ব্রিটিশ আমলে এ দেশে হিন্দু জমিদারদের আধিপত্য ছিল। তাদের তৈরি অসংখ্য জমিদারি প্রাসাদ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্ব কারুকাজ করা বিশাল ভবন। দেয়ালের পরতে পরতে সৌন্দর্যের ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া যায় এখানে। অন্যান্য জমিদারবাড়ির চেয়ে একটু হলেও বাড়তি সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় পুরনো ঢাকার রূপলাল হাউস জমিদারবাড়িতে। এখানে এলে খানিকটা সময়ের জন্য আপনি চলে যেতে পারেন অতীতে। হয়তো চোখের সামনে ভেসে উঠবে, কানে ভেসে আসবে জমিদারবাড়ির আগের কোলাহল। কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনটা ভালো হয়ে যাবে। তবে সেই সঙ্গে একটু দুঃখবোধও মনের কোণে উঁকি দিতে পারে। কারণ রূপলাল হাউসে বসবাসকারী অনেক বাসিন্দাই জানে না যে তাদের বসবাসকৃত ভবনটির নাম রূপলাল হাউস।
পেছনের কথা
১৭৩০ সালে ফরাসিরা এ দেশে আসে ব্যবসার উদ্দেশ্যে। বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত একটি বাড়ি শেখ মতিউল্লাহর কাছ থেকে ফরাসিরা কিনে তাতে তাদের কুঠি তৈরি করে। যা বর্তমানে আহসান মঞ্জিল নামে পরিচিত। নায়েব আজিম এবং নেওয়াজিস আলি খানের অনুমতিক্রমে ফরাসিরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাজার তৈরি করে নাম দেয় ‘ফ্রেন্সগঞ্জ’ যা পরর্বতীকালে বর্তমানে ‘ফরাশগঞ্জ’ নামে পরিচিত। তাদের ব্যবসা লাভজনক না হওয়ার ফলে ১৭৮৪ সালে তারা চলে যান। এরপর আরমেনিয়ান জমিদাররা ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে এলাকাটি লিজ নেন। ১৮৩৫ সালে নবাব আলিমুল্লাহ খান আহসান মঞ্জিলকে পুনরায় কিনে নেন। তারও আগে ১৮২৫ সালে আরমেনিয়ান জমিদার আরাতুন আহসান মঞ্জিলের সামান্য দূরে বুড়িগঙ্গার কোল ঘেঁষে (বর্তমান ১৫ নং ফরাশগঞ্জে) একটি প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করেন। ১৮৩৫ সালে রূপলাল দাস এবং তার ভাই রঘুনাথ দাস বাড়িটি কিনে নেয়। এর পর থেকে বাড়ির নাম হয় রূপলাল হাউস।
কে এই রূপলাল দাস
রূপলালের আদি নিবাস বুড়িগঙ্গার অপর পারে শুভাঢ্যা গ্রামে। তার দাদা মথুরানাথ পোদ্দার ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে শুরু করেন পোদ্দারি ব্যবসা। তিনি তখন বাট্টা দিয়ে টাকা, আধুলি, সিকি ইত্যাদি মুদ্রা ভাঙিয়ে দিতেন। মথুরানাথ তখনকার দিনে প্রতিদিন বাংলাবাজারে রাস্তার উপর চট পেতে টাকা ভাঙানোর দোকান সাজিয়ে বসতেন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে বাংলাবাজার ছিল পয়সা লগ্নি ও টাকা বিনিময়ের কেন্দ্র। মেধা ও শ্রমের কারুকার্যে মথুরানাথ খুব অল্প সময়ে অসম্ভব সফলতা অর্জন করেন। তখন তিনি পথের ধারের দোকান উঠিয়ে বাংলাবাজারে জমি কিনে নিজস্ব দোকান দিয়ে বসেন (বর্তমানে দোকানটি নওরোজ কিতাবিস্থান বইয়ের দোকান)। পরে তিনি মুদ্রা ভাঙানোর কাজ ছেড়ে দিয়ে লগ্নি ও হুন্ডির কারবারে নামেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মথুরানাথ তৎকালীন এক টাকায় বছরে ৫৭০ টাকা সুদ নিতেন। ব্যবসার ধারাবাহিক উন্নতির ফলে ক্রমেই মথুরানাথ ঢাকার শ্রেষ্ঠতম ধনাঢ্য হিন্দু ব্যবসায়ীতে রূপান্তরিত হন। ১৮৬০-এর দশকে সামাজিক প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্যে মথুরানাথের পুত্র রূপলাল দাসও জমিদারি কিনতে শুরু করেন। তিনি ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন এবং সেই সময় স্কলারশিপ পেয়েছিলেন ১০ টাকা। যতদূর জানা যায়, তিনি একজন সঙ্গীত অনুরাগী ছিলেন। সামাজিক কর্মকান্ডে তার যত না অংশগ্রহণ থাকত তার চেয়ে বেশি খরচ করতেন সঙ্গীতের পেছনে। সেই সময়ে রূপলাল হাউসে নিয়মিত সঙ্গীতের আসর হতো। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ ওয়ালী উল্লাহ খাঁ এবং লক্ষ্মী দেবীসহ আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি রূপলাল হাউসে সঙ্গীত আসরে নিয়মিত আসতেন। ১৮৮৮ সালে ভারতের ভাইস লর্ড ডাফরিন ঢাকা সফরকালে রূপলাল হাউসে আসেন। তার সম্মানে রূপলাল বল নাচের (Bandance) আয়োজন করেছিলেন। বাংলা ভাষীদের গর্বের ধন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রূপলাল হাউসে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। বাউন্ডেলে যাযাবর দুখু নজরুল অসম প্রতিভার পরিবেশনায় রূপলাল হাউস মাতিয়েছিলেন। জনশ্রুতি আছে, সেই সময়ে তাদের সম্মানে নাচ গানের আসর কোথায় হবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় আহসান মঞ্জিল এবং রূপলাল হাউসের মধ্যে। এতে অনেক বেশি ভোটে বিজয়ী হয় রূপলাল হাউস। সেই সময়ে ৪৫ হাজার টাকা ব্যয়ে রূপলাল হাউসের আধুনিকীকরণ করা হয়। আর সেই সময়কার বিদেশিরা ঢাকায় এলে রূপলাল হাউসে ভাড়া করে থাকতেন। সেই যুগে রুমপ্রতি ভাড়া প্রদান করতেন ২০০ টাকা।
কেমন ছিল রূপলাল হাউস
তখনকার যুগের অত্যন্ত ব্যয়বহুল নির্মাণ রূপলাল হাউস। ইংরেজি ‘ই’ আকৃতির বাড়িটি যোগাযোগের সুবিধার্থে বুড়িগঙ্গার তীরে নির্মাণ করা হয়। ইউরোপিয়ান নির্মাণ কৌশলে রূপলাল হাউসের ডিজাইন করে কলকাতার মার্টিন কোম্পানি। রূপলাল হাউস সম্পূর্ণ ভিন্ন স্থাপত্যরীতির দুটি অসমান ব্লকে বিভক্ত একটি দ্বিতল প্রাসাদ। এটি প্রায় ৯১.৪৪ মিটার দীর্ঘ। বাড়িটির পেছনে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গা নদী থেকে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা যেত। রূপলাল হাউস ঔপনিবেশিক আমলে প্রবর্তিত পরবর্তী রেনেসাঁ যুগের ইউরোপীয় স্থাপত্যের এক চমৎকার উদাহরণ। এর গঠন কাঠামো অ্যালফাবেট ই আকৃতির। যার তিন বাহু নগরের দিকে প্রসারিত। মাঝের বাহুটি সবচেয়ে বড়। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮.৩৩ মিটার। এ ভবনটির ছাদ নির্মিত হয়েছিল কোরিন্থীয় স্টাইলে। এর উপরে রয়েছে পেডিমেন্ট। যা রেনেসাঁযুগীয় পেডিমেন্টের অনুকরণে নির্মিত, দ্বিতীয় তলায় দুটি ব্লকে বিভিন্ন আয়তনের ৫০টিরও বেশি কক্ষ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল পশ্চিম ব্লকের উপর তলায় অবস্থিত নাচঘরটি। এ ঘরের মেঝে ছিল কাঠের। পুরো বাড়িতে উত্তর-দক্ষিণ পাশে রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দা দুটি সেমি-কোরিন্থীয় স্তম্ভ বা সমায়ত ইটের থামের উপর স্থাপিত। এ স্তম্ভ বা থামসমূহের উপর বিভাজিত ত্রিপদ খিলান ছিল। তৎকালীন ঢাকার নবাববাড়ি তথা আহসান মঞ্জিলের সাথে তুলনা করার মতো একমাত্র বাড়ি ছিল রূপলাল হাউস। গ্রীক স্থাপত্যশৈলীতে এসেছিল এক অমর নতুনত্ব। তৎকালীন ঢাকার কোনো বাড়িতে ছিল না। রূপলাল হাউসের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বাড়ির উপরে মাঝখানে স্থাপিত একটা প্রকান্ড ঘড়ি, যা ঢাকা শহরের সম্মুখভাগের সমস্ত নদী বা খাল থেকে দেখা যেত। নৌ-পথে চলাচলকারী মাঝি বা নৌকারোহীরা এ ঘড়ি দেখে সময় নির্ধারণ করতেন। ১৮৯৭ সালের দিকে হঠাৎ ভূমিকম্পে ঘড়িটির চূড়া ভেঙে গেলে পরবর্তী সময়ে তা আর মেরামত করা হয়নি। এরপর প্রায় পঞ্চাশ বছর বাড়িটির অনেক অংশ প্রায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। রূপলাল হাউসের একপাশে সুন্দর বাগান ছিল যা ‘রঘুবাবুর বাগান’ এবং একপাশে একটি পুল ছিল, যা শ্যামবাজার পুল নামে পরিচিত ছিল। কালের বিবর্তনে অযত্নে অবহেলায় এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এর পর নদীকে ঘিরে বাজার গড়ে ওঠে, যার নামকরণ করা হয় শ্যমবাজার। বাড়ির ভেতরের অংশে ইউরোপিয়ান অফিসার এবং ব্যবসায়ীরা থাকার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ১৯৩০ সালের দিকে নদীর অংশটি ব্যবসা কেন্দ্র হয়ে ওঠার পর বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠলে তারাও জায়গাটি ত্যাগ করেন।
