মেডিবার্গ ওয়াটার ব্রিজ

বিশ্বের যে কোনো ইঞ্জিনিয়ারের রাতের ঘুম হারাম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট! ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে এই প্রজেক্ট ছিল দুঃস্বপ্নের নামান্তর। কঠিন না সহজ এ রকম কোনো প্রশ্ন মাথায় আসেনি কারও। ইঞ্জিনিয়ারদের মাথায় যে প্রশ্নটা এসেছিল সেটা হলো, সম্ভব না কি একেবারেই অসম্ভব! বলছিলাম, জার্মানির মেডিবার্গ ওয়াটার ব্রিজের কথা। প্রিয় পাঠক ‘ওয়াটার ব্রিজ’ শুনে যেন আবার বিভ্রান্ত হবেন না। পানির উপরে কংক্রিটের তৈরি ব্রিজ, যার উপর দিয়ে গাড়ি-ঘোড়া চলবে, এমনকি রেলগাড়িও চলবে এমন অসংখ্য ব্রিজ দেখেছেন হয়তো। কিন্তু কখনো কি শুনেছেন এমন ব্রিজের কথা, যার উপর দিয়ে আস্ত জাহাজ চলবে, লঞ্চ চলবে! হ্যাঁ তেমনই এক ব্রিজের কথা শোনাব এখন। জার্মানির মেডিবার্গ ওয়াটার ব্রিজের উপর দিয়ে পানির জাহাজই চলে!

কল্পনার রাস টেনে ধরুন, চোখ বন্ধ করে ওয়াটার ব্রিজের কথা চিন্তা করা বন্ধ করুন, আর খুঁতখুঁতে পাঠক যাদের কিনা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তারা আমার সঙ্গে চলুন পুরনো সেই দিনে। 

অনেকটা সময় পেছনে প্রায় ১০০ বছর আগে; সময়কাল ১৯১৯ সাল। জার্মানির রাজধানী বার্লিনের অদূরেই মেডিবার্গ শহর। এখানেই এলবি নদীর দুই পাশের স্থলভাগের সামান্য দূরেই রয়েছে দুটি খাল। এলবি হ্যাভেল খাল ও মিটল্যান্ড খাল। এই দুই খালের মাঝের স্থলভাগ বেশ নিচু হয়ে দু’পাশ থেকে এসে একেবারে মাঝামাঝি অংশে এলবি নদীর দেখা পেয়েছে। এখন যদি এলবি নদীর দুই পাশের স্থলভাগ খনন করে খাল দুটিকে এলবি নদীর দুই পাশ থেকে যুক্ত করে দেওয়া হয় তাহলে জাহাজের জন্য নদীপথের দূরত্ব অনেক কমে আসে। কিন্তু আগেই বলেছি দু’পাশের দুই খালের চাইতে বেশ নিচু মাঝের স্থলভাগ। তাই শুধু খালগুলোকে যুক্ত করে দিলেই চলবে না। 

