ে বিভিন্ন অনুপাতে পরীক্ষা করা হয়। যে অনুপাতটিতে কাক্সিক্ষত শক্তিমাত্রা বা এর সবচেয়ে কাছাকাছি মান পাওয়া যায়। সেই শক্তিমাত্রার অনুপাতগুলোকে নির্ধারণ করে পরবর্তীতে ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্ট্র্রেন্থের কংক্রিট তৈরি করা হয়। প্রথমে নির্দিষ্ট পরিমাণের উপাদানসমূহ রেডিমিক্স প্ল্যান্টে স্বয়ংক্রিয় মিক্সিং মেশিনে কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে সরবরাহ করে মিশানো হয়। এরপর মিশ্রিত কংক্রিট রেডিমিক্স কংক্রিট ক্যারিয়ারের মাধ্যমে ক্লায়েন্টের সাইটে পৌঁছানো হয়। অনেক সময় কংক্রিটের গুণগতমান পরিবর্তন করে এর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, স্থাপন সময় বাড়ানো ইত্যাদি কারণে অ্যাডমিক্সার যোগ করা হয়। অ্যাডমিক্সার (Admixture) হচ্ছে এক প্রকার রাসায়নিক উপাদান, যা কংক্রিটে যোগ করে কংক্রিটের বিভিন্ন ভৌত বা রাসায়নিক ধর্মের পরিবর্তন করা হয়।

রেডিমিক্স কংক্রিটের বিশেষত্ব
সনাতন পদ্ধতিতে নির্মাণ সাইটে প্রস্তুত কংক্রিটের থেকে রেডিমিক্স কংক্রিটের ব্যবহার নির্মাণকাজের জন্য অধিক পছন্দনীয়। কেননা রেডিমিক্স কংক্রিটের ক্ষেত্রে কংক্রিটের উপাদানগুলো যথাযথভাবে মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করা হয়। যার ফলে বহুতল ভবনের নির্মাণ ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পায়। তা ছাড়া বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মিশ্রিত কংক্রিট ব্যবহারের ফলে কংক্রিটের বিভিন্ন উপাদান এবং এর প্রবাহের নমনীয়তা অনেকাংশে কমিয়ে দেয়।
রেডিমিক্স কংক্রিট বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত ভবনের জন্য বেশি গ্রহণযোগ্য। কেননা, রেডিমিক্স কংক্রিট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো ভবন নির্মাণকারীর পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন স্বীকৃত অনুপাত বা বাণিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠিত অনুপাত অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের কংক্রিট তৈরি করতে সক্ষম, যা বহুতল ভবন নির্মাণের সব শর্ত পূরণ করে।
রেডিমিক্স কংক্রিট বিশেষভাবে প্রস্তুত করে ক্রেতার চাহিদা অনুসারে নির্মাণ সাইটে সতেজ ও নমনীয় (plastic or unharden) অবস্থায় প্রেরণ করা হয়। রেডিমিক্স কংক্রিটের ক্রয় বা বিক্রয় করা হয় সাধারণত ঘনমিটারে। রেডিমিক্স কংক্রিট বিশেষ পদ্ধতিতে মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করা হয়। বর্তমান সময়ে নির্মাতার চাহিদা অনুযায়ী রেডিমিক্স কংক্রিট উৎপাদন করা হচ্ছে। কংক্রিটের গুণগতমানের প্রশ্নে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কংক্রিট, পানি ও সিমেন্টের অনুপাত বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
রেডিমিক্স কংক্রিটে নির্মিত রাস্তা এবং বহুতল ভবন পরিবেশবান্ধব। রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে ধুলা একটি বড় সমস্যা, যা রেডিমিক্স কংক্রিট ব্যবহারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তা ছাড়া রেডিমিক্স কংক্রিট দ্বারা নির্মিত ভবন খুব সহজেই প্রকৃতি, জলবায়ু ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। বিভিন্ন পরীক্ষণ পদ্ধতির সাহায্যে প্রতিনিয়ত রেডিমিক্স কংক্রিটের মান নিশ্চিত করা হয়।

রেডিমিক্স কংক্রিটের উপাদানসমূহের পরিমাণ সঠিকভাবে ও নির্দিষ্ট অনুপাতে ব্যবহারের ফলে যে সুফল পাওয়া যায়; তা হলো-
- নির্মাণসামগ্রীর অপচয় রোধ
- শ্রম ও মজুরি ব্যয় কমায়
- সংরক্ষণ বা মজুদ করে রাখার ব্যয় সাশ্রয়
- কমায় পরিবহন ব্যয়।
