ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেষ্টা ও প্রয়াসই এনে দেবে সফলতা

গ্রীষ্মের দুপুর, সূর্যটা ঠিক মধ্য গগনে। তাপমাত্রা আনুমানিক ৪০-৪২সেলসিয়াস। বাস থেকে নামতেই যেন আগুনের হলকা এসে লাগল গায়ে। কালক্ষেপণ না করে কোনোমতে একটি রিকশা ডেকে দ্রুত চড়ে বসলাম। গন্তব্য নিউ মালিক স্টোর। বন্ধনের নিয়মিত আয়োজন সফল যারা কেমন তারা’ পর্বের সফল ব্যবসায়ীর খোঁজে এবার হাজির হয়েছিলাম চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরে। 

শহরটির অদূরেই বয়ে চলেছে মাথাভাঙ্গা নদী। ঢাকা থেকে এসে এ শহরটিকে বেশ ফাঁকা ফাঁকাই লাগছিল। হয়তো বা অতিরিক্ত গরমের কারণেই শহরে লোক চলাচল ছিল কম। নিউ মালিক স্টোরে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরই হাজির হলেন আকিজ সিমেন্টের আঞ্চলিক কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম। কিছুক্ষণ পরই এলেন দোকানটির স্বত্বাধিকারী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শাহরিন হক মালিক। মূল সড়কের পাশেই তার দোকান। কথা হলো তার সাথে। ব্যবসা ও জীবনের নানা দিক সম্পর্কে জানতে চাইলাম। জানতে পারলাম একজন সফল ও বহুমুখী ব্যবসায়ীর জীবন গাথার কথামালা।

জন্ম ১৯৭২ সালের ২ ফেব্রæয়ারি চুয়াডাঙ্গা জেলার রেলপাড়ায়। বাবা মৃত এহসানুল হক মালিক ও মা শাহরিজান খাতুন। ১৯৮৭ সালে সরকারি ভিজি হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৮৯ সালে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে একই কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন। এর পরই জড়িয়ে যান ব্যবসাতে। তার বাবা ছিলেন চুয়াডাঙ্গা শহরের নামকরা ব্যবসায়ী। শুধু তাই নয়, তার ভাইও ছিলেন ব্যবসায়ী। এক কথায় বলা যায়, ব্যবসায়ী পরিবার। কলেজ জীবন থেকেই তিনি ভাইয়ের ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। কিন্তু তার ভাইয়ের অকালমৃত্যুর পর তিনিই ব্যবসার হাল ধরেন। তবে একা নন, তার অন্য দুই ভাইÑ মকসুদুল হক মালিক ও মইনুল ইসলাম মালিককে সাথে নিয়েই ব্যবসা কার্য পরিচালনা করেন। তিনি মূলত রড, সিমেন্ট ইত্যাদি নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসায়ী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি সুনামের সাথে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। সব সময় চেষ্টা করেন গুণগতমানসম্পন্ন পণ্য বিক্রি করতে। রডের ব্যবসার ক্ষেত্রে সব সময় চেষ্টা করেন সঠিক ওজনের মাল দিতে। কারণ এটা বেশ ঝামেলার ব্যবসা। তার মতে, রডের ব্যবসায় প্রায় ৯০% ব্যবসায়ী কোনো না কোনোভাবে ওজনে কম দেয়। কিন্তু সঠিক ওজনের নিশ্চয়তা দিতেই তার দোকানে ডিজিটাল মেশিন (নিক্তি) ব্যবহার করা হয়। আর এমন স্বচ্ছতা ও চমৎকার ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য কোম্পানি ও ব্যাংক থেকে সব সময় ভালো সহায়তা পান।

বর্তমানে তিনি চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্সের যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্বরত। গত ৭ বছর যাবত সংগঠনটির নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোটে বিজয়ী। ব্যবসায়ের পাশাপাশি দেশের প্রতিও তিনি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। ২০০৯-১০ অর্থবছরে চুয়াডাঙ্গা জেলার অন্যতম সেরা করদাতা মনোনীত হন এবং তার স্বীকৃতিস্বরূপ চুয়াডাঙ্গা জেলা চেম্বার অব কমার্স থেকে সম্মানসূচক অ্যাওয়ার্ডও লাভ করেন। গত ৪ বছর ধরে তিনি আকিজ সিমেন্ট কোম্পানির সর্বোচ্চ সিমেন্ট বিক্রেতা হিসেবে স্বীকৃত। তবে এ ব্যবসাতেই সীমাবদ্ধ নয় তার ব্যবসার পরিসর। ধান, চাল, পাট ইত্যাদি ব্যবসাও রয়েছে তাদের। এ ছাড়াও বিভিন্ন ফসলের বীজ সরবরাহ ব্যবসায়ের সাথেও তিনি জড়িত। ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি ফসলের বীজ প্রতিবছর সরকারি পর্যায়ে সরবরাহ করে থাকেন। পরিবহন (ট্রাক) ব্যবসাতেও রয়েছে তার বেশ ভালো দখল। এটি তাদের পৈতৃক ব্যবসা। চুয়াডাঙ্গা শহরের একটি আবাসিক হোটেলের মালিক তিনি। তবে এত কিছু ছাপিয়ে ঠিকাদার হিসেবেও রয়েছে তার আরেক পরিচিতি। ছোট বড় অনেক অবকাঠামো নির্মাণের কাজ তিনি করেছেন। বর্তমানে তার ঠিকাদারিত্বে একটি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের কাজ চলছে।

