ভাষা আন্দোলন জাদুঘর

মাতৃভাষার জন্য কোনো জাতি জীবন দিতে পারে ১৯৫২ সালের আগে তা কেউ হয়তো ভাবতেও পারেনি। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীনতা, ভূখন্ড, পানি, মৌলিক অধিকার ইত্যাদি নিয়ে দেশে দেশে হয়েছে অনেক যুদ্ধ, হয়েছে আন্দোলন। আমরাই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছি, ঝরিয়েছি বুকের তাজা রক্ত। রফিক, সালাম, বরকত, সফিকসহ নাম না জানা অনেক ভাষাসৈনিক তাদের জীবন দিয়ে ফিরিয়ে এনেছেন বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার। আজ বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষা সুপ্রতিষ্ঠিত। এই গৌরবময় আন্দোলনকে উজ্জীবিত রাখতে ও নতুন প্রজন্মের কাছে তা তুলে ধরতে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘর।

একটি জাতিকে সাংস্কৃতিকভাবে শিক্ষিত করে তুলতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিজ দেশের সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য এবং ইতিহাস সম্পর্কে জানার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে নিজ দেশের সাংস্কৃতিক বিকাশ ও গৌরবময় ইতিহাস সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতা থেকেই স্থপতি সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশল নিজের ভূমিকা রাখতে থিসিস প্রজেক্ট হিসেবে বেছে নেন এ দেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণে জাদুঘর স্থাপনসহ কতিপয় প্রকল্পকে।

প্রকল্পটি ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয় নিয়েই করা হয়েছে, যেখানে থাকবে ইতিহাস সংরক্ষণ, ঐতিহাসিক স্থানগুলো চিহ্নিতকরণ, একটি ভাষা আন্দোলন জাদুঘর এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুশীলনের জন্য একটি প্লাটফর্ম প্রদান। থিসিসের শুরুতেই ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ইতিহাস সংগ্রহ ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয় যে, ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক স্থানগুলোকে চিহ্নিত করে একটি ঐতিহাসিক এলাকা (যরংঃড়ৎরপধষ পড়ৎৎরফড়ৎhistorical corridor) তৈরি করা সম্ভব। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য তিনি সর্বপ্রথম একটি জায়গা নির্ধারণ করেন। আর সেই জায়গাটি হচ্ছে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। তিনি এমনভাবে ভাষা আন্দোলন জাদুঘরের ডিজাইনটা করেন যা হবে শহীদ মিনারের বিপরীত দিকে এবং পাথেয়টা/পথটা এমনভাবে তৈরি যেটা আশপাশের সব রাস্তার একটা সংযোগ তৈরি করবে। তিনি বিল্ডিংটির ডিজাইন এমনভাবে করেন যেটার রাস্তা এবং ভূমির সঙ্গে থাকবে আন্তঃসম্পর্ক। বিল্ডিংটির উচ্চতা অবশ্যই শহীদ মিনার থেকে বেশি হবে না ।

দোয়েল চত্ব¡র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বাংলা একাডেমী, শহীদ মিনার চত্ব¡র ও পলাশী পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এই এলাকা। এই স্থানগুলো ভাষা আন্দোলনের নীরব সাক্ষী। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই স্থানগুলোকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয় না। এই ঐতিহাসিক স্থানগুলোকে তাদের ঐতিহাসিক মর্যাদা দেওয়ার লক্ষ্যে একটি আরবান রিডেভেপমেন্টের প্রস্তাব থাকে প্রকল্পটিতে। যার মাধ্যমে জানা যাবে ঐতিহাসিক আমতলার অবস্থান, প্রাক্তন কলাভবনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, তৎকালীন পার্লামেন্ট ভবন (বর্তমানে জগন্নাথ হলের ছাত্রাবাসের অংশ) ও তৎকালীন গভর্নরের বাসভবন (বর্তমানে বাংলা একাডেমী)। ঢাকা মেডিকেল কলেজের তৎকালীন ছাত্রাবাস যেখনে পুলিশের সশস্ত্র আক্রমণে নিহত হয় রফিক, জব্বার, বরকতসহ আরো আনেক ভাষাসৈনিক। ঐতিহাসিক স্থানের প্রত্যেকটি স্থাপত্যে বর্ণিত থাকবে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো। যার মাধ্যমে দর্শনার্থীদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে জাদুঘরের বদ্ধ উপকরণ হিসেবে রাখতে চাননি স্থপতি, বরং তার ডিজাইনকৃত জাদুঘরটি এমন ছিল যা ঐতিহাসিক এলাকার একটি অংশ এবং এর সব ঐতিহাসিক স্থানই আসলে জাদুঘরের প্রদর্শনী (display), যা জাদুঘর ডিজাইনের প্রচলিত ধারণাকে বদলে দেওয়ার এক সৃজনশীল প্রচেষ্টা। মিউজিয়াম বিল্ডিংটি ডিজাইন করার ক্ষেত্রে স্থপতি বিল্ডিং স্পেস এবং ল্যান্ডস্কেপের ধারণাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে সমগ্র বিল্ডিংটি ল্যান্ডস্কেপের একটি অংশ এবং এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করা দুরূহ। মিউজিয়ামের সাইড হিসেবে স্থপতি ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সংলগ্ন স্থানটিকে বেছে নেন এবং অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিল্ডিংটি ডিজাইন করেন যেন তা কোনো অবস্থাতেই শহীদ মিনারের ভাবগাম্ভীর্যকে নষ্ট না করে। এ কারণে বিল্ডিংয়ের বহির্ভাগ দেখে মনে হয় তা যেন শহীদ মিনার চত্ব¡রের বর্ধিত ল্যান্ডস্কেপ। মিউজিয়াম বিল্ডিংটি তার মাঝ দিয়ে শহীদ মিনারে যাওয়ার পথ তৈরির মাধ্যমে একটি নান্দনিক আবহ তৈরি করবে যা শহীদ মিনারের মনুমেন্টালিটিকে আরও বর্ধিত করবে। এই ভবনটির কোনো সম্মুখ বা পশ্চাৎ নেই এবং যে কোনো দিক থেকেই মিউজিয়ামের লবিতে এসে পৌঁছানো যায়। সবুজ ঘাসের ছাদবিশিষ্ট গ্রীনরুফ এই স্থাপত্যটিকে ল্যান্ডস্কেপের সাথে মিশে যেতে সাহায্য করে এবং পথচারী এবং দর্শনার্থীদের জন্য একটি প্লাজা হিসেবে কাজ করে যা শহীদ মিনারের স্থাপনের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে তোলে। স্থপতি মিউজিয়ামের ডিসপ্লেগুলোতে ল্যান্ডস্কেপের অংশ হিসেবে চিন্তা করেন, তাই গ্রীনরুফের মাঝে কিছু কাচের স্তম্ভ দেখা যায়; যার গায়ে লেখা থাকবে ভাষা আন্দোলনের তথ্য। আবারো এই কাচের স্তম্ভগুলোই মিউজিয়ামের ইন্টেরিয়রের লাইট ওয়াল বা সূর্যের আলোর উৎস হিসেবে কাজ করে। মিউজিয়ামের ছাদটিকে এমনভাবে বাঁকানো হয়েছে যে দর্শনার্থীরা সহজেই হেঁটে উঠে যেতে পারে, বসতে পারে কিন্তু কেউ চাইলেও শহীদ মিনারের দিকে পেছন ফিরে বসতে পারবে না।