কংক্রিট বহুতল ভবনে ব্যবহৃত একটি নির্মাণসামগ্রী, যার দ্বারা ভবনের যেকোনো ধরনের আকৃতি প্রদান করা সম্ভব, যা অধিক দীর্ঘস্থায়ী। এটার কম্প্রেহেনসিভ স্ট্রেন্ড অনেক বেশি। যার ফলে সুন্দর এবং দীর্ঘস্থায়ী নির্মাণে এর ব্যবহার অপরিহার্য। যেকোনো ধরনের নির্মাণকাজে প্রথমে যে প্রশ্ন মনে আসতে পারে তা হলো রেডিমিক্স কংক্রিট অথবা সনাতন পদ্ধতিতে মিশ্রিত ও প্রস্তুতকৃত কংক্রিট কোনটা ব্যবহার করা ভালো? নির্মাণকাজের জন্য সাইটে তৈরি কংক্রিট ভালো ফলদায়ক। কিন্তু রেডিমিক্স কংক্রিট যেমন সাধারণত কংক্রিটের ফল প্রদানের পাশপাশি আনুষঙ্গিক সুবিধাও দিয়ে থাকে।
রেডিমিক্স কংক্রিটের যত সুবিধা
দ্রুত ও সহজ নির্মাণ
বাণিজ্যিকভাবে বহুতল ভবন নির্মাণকারী অনেক প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজের জন্য যে পরিমাণে কংক্রিট প্রয়োজন তা নির্মাণ সাইটে স্থানসংকুলান করে তৈরি করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ব্যাপক পরিমাণে কংক্রিট উৎপাদনে যে সময়ের প্রয়োজন হয় তাও অনেক সময় থাকে না। কিন্তু রেডিমিক্স কংক্রিট দ্বারা বহুতল ভবন নির্মাণ করলে এ ধরনের সমস্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। তা ছাড়া এর ফলে মূল ভবনের কাঠামোগত অন্যান্য নির্মাণশৈলীর ব্যাপারে অধিক মনোযোগ দেওয়া যায়।
নির্দিষ্ট কাজের জন্য প্রস্তৃতকৃত
রেডিমিক্স কংক্রিট সাধারণত একটি নির্মাণ সাইটের নির্দিষ্ট কাজের চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট শক্তিমাত্রার কংক্রিট তৈরি করে। তা ছাড়া রেডিমিক্স প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মিশ্র অনুপাতে ব্যবহার করে বিভিন্ন শক্তিমাত্রার কংক্রিট তৈরি করে থাকে। যার মধ্য থেকে নির্মাণে প্রদত্ত নকশা অনুযায়ী নির্দিষ্ট শক্তিমাত্রার কংক্রিট বেছে নেওয়া যায়।

সরাসরি নির্মাণ সাইটে প্রেরণ
রেডিমিক্স কংক্রিট উৎপাদনকারী ফ্যাক্টরি বা প্ল্যান্ট থেকে ১৫ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে অবস্থিত যেকোনো নির্মাণ সাইটে সরাসরি কংক্রিট পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। নির্মাতাদের পছন্দ অনুযায়ী আদর্শ রেডিমিক্স কংক্রিট তাদের নির্মাণ সাইটে প্রেরণ করা হয়। সাধারণত রেডিমিক্স কংক্রিট প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর কংক্রিট বহনের জন্য বিশেষ ধরনের পরিবহনব্যবস্থা রয়েছে। যার দ্বারা নির্মাতারা চাহিদা অনুযায়ী যেকোনো পরিমাণের কংক্রিট সরবরাহ করতে পারে। রেডিমিক্স কংক্রিট অর্ডার করার আগে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হতে হবে যাতে নির্মাণ সাইটটি নির্মাণকাজের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত কি না।
রোধ করে সময়ের অপচয়
এখন অনেক বাণিজ্যিক বহুতল ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান নির্মাণ সাইটে কংক্রিট তৈরি করে অতঃপর নির্মাণে ব্যবহার করে। ফলে নির্মাণকাজে সময় অনেক বেশি লাগে, যা সার্বিকভাবে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শেষ করতে অনেক বেশি সময় নেয়। তা ছাড়া এ ধরনের নির্মাণকাজের জন্য অনেক বেশি নির্মাণ শ্রমিকের প্রয়োজন। আবার সব সময় দক্ষ শ্রমিকও পাওয়া যায় না, যা ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণকাজের অন্যতম কারণ। তা ছাড়া নির্মাণ শ্রমিকদের অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রেখে এই কাজের জন্য নিয়োগ করা হয়। কিন্তু রেডিমিক্স কংক্রিট ব্যবহার করে নির্মাণকাজ করলে এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় না। শুধু রেডিমিক্স কংক্রিট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজন অনুযায়ী অর্ডার করে নির্দিষ্ট সময় এবং নির্মাণ সাইটের অবস্থান জানিয়ে দিলে বাকি কাজটি তারা নিজ দায়িত্বে সম্পন্ন করে। এর ফলে নির্মাণকাজে সময়ের অপচয় অনেকাংশে কমে।
