দ্রুত নগরায়ণের ফলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বর্তমানে ভয়াবহ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। জনসাধারণ সব সময় চেয়েছে স্থানীয় সরকারই এই ব্যবস্থাপনা করুক। তারাই নিজ নিজ এলাকা পরিষ্কার করার দায়িত্ব পালন করুক। এ কারণেই সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাসমূহ বিভিন্ন সময়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পুনঃব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। বিগত ক’বছর ধরে বাংলাদেশ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নানান নতুন কৌশল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে যাতে এই সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া যায়। দেশে এই মুহূর্তে ৫২২টিরও বেশি শহর রয়েছে। এগুলো যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার মূলকেন্দ্র, তেমনি নানান রকম গৃহস্থালি, শিল্প, বাণিজ্যিক, মেডিকেল এবং কৃষিজ বর্জ্যরে মূল উৎস। এ ক্ষেত্রে নিম্নমানের বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন ব্যবস্থা, যথোপযুক্ত বর্জ্য পরিশোধন, পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের অভাব আজকের এই অসহনীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী। এই অব্যবস্থাপনাই প্রতিনিয়ত মাটি, পানি ও বায়ু দূষণ করে চলেছে।
বর্জ্যরে ব্যাপারে আমাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। বর্জ্য বলতে আমরা বুঝি, যার কোনোই মূল্য নেই। পরিবর্তনটা আনতে হবেই এখানেই।
একটা টেকসই অর্থনীতি এবং সামাজিক ব্যবস্থায় বর্জ্য হলো সেই বস্তু যার আপাত কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই, কিন্তু এর অর্থনৈতিক মূল্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। আর এই পুনরুদ্ধার আনতে হবে উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোগের বিভিন্ন স্তরে।
১ এবং ২ নং চিত্রে পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোগ এবং তা পরিবেশে নির্গত করার দুটি ভিন্ন ব্যবস্থা দেখানো হয়েছে। প্রথমটিতে একটি একমুখী ব্যবস্থা দেখানো হয়েছে, যেখানে সম্পদ ব্যবহার কমানো বা বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের খুব কম চেষ্টাই করা হয়। ফলে প্রচুর বর্জ্য তৈরি হয় এবং যা পুরোটাই পরিবেশে নির্গত হয়।
অন্য চিত্রে একটি টেকসই ব্যবস্থা দেখানো হয়েছে, যেখানে পরিবেশ থেকে সম্পদ কম আহরণের চেষ্টা করা হয় এবং যে কোনো বর্জ্যকে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পুনঃব্যবহার বা পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা করা হয়। যথাসম্ভব চেষ্টা করা হয় যেন খুব কম পরিমাণ বর্জ্যই পরিবেশে নির্গত হয়। উৎপাদন থেকে ভোগের বিভিন্ন স্তরে এই তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিলেই সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব। আর এই তিনটি বিষয়কেই একসাথে বলে 3R হ্রাসকরণ (Reduce), Reuse (পুনঃব্যবহার), Recycle (পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ)
চিত্র ১
চিত্র ২
টেকসই উন্নয়নের জন্য পণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোগের বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তন আনার বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পায় ২০০২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ‘World Summit on Sustainable Development’এর ১৭তম প্লেনারি মিটিংয়ে গৃহীত জোহানেসবার্গ ঘোষণায়। Johannesburg Plan of Implementation (JPOI) নামে পরিচিত এই পরিকল্পনায় বর্জ্য হ্রাস, পুনঃব্যবহার, পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বৃদ্ধি এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি থেকে সম্পদ যথাসম্ভব কম আহরণের কথা বলা হয়। এই পরিকল্পনা থেকেই বিশ্বব্যাপী 3R-এর উপর গুরুত্ব বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জাপান সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের সেন্টার ফর রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট (UNCRD) মিলে তৈরি করে Regional 3R Forum in Asia। ২০১১ সালের ১১ ও ১২ নভেম্বর টোকিওতে এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘টোকিও 3R স্টেটমেন্ট’ গৃহীত হয়; যার লক্ষ্য ছিল এশিয়ায় 3R-এর উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশ ছিল এর অন্যতম অংশীদার। সেই আলোকেই তৈরি হয় আমাদের জাতীয় ৩জ কৌশল।
3R কী?
বর্জ্য কমানো, বর্জ্য পুনঃব্যবহার এবং বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের যে প্রক্রিয়াটি রয়েছে তাকেই একসাথে বলে 3R.