দেশের অন্যান্য স্থানের মতো চুয়াডাঙ্গায়ও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগছে। ব্যবসার এখনকার যে পরিবেশ আগে এ রকম ছিল না। আগের থেকে প্রায় ১০ গুণ বেশি ব্যবসায়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া মানুষ এখন খারাপ জিনিস চায় না। আকিজ সিমেন্ট কোম্পানির সিমেন্টের গুণগতমানের কারণে ব্যবসার প্রসার ও মুনাফা দুটোই ভালো। তবে এত সাফল্যের পরও মোকাবেলা করতে হয়েছে অনেক সমস্যা। এলাকাটিতে একসময় আন্ডারগ্রাউন্ড বাহিনীর বেশ দাপট ছিল। ব্যবসা পরিচালনার স্বার্থে নীরবে তাদের লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। এখন অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।

পারিবারিক ছবি তুলতে যাই তার বাসায়। বাসায় ঢুকতেই মন ভরে গেল অন্যরকম অনুভ‚তিতে। প্রধান ফটক থেকে শুরু করে পুরো ঘর সুন্দরভাবে সাজানো টবে লাগানো নানা রকম গাছ, টেরাকোটা, মাটি ও কাচের শোপিস, ওয়াল ম্যাট, কুশন ইত্যাদিতে। কৃতিত্বটা অবশ্য শাহরিন সাহেব তার স্ত্রীকেই দিলেন। বৈবাহিক জীবনের প্রায় ১৩-১৪ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি দুই সন্তানের জনক। বড় ছেলে কায়কোবাদ হক মালিক ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে এবং ছোট ছেলে তানজিদ হক মালিক ৩য় শ্রেণীতে পড়ে। তবে তার আরও দুটি সন্তান আছে। প্রয়াত ভাইয়ের দুই মেয়েকে নিজের সন্তান স্নেহেই প্রতিপালন করছেন তিনি।

ফুটবল খেলা তার খুব পছন্দ। ছেলেবেলায় খেলেছেনও প্রচুর। পাড়াভিত্তিক ক্লাবগুলোতে খেলতেন। স্কুলে কেরামও খেলতেন। সেখানে প্রতিযোগিতাতে একবার রানার্সআপও হন। ঘুরে বেড়ানো তার খুব পছন্দ। তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথেও জড়িত। নাটার নামক একটি বিদেশী এনজিওর একজন সক্রিয় সদস্য। এ ছাড়াও মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ক্লাবে অনুদান প্রদান করেন। গরিব ও অসহায়দের জন্য প্রতিবছর যাকাত দেন। প্রায় ১৫০ জন কর্মচারী তাদের ব্যবসায়ের সাথে সম্পৃক্ত এবং নির্ভরশীল।

ব্যবসায়িক সফলতা লাভে করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিশ্রম করতে হবে এবং কাস্টমারের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। ছোট থেকেই চেষ্টা করতে হবে। হয়তো বা মূলধন থাকবে না, তবুও তা তৈরি করতে হবে। ব্যবসায় বাকি দিকটায় বিশেষ নজর দিতে হবে। যদি বাকি দিতে হয় তবে তা ঠিক মতো আদায় করে নিতে হবে। এ ছাড়াও সঠিক ওজন ও গুণগত মানসম্মত পণ্য বিক্রির মতন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।

সবশেষে তিনি জানালেন, নিজেকে একজন প্রকৃত ব্যবসায়ী হিসেবে দেখতে চান। নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসাটার আরও প্রসার ঘটাতে চান। নিজেকে বড় কোম্পানির ডিলার হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতে চান। এখন সন্তানরাই তার ভবিষ্যৎ। তারা যেন মানুষের মতো মানুষ হয় এটাই তার এখনকার কামনা।

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৭ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top