এ অবস্থায় ইঞ্জিনিয়াররা এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা নিয়ে ফেললেন। সিদ্ধান্ত নিলেন যে এলবি নদীর উপর দিয়ে তৈরি হবে ‘ওয়াটার ব্রিজ’! মানে পরিকল্পনা হলো দুই পাশের দুই খালকে সংযুক্ত করে একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হবে যা কিনা এলবি নদীর উপর দিয়ে যাবে। এর পরই ব্রিজের নকশা করে ফেললেন ইঞ্জিনিয়াররা। সে অনুযায়ী কাজও শুরু হয়ে গেল ১৯৩০ সালের গোড়ার দিকে। কিন্তু এর মাঝেই এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সঙ্গে নিয়ে এলো স্নায়ুযুদ্ধ। পূর্ব জার্মানির আপত্তির মুখে বন্ধ হয়ে গেল এই ব্রিজের নির্মাণ কাজ। কিন্তু এই নৌপথের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়তে লাগল। ব্যস্ত হতে থাকল এলবি নৌপথ। সামান্য কয়েকটা জাহাজের ব্যবহৃত সেই নৌপথই হয়ে উঠল অনেক বেশি গ্রহণীয়। এরই মাঝে দুই জার্মানি আবার এক হয়ে গেল। সংযুক্ত জার্মানি সরকার তখন আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করল এই ব্রিজের কথা। কেননা প্রস্তাবিত এই ব্রিজের পথ উন্মুক্ত না হওয়ায় অতিরিক্ত ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হচ্ছিল ভারী মালবাহী জাহাজ ও বার্জগুলোকে। আবার মাঝে মাঝে এলবি নদীর পানির লেভেল এতই নেমে যেত যে তা দিয়ে বড় বার্জ তো দূরের কথা মালবাহী ছোটখাটো জাহাজের চলাও দুরূহ হয়ে যেত। সে কারণে বার্জের মালামাল অনেকগুলো ছোট ছোট জাহাজে স্থানান্তরিত করে পরিবহন করতে হতো। যা শুধু খরচ সাপেক্ষ ছিল তাই-ই নয়, ছিল অনেক বেশি সময় সাপেক্ষও। তাই দীর্ঘ বিরতির পর প্রায় ৮০ বছর পর জার্মান সরকার আবার নতুন করে সেই দুরূহ পরিকল্পনার কথা চিন্তা করতে থাকল। আর তারই প্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালে আবার শুরু হয়ে গেল মহাযজ্ঞ। আবার একদল ইঞ্জিনিয়ার নিজেদের রাতের ঘুম হারাম করে শুরু করল এই ব্রিজ নির্মাণের কাজ। তাদের প্রতিপক্ষ যে শুধু প্রকৃতিই ছিল তা কিন্তু নয়। বরং পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনও এই ব্রিজ নির্মাণের বিরোধিতা করতে লাগল। ফলে বেশ কয়েকবার বাধাগ্রস্ত হলো এর নির্মাণ কাজ। কিন্তু ইঞ্জিনিয়াররা সকল বাধা অতিক্রম করে ২৪ হাজার টন স্টিল আর ৬৮ হাজার ঘনফুট কংক্রিট দিয়ে গড়ে তুললেন এক ইতিহাস। সময় লাগল ৬ বছর। খরচের অঙ্কটা শুনতে চান? বেশি নয়, মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ইউরো মানে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৫ হাজার তিনশ কোটি টাকা। অবশ্য খরচের অঙ্কটাকে খুব বেশি বড় মনে করছে না জার্মান সরকার। কারণ তাদের বিশ্বাস, এটা আসলে বিনিয়োগ। আর বিনিয়োগটা যে বেশ লাভজনক হয়েছে তা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে। কারণ এই ব্রিজ নির্মাণের আগে যেখানে প্রতিবছর মাত্র চার মিলিয়ন পণ্য পরিবহন করা যেত সেখানে এই নৌপথে এখন প্রায় দ্বিগুণ পণ্য পরিবহন করা যায়।

অবশেষে দীর্ঘ ছয় বছরের কষ্টসাধ্য অভিজ্ঞতার ফসল এলো। এলবি নদী উপর তৈরি হলো বিশ্বের দীর্ঘতম ওয়াটার ব্রিজ। সেই অদ্ভুত ব্রিজ দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে দুনিয়ার মানুষ। তাহলে অর্জন বলতে কি শুধু এটুকুই… না, তা হবে কেন। এই ওয়াটার ব্রিজ তো আসলে প্রমাণ করল ইঞ্জিনিয়ারিং জগতে মানুষের অসাধ্য বলতে আসলে কিছুই নেই। শুধু দরকার বাক্সবন্দি চিন্তা-ভাবনাকে নিজের মতো করে ডানা মেলার সুযোগ করে দেওয়া।

এক নজরে মেডিবার্গ ওয়াটার ব্রিজ (বক্স)

অবস্থান : মেডিবার্গ, জার্মানি

দৈর্ঘ্য : ৯১৮ মিটার

প্রস্থ : ৩৪ মিটার

পানির গভীরতা : ৪.২৫ মিটার

সবচাইতে দীর্ঘ স্প্যান : ১০৬ মিটার

মোট খরচ : ৫০০ মিলিয়ন ইউরো (৫ হাজার তিনশ কোটি টাকা)

সময়কাল : ১৯৯৭-২০০৩।

ফয়সাল হাসান সন্ধীই

মেইল : [email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ২২ তম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top