স্থপতি নাহাস খলিলের মাটির বাড়ি

সাদা-কালো চুল, চোখে চশমা, পরনে ফতুয়া নিতান্তই পরিপাটি মানুষটি। ১৯৫৮ সালে জš§ নেয়া এ মানুষটির নাম নাহাস আহমেদ খলিল। তবে তিনি স্থপতি নাহাস খলিল নামেই পরিচিত। তিনি ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক পাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে ১৯৮২ সালেই চার বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন নির্মাণবিষয়ক কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান আর্ক আর্কিটেকচারাল কনসালট্যান্টস। পরবর্তী সময়ে বাকি তিন বন্ধু নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও নাহাস খলিল এখনো এ প্রতিষ্ঠানটি নিয়েই ব্যস্ত আছেন। প্রতিষ্ঠানটি ঘিরেই তার ধ্যান-জ্ঞান। কাজ করছেন আবাসন আর নির্মাণ বিষয়ে। নির্মাণশিল্পের সাথে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি যোগ করে তৈরি করে চলেছেন অসংখ্য স্থাপনা। সাভারের পরিবেশবান্ধব মাটির বাড়ি, বাগানবাড়ি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ), ইউনাইটেড হাউজ, সামিট গ্রæপের কর্ণধার মুহম্মদ আজিজ খানের বাড়ি, ধানমন্ডির বেল টাওয়ার, ঢাকা আর্ট সেন্টার, শমসেরনগর হাসাপাতালসহ নান্দনিক কিছু  স্থাপত্য কর্ম তাঁরই অনবদ্য সৃষ্টি। স্থপতি নাহাস খলিল বর্তমানে আর্ক আর্কিটেকচারাল কনসালট্যান্টসের প্রিন্সিপাল কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন।

স্থাপত্যশিল্পে অবদানের জন্য ‘হোলসিম গ্রিন বুইল্ট অ্যাওয়ার্ডসহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। আধুনিকতার সাথে পরিবেশকে খাপ খাওয়াতে না পেরে আমরা যখন অনেকটাই ক্লান্ত তখন এ মানুষটি হেটে যাচ্ছেন উল্টো পথে। নির্মাণের সাথে পরিবেশ ভাবনাই নাহাস খলিলের অকৃত্রিম ভাবনা।

মাটির বাড়ি : পরিবেশ নিয়ে ভাবনা

দিন দিন এগিয়ে চলেছে বিশ্ব। সেই সাথে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের নির্মাণশিল্পও। প্রযুক্তি আর শিল্পের পটপরিবর্তনের সাথে সাথে প্রতিনিয়তই পরিবর্তন ঘটছে এ শিল্পের। এক সময় মানুষ যখন পাহাড়ের গুহায় বা গাছের ডালে আশ্রয় নিত, সে মানুষ এখন ইট-কাঠের বহুতল ভবনের বাসিন্দা। কিন্তু এ পরিবর্তনে হাঁপিয়ে উঠেছে পৃথিবী। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর বিশ্ববাসীর চাওয়া এখন এমনই। পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নির্র্মাণশিল্পেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। তবে আবার চেষ্টা চলছে সেই শিকড়ে ফিরে যাওয়ার। এক সময়ে এ দেশের মানুষেরা মোটা মোটা দেয়ালের মাটির বাড়িতে বসবাস করত। এখনো দিনাজপুর বা উত্তরাঞ্চলের কিছু কিছু জায়গায় এ ধরনের বাড়ির দেখা মিলবে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছে এ ধরনের বাড়ি। মানুষ একটু বিত্তবান হলেই প্রথমে টিনের বাড়ি পরে সম্ভব হলে ইটের দালান গড়ে তুলছে। এ পরিবর্তনে আমরা নিজেদের আধুনিক বলে দাবি করছি ঠিকই; কিন্তু বিপরীতে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ।  

এত কিছুর মধ্যেও বাংলাদেশে কেউ কেউ পরিবেশকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তাদেরই একজন স্থপতি নাহাস খলিল। তিনি দীর্ঘ ৩০ বছর নির্মাণশিল্পে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর কাজ করে চলেছেন। সাভারের মাটির বাড়ি নাহাস খলিলের সেরকম কয়েকটি উদ্যোগেরই একটি। সাভারের বেক্সিমকো শিল্প পার্কের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে মাটির এ দোতলা বাড়িটি। একটি একক পরিবার থাকার উপযোগী মাটির এ বাড়িটি মানবিকতার জন্য স্থাপত্য’ শিরোনামে হোলসিম গ্রিন বুইল্ট অ্যাওয়ার্ড ২০১০ পুরস্কার জিতে নেয়।  