Reduce : উৎপাদন থেকে ভোগ পর্যন্ত এমন দ্রব্য ব্যবহার বা ব্যবস্থাপনা অবলম্বন করা যাতে বর্জ্য উৎপাদন এবং সম্পদের ব্যবহার হ্রাস পায়।
Reuse : ব্যবহৃত পণ্য বা পণ্যের অংশ পুনরায় ব্যবহার করা
Recycle : ব্যবহৃত পণ্য পুনরায় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করা অর্থাৎ পুনরায় প্রক্রিয়াজাত করা।
বর্জ্য হ্রাসকরণ এই 3R-এর উপর যথাযথ গুরুত্বারোপের মাধ্যমেই সম্ভব। একবার চিন্তা করে দেখুন তো, আমরা যদি সম্পদ কম ব্যবহার করে উৎপাদন করতাম, ভোগের পর বর্জ্যকে ফেলে না দিয়ে যদি পুনরায় ব্যবহার করতাম তা হলে কি আজকের এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এতটা জটিল হতো?
জাতীয় 3R লক্ষ্য
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় ৩জ লক্ষ্য হলো ২০১৫ সালের মধ্যে সারা দেশে সকল উন্মুক্ত স্থান, নদী বা পুকুরের আশপাশ থেকে সকল আবর্জনার স্তূপ সরিয়ে তা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণকে ত্বরান্বিত করতে হবে। এর জন্য উৎসেই বর্জ্য পৃথকীকরণ করে এবং পুনঃপ্রক্রিয়াজাত পণ্যের বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করতে হবে।
জাতীয় 3R কৌশলের মূল উদ্দেশ্যসমূহ
- দেশ 3R ব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করার প্রধান বাধাসমূহ চিহ্নিত করা
- 3R ব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করার জন্য বিভিন্ন স্তরের কর্তব্য নির্ধারণ
- দেশে ৩জ সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান
- 3R-এর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
- পৌর বর্জ্য, শিল্প বর্জ্য, জৈব চিকিৎসা বর্জ্য, প্রাতিষ্ঠানিক এবং বাণিজ্যিক বর্জ্য এবং কৃষি বর্জ্য এগুলোই 3R বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ দিক।
- দিকনির্দেশনার মূলনীতি
- নিম্নোক্ত বিষয়গুলোই জাতীয় 3R কৌশলের মূলনীতি, যার উপর গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমেই আমাদের দেশে 3R বাস্তবায়ন সম্ভব।
১. বর্জ্যই সম্পদ
সাধারণভাবে আমরা বর্জ্য বলতে বুঝি যার কোনোই মূল্য নেই। আমাদের এই জায়গাটিতেই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। 3R কৌশলের আওতায় বর্জ্য বলতে আমরা বুঝব ব্যবহৃত সেই পণ্য যার আপাতত কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই, তবে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে এর অর্থনৈতিক মূল্য তৈরি করা সম্ভব। অর্থাৎ আপাত মূল্যহীন বস্তুর নতুন অর্থনৈতিক মূল্য তৈরি করতে হবে। এবং এই কাজটি করতে হবে দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং গবেষণার মাধ্যমে।
২. উৎসেই পৃথকীকরণ
উৎসেই বর্জ্য পৃথকীকরণ 3Rকৌশল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলোর একটি। সম্প্রতি দেখা গেছে, পুনরায় ব্যবহার উপযোগী বর্জ্য যেমন কাগজ, প্লাস্টিক, ভাঙা গ্লাসের টুকরো, ধাতব বস্তু ইত্যাদি অন্যান্য পৌর বর্জ্যরে সঙ্গে মিশে একসাথে ডাস্টবিনে যায়। ফলে এগুলো আলাদা করা একদিকে যেমন কষ্টসাধ্য তেমনি অন্যদিকে তা অন্যান্য বর্জ্যরে সাথে মিশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে জটিল করে তুলছে। এ জন্যই বর্জ্যরে উৎসে বর্জ্য পৃথকীকরণ এতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা যদি বর্জ্যটিকে আলাদা করি তা হলে এর গুণাগুণ সম্পর্কে বুঝতে পারব এবং সেই অনুসারে ব্যবস্থা নিতে পারব।
বর্জ্য পৃথকীকরণ সাধারণত তিন স্তরে হতে পারে। যেমন
- গৃহস্থালি বা কমিউনিটি পর্যায়ে
- বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহন পর্যায়ে
- বর্জ্য যেখানে সবশেষে জমা হচ্ছে সেই পর্যায়ে