মিউজিয়ামের ইন্টেরিয়র লবিটা অবস্থিত একটি ওয়াটারপুলের নিচে, যার ছাদ হবে কাচের। সূর্যের আলো ওয়াটারপুলের পানির ভেতর দিয়ে লবিতে আসবে আর তা লবির দেয়ালে আর মেঝেতে এক অপরূপ আলো-ছায়ার খেলা সৃষ্টি করবে। জাদুঘরের দেয়াল হিসেবে ব্যবহার করা হবে কাচের গ্লাস ও পানির মধ্যে থাকবে কিছু বাংলা বর্ণমালা। এর ফলে পানিতে পড়া সূর্যের আলো প্রবেশ করবে জাদুঘরের ভেতরে। যেখানে দেখা যাবে পানিতে পড়া আলো-ছায়ার খেলা এবং দেখা যাবে পানিতে ভাসমান অ, আ, ই ইত্যাদি অক্ষর। আবার ওই ওয়াটারপুলের পানিতে পড়বে শহীদ মিনারের প্রতিবিম্ব। এখানে রাতে লক্ষ করা যাবে ভিন্ন রকমের সৌন্দর্য ।

এই প্রকল্পটিকে বাস্তবায়নে সাহায্য করার জন্য তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন কয়েকজন শিক্ষকের প্রতি। তারা হলেন প্রফেসর ড. শহীদুল আমিন, প্রফেসর ড. খন্দকার সাব্বির আহাম্মেদ, ড. মুহাম্মদ জাকিউল ইসলাম, এম ডি রুহুল আমিন, এম ডি মহাতাজ হোসেন এবং যাদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞ তারা হলেন প্রফেসর ড. শরীফ উদ্দীন আহাম্মেদ ও মাহামুদুল আনোয়ার রিয়াদ ।

একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি বাঙালি জাতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিভাবে প্রভাতফেরিকে আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ করা যায় সেই প্রচেষ্টাও রয়েছে প্রকল্পটিতে। দূর থেকে শহীদ মিনারকে দেখা যাচ্ছে; কুয়াশা ঢাকা ভোরে রাস্তার দু’পাশে সারি সারি পলাশ ফুলের গাছ; রক্তিম পলাশ ফুলের বর্ণচ্ছটা শহীদদের রক্তের প্রতিচ্ছবি; পলাশ ফুলের লাল পাপড়ি বিছানো গালিচা যেন সম্মোহন করে নিয়ে যাবে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। এমনই একটি পথ কল্পনা করেছেন স্থপতি সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশল, যা সত্যিকার অর্থে স্থাপত্যের ভাষায় ভাষাসৈনিকদের উদ্দেশে লেখা এক অনবদ্য কবিতা ।

স্থপতি সৈয়দ আবু সুফিয়ান কুশল

তরুণ এ স্থপতির জন্ম ঠাকুরগাঁও জেলায়। বাবা সৈয়দ সাইফুর রহমান একজন চিত্রশিল্পী এবং মা উম্মে কুলসুম আকতার একজন সরকারি চাকরিজীবী। ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছে ছবি আঁকার হাতে খড়ি। ২০০১ সালে ঢাকার গভ. ল্যাবরেটরি হাই স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০০৩ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এর পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ থেকে ২০১০ সালে প্রথম স্থান অর্জনসহ বি. আর্ক ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত অছেন। এ ছাড়াও তিনি স্থপতি হিসেবে বিআরটিসির বিভিন্ন প্রজেক্টের সাথে সম্পৃক্ত । 

তানজিনা

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৮ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top