ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। প্রতিবছর দেশটি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগÑ যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, এমনকি ভ‚মিকম্পের দ্বারা আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড় প্রধানত উপক‚লীয় অঞ্চলে আঘাত হানে এবং প্রচুর প্রাণ ও সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড়কে বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু এটি মোকাবেলায় সঠিক প্রস্তুতি এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমিয়ে আনতে পারে। প্রাকৃতিক প্রতিক‚লতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আশ্রয়স্থল নির্মাণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই সভ্যতার আদিকাল থেকে মানবজাতি বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করেছে, যা তাদের প্রকৃতির বিরূপ ও রুদ্রমূর্তি থেকে রক্ষা করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি হয়ে আসছে, যা বিভিন্ন দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত যেসব আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে তা দুর্যোগ মোকাবেলায় যথেষ্ট নয়। তাই সময়ের ধারাবাহিকতায় নতুন নতুন প্রকৌশল ও স্থাপত্য চিন্তায় এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর ভবনের আকার-আকৃতির পরিবর্তন প্রয়োজন। ভবনের আকৃতি ও গতানুগতিক আয়তক্ষেত্র এবং একটিমাত্র সিঁড়ি সংবলিত যা প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধদের জন্য ব্যবহার কষ্টসাধ্য।
নতুন ভাবনায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের ডিজাইন এবং ধারণা
ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের অন্যতম ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নিকট অতীতেই অনেকগুলো প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় এ দেশে হয়েছে। এই ঝড়ের কবল থেকে উপক‚লীয় অঞ্চলের মানুষের জানমাল রক্ষার্থে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়। এই কেন্দ্রগুলো ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা চলাকালে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বছরের অন্যান্য সময় এর যথাযথ ব্যবহার অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
টেবিল-১, বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়
গতানুগতিক আশ্রয়কেন্দ্রগুলো শুধু একটি দ্বিতল বা বহুতল আরসিসি ডিজাইনের ভবন বা নিচতলা সম্পূর্ণ খালি থাকে এবং যা উন্মুক্ত অবস্থায় বিদ্যমান, অধিকাংশ সময় আশ্রয়কেন্দ্রের গমনপথটি সুপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয় না। শুধু ঘূর্ণিঝড় থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য এগুলো তৈরি। কিন্তু বেশির ভাগ উপক‚লীয় অঞ্চল গ্রাম হওয়ায় এখানকার জনগণের অন্যতম জীবিকা কৃষি এবং পশুপালন। প্রায় সব পরিবারই কিছু না কিছু গবাদিপশু পালন করে। পরিবারগুলো ঝড়ের সময় পশুদের রেখে সাধারণত আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চায় না। কিন্তু বর্তমান আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পশুদের আশ্রয় দেওয়ার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য ভবনটির আকৃতি তথা Form এমন হওয়া উচিত, যা ঘূর্ণিঝড় চলাকালে বাতাস ও পানির গতিকে প্রতিহত করতে পারে। সেদিক দিয়ে বর্তুলকায় (Circular) আকৃতির ভবনই সবচেয়ে বেশি বাতাস ও পানির গতিকে প্রতিহত করবে। কারণ সাধারণত বাংলাদেশে দক্ষিণ দিক থেকে বায়ু প্রবাহ হয়ে থাকলেও ঘূর্ণিঝড়ের সময় সব দিক থেকে বায়ু প্রবাহ হয় এবং পানির স্রোতও একইভাবে সবদিক থেকে প্রবাহিত হয়। তাই বর্তুলকায় ভ‚মিতে নিরাপদ জায়গা তৈরি করতে হবে, যা দুর্যোগকালে গবাদিপশুর আশ্রয় স্থান হবে আর অন্যান্য সময়ে খেলার মাঠসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হতে পারবে। মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রটি গতানুগতিক আয়তক্ষেত্রের আকৃতির হতে পারে, যা সাধারণ সময়ে বিদ্যালয় বা অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হবে।