নির্মাণ উদ্দেশ্য

সাভারের দোতলা এ মাটির বাড়িটি সম্পর্কে জানালেন এর স্থপতি নাহাস খলিল। দোতলা এ মাটির বাড়িটিকে একটি বাগানবাড়ি বলা যায়। ছুটি কিংবা অবসরে একান্তে পরিবেশের মাঝে কিছু সময় কাটাতে এ বাড়িটি তৈরি করা হয়েছে। এএসএমও সোবহানের অনুরোধে তার জন্য এ বাড়িটি তৈরিতে কনসালট্যান্সি করেছেন স্থপতি নাহাস খলিল। তবে যে কারনেই বানানো হোক না কেন বাড়িটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারন মানুষের মাঝে পরিবেশ ভাবনাটা ছড়িয়ে দেয়া, আর মাটির বাড়িকে জনপ্রিয় করা। তাই নির্মাণের সময় পরিবেশ ভাবনাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে সবার আগে। প্রায় তিন বছর নির্মাণ কাজ চলার পর ২০১০ সালের ০৮ জানুয়ারি বাড়িটি ব্যবহার উপযোগী হয়ে যাত্রা শুরু করে।

বাড়িটি নিয়ে কিছু কথা

মাটির দোতলা বাড়িটি তৈরিতে মূল ভাবনা কাজ করেছে স্থানীয় উপকরণের সাথে আধুনিক কিছু সরঞ্জামাদির ব্যবহার। যাতে মাটির বাড়িটি কিছুটা হলেও প্রচলিত মাটির বাড়ির চেয়ে আধুনিক ও টেকসই হয়। এ বিষয়ে নাহাস খলিল বলেন, দেশের প্রচলিত মাটির বাড়িগুলো সাধারণত অপেক্ষাকৃত কম আয়ের মানুষজনই ব্যবহার করে থাকে। সাধারণত এ বাড়িগুলোতে জানালা খুব ছোট-ছোট থাকে, দেয়াল অনেক মোটা এবং ভেতরে আলো-বাতাস নেই বললেই চলে। এ কারণে বেশি আয়ের মানুষদের কাছে এগুলো ‘গরিবের বাড়ি’ নামেই পরিচিত। তাই সমাজে বাড়িগুলো তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। এ বাড়িটি নির্মাণে আমরা চেষ্টা করেছি প্রচলিত মাটির বাড়ির সাথে কিছু প্রযুক্তির যোগ করাতে যাতে বাড়িটি আধুনিক রূপ পায়। আর আধুনিক করা গেলে বেশি আয়ের মানুষজন এ ধরনের বাড়ি নির্মাণে আগ্রহী হতে পারে। তাই এটি নির্মাণে স্থানীয় কাঁচামাল আর উপকরণের সাথে কিছু আধুনিক উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এগুলো সহজলভ্য, দামও খুব বেশি নয়।’ দোতলা মাটির বাড়ির নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি আরো জানান, আমাদের দেশে টিনের বাড়ি মধ্যবিত্ত সমাজে অনেক জনপ্রিয়। কিন্তু টিনের বাড়ির চেয়ে মাটির বাড়ি অধিক স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব। মাটির বাড়ি অনেক বেশি আর্দ্রতা ধরে রাখতে সক্ষম। এ কারণে মাটির বাড়িতে শীতের সময় গরম থাকে আর গরমের সময় ঠান্ডা। তাই মাটির বাড়ি অনেক আরামদায়ক। প্রচলিত মাটির বাড়িগুলোতে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের কারণে অনেকেই এ ধরনের মাটির বাড়ি তৈরিতে আগ্রহী হয় না। তাই আমরা বাড়িটি নির্মাণের সময় এ বিষয়টিকে মাথায় রেখেছি। এটি নির্মাণের সময় রক্ষণাবেক্ষণ খরচ যাতে কম হয় সে চেষ্টা করা হয়েছে। তাই প্রচলিত মাটির বাড়ির মেঝে, দেয়াল ও জানালায় পরিবর্তন এনেছি। আর এ সবগুলো কাজই করানো হয়েছে দিনাজপুরের মাটির ঘর বানানো মিস্ত্রিদের দিয়ে। যাতে তারা পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে এ পদ্ধতিটি অনুসরণ করতে পারেন।