স্থাপনার পরিবর্তন
রূপলাল হাউসের সর্বশেষ মালিক রূপলালের পৌত্র যোগেন্দ্র দাস এবং তারকনাথ দাস। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর যোগেন্দ্র ও তারক সপরিবারে ভারতে পাড়ি জমান। শেষ হয় রূপলাল হাউসের এক পর্বের ইতিহাস। এখানেই শেষ নয়। ১৯৪৮ সালে বাড়িটি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সিদ্দিক জামাল নামে একজন দাবি করেন যে তিনি দাস পরিবার থেকে ১৯৭১ সালে রঘুনাথের অংশটি কিনে নিয়েছেন। সেই সুবাদে তিনি ২য় তলায় বসবাস শুরু করেন। তারই সূত্র ধরে সিদ্দিক জামালের মৃত্যুর পর তার ছেলে দাউদ জামাল ১৯৭৩ সালে ভারতে চলে যান, এর পর নূরজাহান ও তার স্বামী দাবি করেন যে এই অংশটি তাদের এবং তারা বর্তমানে দখলে আছেন। তারা এখানে গত তিরিশ বছর ধরে বসবাস করছেন। রূপলাল দাসের অংশটিতে প্রিন্স করিম আগাখান প্রিপারেটরি স্কুল চালু হয় ১৯৫৮ সালে। ১৯৭৩ সালে তা কলেজে উন্নীত হলে মাত্র ১৬ দিনের মাথায় তা গুটিয়ে ফেলা হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার রক্ষীবাহিনীর জন্য বাড়িটি রিকুজিশন করে। রক্ষীবাহিনীর বিলুপ্তির পর ১৯৭৬ সালে রূপলাল হাউসকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
বর্তমান অবস্থা
এ তো গেল ইতিহাসের কথা। বর্তমানে কেমন আছে রূপলাল হাউস। কাগজ কলমে আর বাস্তবতায় আকাশ পাতাল ব্যবধান। অতীতের সেই সব কথা আজ শুধুই স্মৃতি। রূপলাল হাউস তার রূপ হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই আর এখন অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে। কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে, মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। ছাদ, কার্নিস এবং অন্যান্য স্থানে বটগাছ গজিয়েছে। কিন্তু বসবাসকারীরা নির্বিঘ্নে বসবাস করে যাচ্ছে। চারদিকে অসংখ্য দোকানপাটসহ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ফলে মূল ভবনকে খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। নদীতে গিয়ে ছবির সাথে বাড়িটিকে মেলানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু সামনের দোকানের জন্য মূল নকশা বিলীন হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবে সেই সিঁড়িঘাট দুটি এখনো আছে।
আসলে কী হচ্ছে তা আমরা অনেকেই জানি না। বসবাসকারী অনেক বাসিন্দার সাথে কথা বলে জেনেছি, এ বাড়ির নাম রূপলাল হাউস এটা অনেকেই জানেন না। অপরদিকে বাড়ির বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন মালিকের নামে (জামাল হাউস, আনোয়ারা হাউস ইত্যাদি) সাইন বোর্ড লাগানো আছে। প্রত্যেকেরই দাবি, এই অংশটি তাদের। এ বিষয়ে তারা আইনি লড়াইও চালিয়ে যাচ্ছেন। নিচতলার পুরোটাই ব্যবসায়ীদের দখলে। এখানে প্রতিদিন বসে পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ কাঁচা সবজির আড়ত। যার বড় অংশটাই রূপলাল হাউসের নিচতলায়।
কর্তৃপক্ষ
১৯৭৪ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এ পরিত্যক্ত বাড়িটি রক্ষীবাহিনীর জন্য রিকুজিশন করে নেয়। রক্ষীবাহিনীর বিলুপ্তি ঘোষণার পর ১৯৭৬ সালে রূপলাল হাউস পরিত্যক্ত সম্পত্তি abandoned Property ঘোষিত হয়। পরবর্তী সময় থেকে এ বাড়িটি পূর্ত মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে আছে।
সবশেষে বলতে হয়, আহসান মঞ্জিলের মতো রূপলাল হাউসও ঢাকার একটি ঐতিহ্য। রূপলাল হাউসের যথাযথ সংরক্ষণ প্রয়োজন। প্রয়োজন মেরামতের। অনাকাক্সিক্ষত স্থাপনাগুলো ভেঙে দিয়ে মূল বাড়িটি পুনরায় মেরামত করলেই ফিরে আসবে রূপলাল হাউসের পুরনো সেই রূপ।
মেহেদী হাসানই-মেইল : [email protected]
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৯ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১২