আলাদা পরিকল্পনায় বিবেচ্য বিষয়সমূহ
ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ডিজাইনের ক্ষেত্রে প্রথমত যে দিকটা সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হয় তা হলো নিরাপত্তা। যেখানে আপৎকালে মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুর জীবন রক্ষা করতে হয় এবং অতীব সহজে সকলের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করে, এখানে সকলের প্রবেশের দিক বিবেচনা করতে গিয়ে কোথাও যেন আড়াআড়ি না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হয়। এখানে উল্লেখ্য, উঁচু জায়গায় ওঠার জন্য সিঁড়ি ও ঢাল (Ramp) ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু প্রবীণ লোক ও গবাদিপশুদের ঢাল ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ। আপৎকালে গবাদিপশু যেন সহজে দৃশ্যমান হয় সেদিকটায়ও নজর দিতে হয়।
ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য জায়গা নির্বাচন
জায়গা (Site) নির্বাচন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের ডিজাইন করার ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা করতে হয়। স্থানটি স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য সহজে গমন করার ব্যবস্থা থাকতে হয় এবং সাধারণত কোনো গ্রাম, কেন্দ্র বা বাজার স্থানে হলে ভালো হয়। জমিটি উঁচু হলে আরো ভালো।
নতুন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের প্রস্তাবনা
এখানে দুই ধরনের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের প্রস্তাবনা করা হচ্ছে, যা নকশা ও চিত্রে ডিজাইন-১ ও ডিজাইন-২ নাম-এ বর্ণনা করা হলো। উভয় প্রস্তাবনা একটি সাধারণ বর্তুলকায় আকৃতি নির্বাচন করা হয়েছে এবং মানুষজনের জন্য অতি সহজ একটি আয়তকার ভবনের নকশা পরিকল্পনা করা হয়। এখানে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকার এক হাজার জনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যা প্রয়োজনে বড়-ছোট করা সম্ভব। ডিজাইন-১-এর একটি বর্তুলকায় প্রাচীর নির্মাণ করে (যার উচ্চতা-২০ ফুট, সর্বোচ্চ জলোচ্ছ্বাসের উপরে) একটি ভ‚মিতে নিরাপদ জায়গা তৈরি করা হয়েছে, যা দুর্যোগের সময় গবাদিপশু থাকার আর সাধারণ সময়ে তা খেলার মাঠ, গ্রাম্য বাজার বা কমিউনিটি স্পেস হিসেবে ব্যবহৃত হবে। মধ্যখানে তিনতলা ভবনটি দুর্যোগকালে মানুষ আশ্রয় নেবে আর সাধারণ সময়ে বিদ্যালয়, লাইব্রেরি বা অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হবে। অন্যদিকে ডিজাইন-০২-এ সম্পূর্ণ জায়গাটি উঁচু করে কেল্লা তৈরি করা যেতে পারে, যার চারপাশে মাটি দ্বারা বেষ্টিত হবে এবং যার উচ্চতা জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা থেকে বেশি হবে, এখানেও বর্তুলকায় একটি আকৃতি তৈরি করা হবে, যা সম্পূর্ণ মাটি এবং এই মাটি যেখান থেকে নেওয়া হবে তা পুকুর হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারবে। কেল্লার উপরিভাগ কিছুটা ঝঁহশবহ করে দেওয়া হবে আর ঐ ঝঁহশবহ অংশে পশু থাকবে। সাধারণ সময়ে এটা খেলার মাঠ বা অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হতে পারবে। মাঝখানের আয়ত আকৃতির দ্বিতল ভবনটি মানুষকে রক্ষা করবে, পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন কাজ অথবা বিদ্যালয় হিসেবে সাধারণ সময়ে ব্যবহার করা যাবে, উভয় প্রস্তাবনায় মানুষ এবং গবাদিপশুর জন্য আলাদা সিঁড়ি ও ঢালের ব্যবস্থা করা হবে।
উপসংহার
ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রকে শুধু দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্রের মতো চিন্তা না করে গ্রাম/মহল্লায় সারা বছরের ব্যবহার উপযোগী একটি ভবন হিসেবে ভাবতে হবে, যা জীবনরক্ষার পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে গ্রামের মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হবে, যা উন্মুক্ত জায়গায় গ্রামের খেলার মাঠের চাহিদা পূরণ করে এবং সম্পূর্ণ প্রকল্পটি গ্রামের একটি আইকন ভবনে পরিণত হবে।
কানু কুমার দাশ
সহকারী অধ্যাপক
স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৭ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১২