কংক্রিটের সহজলভ্যতা
নির্মাণ সাইটে কংক্রিট প্রস্তুত করে নির্মাণকাজে প্রথমে ঠিক করতে হয় যে কী পরিমাণ কংক্রিটের প্রয়োজন হবে, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজটি শেষ না করে অধিক সময় অব্যবহৃত অবস্থায় কংক্রিট রেখে দিলে তা জমাট বেঁধে যেতে পারে, যা পরবর্তী সময়ে নির্মাণকাজে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কিন্তু রেডিমিক্স কংক্রিটের ক্ষেত্রে এসব ভাবতে হয় না। কেননা সম্পূর্ণ কাজটি একবারেই শেষ করা যায়।

মানসম্মত কংক্রিটের নিশ্চয়তা
যারা দীর্ঘদিন নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত, তারা খুব সহজেই বোঝে কংক্রিট তৈরিতে যেকোনো একটি উপাদানের পরিমাণ বেশি বা কম হলে কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। অনুমাননির্ভর নির্মাণ উপাদানের মিশ্রণের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত অনুপাত মিশিয়ে তৈরি হয় রেডিমিক্স কংক্রিট। তাই রেডিমিক্স কংক্রিট দ্বারা নির্মাণকাজ পরিচালনা করলে ভবনে নির্মাণ ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। তা ছাড়া সঠিক মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রেডিমিক্স কংক্রিট তৈরি হয় বলে নির্মাণকাজের জন্য উপযুক্ত ও মানসম্মত কংক্রিট পাওয়া যায়।
খরচ কমায় রক্ষণাবেক্ষণের
রেডিমিক্স কংক্রিটে নির্মিত বহুতল ভবন পেভমেন্টগুলো সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের খরচও অনেক কম। আর্দ্রতা ভবনের কাঠামোর অন্যান্য অংশের ক্ষতিসাধন করলেও রেডিমিক্স কংক্রিটের ওপর এর কোনো প্রভাব নেই। বরং কংক্রিটগুলো সময়ের সঙ্গে আরও অনেক বেশি শক্তি অর্জন করে। যার দরুন কংক্রিটে নির্মিত হাজার বছরের পুরোনো ভবনগুলো রয়েছে এখনো অক্ষত।
স্থানীয় কাঁচামালে তৈরিতে
কংক্রিট তৈরির সব উপকরণ; যেমন: চুনাপাথর, বালু, পানি, যা কংক্রিটের আয়তনের প্রায় ৯০ শতাংশ। কংক্রিটের এই উপাদানসমূহ আমাদের দেশের সর্বত্র ব্যাপক পরিমাণে পাওয়া যায়। সিমেন্ট কংক্রিটের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা এখন বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে।

কংক্রিটের আরো যা সুবিধা
- ভবন ঢালাইয়ের কাজে রেডিমিক্স কংক্রিট ব্যবহার করে এক দিনে যতটুকু কাজ করা সম্ভব, একই পরিমাণ ঢালাই সনাতন পদ্ধতিতে করতে সময় লাগে চার দিন।
- নির্মাণসামগ্রী বা কংক্রিটের প্রধান উপাদানসমূহকে সংরক্ষণ করার জন্য অতিরিক্ত কোনো জায়গার প্রয়োজন হয় না।
- রেডিমিক্স কংক্রিট ব্যবহার করলে নির্মাণ সাইটে কংক্রিট প্রস্তুত করতে যেসব শ্রমিকের প্রয়োজন হয়; তাও লাগে না।
- নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার জন্য যেসব নির্মাণসামগ্রী ভাড়া করতে হয় তার পরিমাণ অনেকাংশে কমে যায়।
- কংক্রিট প্রস্তুত করতে যেসব উপাদানের প্রয়োজন হয়, তার অপচয় অনেকাংশে কমে যায়।
- রেডিমিক্স কংক্রিটে নির্মিত ভবনে অদক্ষ নির্মাণশ্রমিক দ্বারা ভবনের নির্মাণ ঝুঁকি অনেক কমে।
- রেডিমিক্স কংক্রিট ব্যবহার করলে বহুতল ভবনের ওপরে কংক্রিট ওঠাতে কোনো সমস্যা হয় না। কেননা রেডিমিক্স কংক্রিট খুব সহজেই পাম্প করে বহুতল ভবনের ওপরে ওঠানো সম্ভব।
- রেডিমিক্স কংক্রিট ব্যবহারে এতে ভবনের নির্মাণ খরচ অনেক কমে যায়।
- নির্মাণ সাইট থেকে দূরে মিক্সিং প্ল্যান্টেই কাঁচামাল সংরক্ষন ও মিশ্রন করা হয়। ফলে নির্মাণ সাইটে পরিবেশ ও শব্দ দূষনের সুযোগ নেই এবং নির্মাণ প্রক্রিয়া সহজ হয়।
- উন্নতমানের কাঁচামাল স্বয়ংক্রিয়ভাবে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে সঠিক পরিমানে ব্যবহৃত হয় বলে এতে উচ্চমানের কংক্রিট তৈরি হয়, যা কনস্টিন্টিং স্ট্রেংথ এর নিশ্চয়তা দেয়।