কিছু তথ্য

দোতলা এ বাড়িটিতে সাভারের স্থানীয় মাটি, বাঁশ, কাঠসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহজলভ্যতা ও দামের দিক বিবেচনা করা হয়েছে। তবে চালে ব্যবহারের জন্য থাইল্যান্ডের প্রক্রিয়াজাত এক ধরনের শিট ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো সহজলভ্য ও পরিবেশবান্ধব।

প্রচলিত মাটির বাড়ির ভেতরের দিকে আলো খুব একটা নেই বললেই চলে। কিন্তু দোতলা এ বাড়িটিতে উপরের দিকে বাঁশের কাঠামো দিয়ে প্রচুর খোলামেলা জায়গা তৈরি করা হয়েছে। এ কারণে এ বাড়িটি প্রচলিত মাটির বাড়ির মত স্যাঁতসেতে বা অন্ধকার নয়। বরং এর ভেতরে প্রচুর আলো-বাতাসের ব্যবস্থা রয়েছে।

নাহাস খলিল নির্মিত এ বাড়িটির জানালাগুলো প্রচলিত মাটির বাড়ির মতো নিচু ও ছোট নয়। এ বাড়ির জানালাগুলো কাঠের লিন্টারের সাহায্যে অনেক বড় করা হয়েছে। এ কারণে বাড়িটিতে প্রচুর আলো-বাতাসের ব্যবস্থা রয়েছে। আর এ কারণে জানালাগুলো খুব একটা নিচু হয়নি।

প্রচলিত মাটির বাড়ির সাথে এ বাড়ির আরেকটি বড় পার্থক্য হলো দেয়াল। প্রচলিত মাটির বাড়ির দেয়ালগুলো বৃষ্টির পানির প্রবাহের কারণে টেকসই হয় না। এ কারণে চালগুলোকে অনেক নিচ পর্যন্ত দিতে হয়। কিন্তু দোতলা এ বাড়িটির ক্ষেত্রে এটি পরিবর্তন করা হয়েছে। দেয়ালের যে জায়গায় পানির প্রবাহ নামে সেখানে কাঠ দিয়ে মাটির তিনটি স্তর তৈরি করে পানির প্রবাহকে বাধা দেয়া হয়েছে। এতে বৃষ্টির পানি নামার সময় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দেয়ালের ক্ষতি করতে পারবে না। আর মেঝের নিচের দিকে মূল দেয়ালের বাইরের অংশে স্থানীয় কুমারপল্লীর ভাঙাচুড়া (হাঁড়ি-পাতিলের ভাঙা টুকরা) দিয়ে দেয়ালকে শক্তিশালী করা হয়েছে। এত পানি গড়িয়ে পড়ার পর দেয়ালে ছিটকা আসলেও দেয়ালের খুব ক্ষতি হবে না।

বাড়ির দেয়াল তৈরিতে স্থানীয় মাটিকে খড়ের সাথে মিশিয়ে সাতদিন পরপর দেয়ালের এক একটি স্তর তৈরি করা হয়েছে। সাতদির পর আবার আরেক স্তর। এভাবে পুরো দেয়ালর কাজ শেষ করা হয়েছে। এ কারণে এ বাড়ির দেয়াল প্রচলিত বাড়ির চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়েছে।

মাটির বাড়ির মেঝে মাটির হওয়ায় ঘরে ইঁদুরের প্রচুর উৎপাত থাকে। এ কারণে বাড়িটির মেঝেতে খোয়া ও সিমেন্টের সাথে বালির মিশ্রণ দিয়ে দরমুজ দিয়ে পোড়ানো হয়েছে। ফলে মেঝেও প্রচলিত বাড়ির থেকে আধুনিক হয়েছে এবং ইঁদুরও সহজে উৎপাত করতে পারবে না।

দোতলা এ মাটির বাড়ির খুঁটি বা কাঠামোতে বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে প্রচলিত পদ্ধতিতে বাঁশ পুঁতে না দিয়ে সিমেন্টের কাঠামোর ওপর নাট-বল্টু দিয়ে বসানো হয়েছে। এতে বাঁশের স্থায়িত্ব বেশি হবে।

সর্বোপরি পরিবেশকে ঠিক রেখে বাড়িটিকে যতটা আধুনিক করা যায় সে চেষ্টাই করা হয়েছে। 

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৬ তম সংখ্যা, জুন ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top