রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট এমন এক ধরনের উপাদান, যা কংক্রিটের যৌগিক মিশ্রণকে আরও উন্নত করার মাধ্যমে সিমেন্টশিল্পের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে। এতে রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা। তদুপরি এতে তৈরি করা অবকাঠামো একদিকে যেমন মজবুত, শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী হয় অন্যদিকে হয় পরিবেশবান্ধব। যদি রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের ভৌত, যান্ত্রিক এবং স্থায়িত্ব গুণাগুণের সঙ্গে উচ্চমাত্রার কংক্রিটের তুলনা করা হয়, তবে বিশেষত কম্প্রেসিভ ও ফ্লেক্সিরাল লোডের ক্ষেত্রে শক্তিমাত্রায় রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট অধিক কার্যকরী।
হাইপারফরমেন্স কংক্রিট হচ্ছে সিমেন্ট, পানি ও এগ্রিগেইটের মিশ্রণ। এতে খনিজ উপাদানের সঙ্গে অন্যান্য বিশেষ গুণসম্পন্ন রাসায়নিক যৌগ মিশ্রিত থাকায় এ ধরনের কংক্রিটে বিশেষ ধরনের গুণাগুণ বিদ্যমান থাকে। হাইপারফরমেন্স কংক্রিটের উন্নতি সাধনের পাশাপাশি সম্ভব হয়েছে কংক্রিটে অবস্থানরত মাইক্রোস্ট্রাকচার মনিটর করা। হাইপারফরমেন্স কংক্রিটের রয়েছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্প্রেসিভ শক্তি, যা মূলত মাইক্রোস্ট্রাকচারে নিহিত। এটা ধরে রাখতে পারে না একটি নির্দিষ্ট শক্তির স্তরের অমসৃণ এগ্রিগেইটগুলোর লিংক। এতে কংক্রিট দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই কংক্রিটের শক্তি বাড়াতে অমসৃণ এগ্রিগেইটগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। এই নীতির ওপর ভিত্তি করে সম্ভব হয়েছে রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটকে উন্নত পর্যায়ে আনা।

শুরুর কথা
১৯৯০ সালের শুরুর দিকে ফ্রান্সে সাধারণ কংক্রিটকে আরও উন্নত করে তৈরি করা হয়েছিল রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট। ১৯৯৭ সালে পৃথিবীতে প্রথম রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটে নির্মিত হয় কানাডার সেরব্রুক শহরের পেডেসট্রেন সেতু। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নমনীয় সিমেন্টের যৌগ, যাতে রয়েছে সব ধরনের যান্ত্রিক ও ভৌত গুণাগুণ। বিশেষ ধরনের এ কংক্রিটে উন্নতমানের রিফাইন সিলিকা ফিউম ব্যবহার করা হয়, যাতে প্রজোলেনিক গুণাগুণ থাকায় পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট তৈরিতে এর সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চমাত্রার শক্তি অর্জন সম্ভব।
রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট তৈরির ধারণাটি সর্বপ্রথম আসে ফ্রান্সের গবেষক পি-রিচার্ড এবং এম-চেরেজির মাথায়। ফ্রান্সের বউগুস গবেষণাগারে এটির পরীক্ষা-নিরীক্ষাটি করা হয়। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের বাস্তব প্রয়োগ রয়েছে পেডেসট্রেন সেতু তৈরিতে। সেতুটির অবস্থান কানাডার সেরব্রুক শহরে। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট ১৯৯৯ সালে নোভা অ্যাওয়ার্ড পায় কনস্ট্রাকশন ইনোভেশন ফোরাম থেকে। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট নিউক্লিয়ার বর্জ্য পৃথকীকরণের কাজে সফলতা অর্জন করেছে এর চমৎকার অপ্রবেশ্য গুণের জন্য।
রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের উপাদান
রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট মূলত অনেক মসৃণ পাউডার দ্বারা তৈরি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সিমেন্ট, বালু, কোয়ার্টজ পাউডার, সিলিকা ফিউম, স্টিল ফাইবার ও সুপার সিমেন্ট। এই উপাদানসমূহের উপস্থিতি কংক্রিটের কার্যক্ষম ক্ষমতা বাড়ায়। খুব ঘন শুষ্ক পাউডার ব্যবহারে রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের ঘনত্ব বেশি হয়। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের অণুগুলো খুব ভালোভাবে মিশ্রণের ফলে বন্ডিং খুব ভালো হয়, যার জন্য রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটে উচ্চমাত্রার শক্তি ও স্থায়িত্ব বজায় থাকে। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের কম্প্রেসিভ শক্তি হয় ২০০ এমপিএ থেকে ৮০০ এমপিএ পর্যন্ত। ফ্রান্সের রিচার্ড এবং চেরিজি গবেষকদ্বয় রিএকটিভ পাউডার কংক্রিটকে আরও উন্নত করতে, যা অনুসরণ করতেন-
- অমসৃণ এগ্রিগেইট অপসারণে মিশ্রণ প্রক্রিয়াটি সমভাবে মিশ্রিত হতে পারে।
- সিলিকা ফিউমের প্রজোলনিক গুণাগুণকে ব্যবহার করা।
- সুপার প্লাসটিসাইজার ঠিক যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততখানি ব্যবহার করা। পানি ও সিমেন্টের অনুপাত কমিয়ে উন্নতভাবে কাজ করার ক্ষমতা বিদ্যমান রাখা।
- সঠিক গ্রানুলার মিশ্রিত করা, যাতে মিশ্রণটি ঘন হতে পারে।
- চাপের সর্বোত্তম ব্যবহার অর্থাৎ রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট জমে যাওয়ার আগে এবং পরে যাতে চাপের ফলে অণুগুলো একে অপরের সঙ্গে খুব ভালোভাবে সেঁটে থাকতে পারে।
- মাইক্রোস্ট্রাকচার ভালোভাবে হতে পারে এ জন্য পোস্ট সেট হিট ট্রিটমেন্ট করা।
- ছোট আকারের স্টিল ফাইবার যোগ করা, যাতে এর নমনীয়তা উন্নত হয়।

যেসব প্যারামিটার দ্বারা মিশ্রণটিকে যোগ্য করা হয় তা হচ্ছে মিশ্রণটিতে পানি রয়েছে কী পরিমাণ। অর্থাৎ কম পরিমাণ কংক্রিটের জন্য কী পরিমাণ পানির প্রয়োজন। মিশ্রণের ভেতর কতখানি ফাঁকা জায়গা থাকবে সেটা নির্ভর করে কী পরিমাণ পানির প্রয়োজন এবং তাতে বাতাসের উপস্থিতি কতটুকু। পানির প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে কম। মিশ্রণটির ডিজাইন এমনভাবে করা হয়, যাতে সর্বোচ্চ অনুকূলে কী পরিমাণ পানি থাকবে তা আপেক্ষিক ঘনত্ব (do/ds)-এর স্থিতিমাপের ওপর নির্ভরশীল। এখানে do এবং ds-কে যথাক্রমে কংক্রিটের ঘনত্ব এবং মিশ্রণের কমপ্যাক্ট ঘনত্বকে বোঝানো হয়েছে। আপেক্ষিক ঘনত্বের দ্বারা ধারণা দেওয়া হয় মিশ্রণে কংক্রিট প্যাকিংয়ের মাত্রা কতটুকু এবং যার অনুপাতের ফলাফল হয় সর্বোচ্চ ১। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের জন্য মিশ্রণটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যাতে প্যাকিংজাত মোড়কটির ঘনত্বটা থাকে সবচেয়ে বেশি।
রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের মাইক্রোস্ট্রাকচারের কাজটি হিট কিউরিংয়ের মাধ্যমে করা হয়। হিট কিউরিং করা হয় তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ৯০০ সে. তাপমাত্রায়। এটা করা হয় মিশ্রণটি সেটিংয়ের পর যখন কংক্রিটের স্বাভাবিক চাপ থাকে। এতে যদি হাইড্রোটের মাইক্রোস্ট্রাকচার আরও পরিবর্তন করা যায়, তবে প্রজোলেনিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। সেটিং এর আগে উচ্চচাপ প্রয়োগ করা হয়, যাতে অধিক শক্তি অর্জন করা সম্ভব হয়।
উচ্চ শক্তিসম্পন্ন রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট সহজেই ভঙ্গুর। সে জন্য স্টিলের ফাইবার সাধারণত রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটে যোগ করা হয় এটার ভঙ্গুরতা রোধ করার জন্য। সাধারণ স্টিল ফাইবারগুলো ১৩ মি. মিটার দৈর্ঘ্যে এবং ০.১৫ মি. মিটার ব্যাসার্ধের হয়ে থাকে। মিশ্রণে ফাইবারের অনুপাত থাকে ১ : ৫-এর মধ্যে এবং ভলিউম হয় ৩%। সবচেয়ে অনুকূল মাত্রায় থাকে ২% আয়তনের অনুপাতে অথবা ১৫৫ কেজি প্রতিঘনমিটারে।

রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের বিশেষত্ব
রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট সাধারণত দুই ধরনের। একটি রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট ২০০ এমপিএ এবং অপরটি ৮০০ এমপিএ; ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট তৈরি করা হয়। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের উচ্চ ফ্লেক্সিরাল শক্তি মূলত নির্ভর করে এতে ব্যবহৃত স্টিল ফাইবারের ওপর।
রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের সাধারণ কম্প্রেসিভ শক্তি ২০০ এমপিএ। এতে প্রতি ভলিউম কংক্রিটে রয়েছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তি গ্রহণক্ষমতা। এতে আছে অধিক পরিমাণ নমনীয় ক্ষমতাও। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটে যান্ত্রিক গুণাগুণ ছাড়াও অন্যান্য গুণের মধ্যে রয়েছে আলট্রা-ডেনস মাইক্রোস্ট্রাকচার যার জন্য এতে পানি সিক্ত হতে পারে না এবং পরিত্যক্ত পারমাণবিক বর্জ্য ভান্ডারের রাখার জন্য ব্যবহার করা যায়। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের অন্যান্য গুণাগুণের মধ্যে এটির রয়েছে কম স্বচ্ছতা; স্থান অনুযায়ী এটি কম সংকুচিত হয়। মরিচা পড়া রোধ করে। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের মধ্য দিয়ে গ্যাস অথবা তরল পদার্থ প্রবেশ করতে পারে না।
রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের সীমাবদ্ধতা
রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট মিশ্রণের ডিজাইন করতে গতানুগতিক যে কংক্রিট ব্যবহার করা হয়, সেখানে মূলত অপেক্ষাকৃত বেশি মূল্যের উপাদান প্রতিস্থাপন করা হয়। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটে যে মসৃণ বালু ব্যবহার করা হয় সেটি সাধারণ কংক্রিটের ক্ষেত্রে অমসৃণ এগ্রিগেইটের সমান। পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট সেখানে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে মসৃণ এগ্রিগেইট এবং সিলিকা ফিউম হিসেবে। খনিজ উপাদানগুলো সবচেয়ে অনুকূল অবস্থায় ব্যবহার করলে এর খরচ বেড়ে যায়, যা সাধারণত কংক্রিটের তুলনায় ৫ থেকে ১০ গুণ বেশি। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট এমন স্থানে ব্যবহার করা উচিত যেখানে ওজন কমার দরকার এবং সেখানে এ ধরনের কংক্রিটের বিশেষ গুণাগুণকে শতভাগ কাজে লাগানো সম্ভব। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের উচ্চমাত্রার স্থায়িত্ব গুণাগুণ থাকায় অনেক স্থানে স্টিলের পরিবর্তে এটি ব্যবহৃত হয়। এর ভালো উদাহরণ মেরিন ব্যবস্থাপনা।

শেষের আগে
রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট নতুন আবিষ্কৃত প্রযুক্তি, যা কংক্রিট তৈরিতে এনে দিয়েছে নতুনমাত্রা। গতানুগতিক কংক্রিটের তুলনায় যান্ত্রিক ও স্থায়িত্ব গুণাগুণের জন্য এটা অবকাঠামো তৈরিতে সৃষ্টি করেছে নতুন এক অধ্যায়। এমনকি স্টিলের প্রতিস্থাপক হিসেবেও ক্ষেত্রবিশেষে কাজ করছে রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট।
রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের উন্নত হওয়ার কারণ সমপ্রকৃতির গাঠনিক উপাদান এবং এর প্রয়োগিক দিকের জন্য। কেননা এটির কাজ করার ক্ষমতা খুব ভালো, উচ্চমাত্রায় কম্প্যাকশন অর্থাৎ কংক্রিটগুলো খুব ঠাসাঠাসিভাবে থাকে। এতে নমনীয় ও উন্নত মাইক্রোস্ট্রাকচারের জন্য সেটিং খুব ভালো হয়। রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিটের ঘন মাইক্রোস্ট্রাকচারের জন্য রয়েছে ওয়াটারপ্রæফ সুবিধা ও দীর্ঘ স্থায়িত্ব গুণ। এ জন্য রি-অ্যাকটিভ পাউডার কংক্রিট ব্যবহার করা হয় শিল্পকারখানায়। এ ছাড়া এটি একটি ভালো উপাদান হিসেবে আণবিক প্লান্টের বর্জ্য ভান্ডার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
প্রকৌশলী মহিউদ্দীন আহমেদ
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট
প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৩ তম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১৩