- ঢালাইয়ের প্রয়োজন অনুযায়ী রেডিমিক্স কংক্রিট ধারাবাহিকভাবে সরবরাহ করা হয়, ফলে ঢালাইয়ে আলাদা কোন সময় লাগে না। সনাতন মিক্সচার মেশিনের তুলনায় রেডিমিক্স প্ল্যান্টে প্রতি ব্যাচে প্রায় ১০ গুণ বেশি কংক্রিট উৎপন্ন হয়। যা গ্রাহকের সময় ও খরচ দুটোই সাশ্রয় করে।
- রেডিমিক্স কংক্রিট ব্যবহারে যে কোন সময় বিশেষত বর্ষা মৌসুমেও ঢালাইয়ের কাজ অব্যাহত রাখা যায়।
- রেডিমিক্স কংক্রিট এ তৈরি ভবন শক্ত ও মজবুত হয়।
- রেডিমিক্স কংক্রিট দিয়ে ভবন নির্মাণ করলে ভূমিকম্পে ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমে।
অসুবিধা যত
রেডিমিক্স কংক্রিট ব্যবহারে অনেক সুবিধার পাশাপাশি এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যদিও এর অধিকাংশ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। এর সীমাবদ্ধতাগুলো হচ্ছে-
রেডিমিক্স কংক্রিটের উপাদানগুলো বাছাই এবং মিশ্রণ সবকিছুই শুরু হয় ফ্যাক্টরি বা প্লান্টে। যার ফলে রেডিমিক্স কংক্রিট তৈরি করে অধিক দূরত্বের নির্মাণ সাইটে প্রেরণ করা; যেমন কঠিন, তেমনি সময়সাপেক্ষ। তা ছাড়া রেডিমিক্স কংক্রিট প্রেরণ করতে অধিক সময় লেগে গেলে তা জমাট বাঁধতে শুরু করে। যার ফলে কংক্রিটের শক্তিমাত্রায় প্রভাব ফেলতে পারে এবং এর ফলে রেডিমিক্স কংক্রিটকে নির্দিষ্ট স্থানে ও আকৃতিতে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। রেডিমিক্স কংক্রিটে পানি দেয়ার ১ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তা না হলে এটি গুণাগুণ হারিয়ে ফেলে। যদিও বিশেষ কেমিক্যাল ব্যবহার করে এটি ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়, তারপরও ১ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করাই উত্তম।

উন্নয়ন দ্রুতগতিতে হওয়ার কারণে বর্তমানে গাড়ির সংখ্যা বাড়ার পাশপাশি বেড়েছে রাস্তায় যানজটের পরিমাণও। আর রাস্তার এ যানজটের কারণে যথাসময়ে রেডিমিক্স কংক্রিট নির্মাণ সাইটে পৌঁছাতে দেরি হয়।
রেডিমিক্স কংক্রিট সনাতন পদ্ধতিতে নির্মাণ সাইটে প্রস্তুত কংক্রিটের থেকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি ব্যয়সাপেক্ষ।
রেডিমিক্স কংক্রিট সাধারণত Tension-এ কিছুটা দুর্বল হয়।
যেহেতু কংক্রিট ভঙ্গুর প্রকৃতির, তাই shear-এর বিপরীতে এর শক্তি পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত নির্মাণকাজে ব্যবহারের আগে।
বর্তমানে আধুনিক কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে সবকিছুর অনুপাত ঠিক রেখে সঠিক মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রেডিমিক্স কংক্রিট উৎপদিত হচ্ছে। আগে যা ধারণা, অভিজ্ঞতা কিংবা অনুমাননির্ভর ছিল। ভবন নির্মাণে মানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ এবং ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রয়োজনে রেডিমিক্স কংক্রিটকে গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ উপকরণ হিসেবে ধরা হয়। তাই উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও আধুনিক নির্মাণশিল্পে রেডিমিক্স কংক্রিট’র ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। আধুনিক মেশিনারিজ ও সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর নির্মাণ পদ্ধতির মাধ্যমে রেডিমিক্স কংক্রিট প্রস্তুত করায় নির্মাণকাজে রেডিমিক্স কংক্রিটের জনপ্রিয়তা অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। যার ফলে দিন দিন বাড়ছে রেডিমিক্স কংক্রিটের চাহিদা।
প্রকৌশলী সনজিত সাহা
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪২ তম সংখ্যা, অক্টোবর ২০১৩