গবেষণা করে দেখা গেছে, ৮০-৯০ শতাংশ বর্জ্যই পুনরায় ব্যবহার বা পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করা সম্ভব। শুধু যদি আমরা উৎসেই বর্জ্যরে বৈশিষ্ট্য অনুসারে তাদের আলাদা করে ফেলি তা হলে এই কাজটি আমাদের জন্য অনেক সহজ হয়। যেমন ভিন্ন ভিন্ন বর্জ্যরে জন্য আলাদা ডাস্টবিন
৩. সহজলভ্য ও সুলভ প্রযুক্তি নির্ধারণ
3R বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশবান্ধব এবং সজলভ্য প্রযুক্তির ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের গুরুত্ব দিতে হবে। ভোক্তা থেকে শুরু করে সকল স্তরের প্রচেষ্টায় এমন পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করতে হবে যাতে আমরা আমাদের 3R-এর লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে পারি। বর্জ্য অধিক হারে উৎপাদনকারী কারখানাগুলোর ব্যাপারে বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। যেহেতু তারাই সবচেয়ে বেশি বর্জ্য তৈরি করে থাকে সেহেতু এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সুলভ ও সহজলভ্য প্রযুক্তিটি খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে তাদেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সাথে আমাদের এটাও খেয়াল রাখতে হবে, আমরা যেন আমাদের পুনঃপ্রক্রিয়াজাত পণ্যের জন্য উপযুক্ত বাজার সৃষ্টি করতে পারি।
৪. প্রযুক্তিকে হতে হবে দূষণমুক্ত
আমরা যে ধরনের প্রযুক্তিই ব্যবহার করি না কেন তাকে হতে হবে পরিবেশবান্ধব। তাতে যেন কম গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গত হয়। কিওটো প্রটোকলের Clean Development Mechanism (CDM)-এর ১নং ধারা অনুসারে গ্রীন হাউস গ্যাসের নির্গমন কমানোর জন্য অনুদানের ব্যবস্থা রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো এই ধারার মাধ্যমে কম গ্রীন হাউস গ্যাস তৈরি হওয়া প্রকল্পগুলোতে সহজেই বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে পারে। এই ঈউগ-এর আওতায় আমরা নানা রকম দূষণমুক্ত প্রযুক্তি সহজেই এবং সুলভে ব্যবহার করতে পারি।
৫. নির্মল উৎপাদন
নির্মল উৎপাদন বলতে সেই চলমান প্রক্রিয়াকেই বোঝায় যেখানে দূষণ কমানোর চেষ্টা করা হয়, এনার্জি, পানি ও অন্যান্য সম্পদ কম ব্যবহার করা হয়। সর্বোপরি উৎপাদনে বর্জ্য হ্রাস করা হয়। মোটকথা এই প্রক্রিয়ার মধ্যে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে টেকসই ব্যবস্থা, পণ্যের আয়ু বাড়ানো, কাঁচামাল নির্ধারণের ক্ষেত্রে সতর্কতা, এমনকি পণ্য বাজারজাত করা পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই একটা পরিবেশবান্ধব নীতি অনুসরণ করতে হবে।
এগুলো ছাড়াও আমাদের জাতীয় 3R কৌশলে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা রয়েছে। যেগুলো অনুসরণ করে আমরা সহজেই আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক এবং টেকসই করে গড়ে তুলতে পারি। আমরা এমন একটি সঙ্কটময় সময়ে অবস্থান করছি যেখানে পরিবেশকে রক্ষা করে বাঁচা ছাড়া আর কোনো উপায়ই নেই। আমাদের দেশের অসহনীয় বর্জ্য ব্যবস্থাকে সহনীয় করার জন্য আমাদের সামনে 3R-এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প নেই। আমাদের আরো গভীরভাবে জানতে হবে এর বিভিন্ন অংশ। সেই আলোকেই আমাদের মধ্যে 3R বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, একা সরকারের পক্ষে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই সকলেই নিজ উদ্যোগে প্রতিদিন যতটা সম্ভব এই 3R-এর চর্চা শুরু করতে হবে। একটু একটু চেষ্টাই একসময় আমাদের আশপাশের নোংরা দুর্গন্ধময় পরিবেশটিকে আগামীর বসবাস উপযোগী করে গড়ে তুলবে।
সাঈদ তাসনিম মাহমুদ
বি.এসসি., সিভিল অ্যান্ড এনভায়রমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
সূত্র : সকল লেখার মূলভাব এবং ছবি পরিবেশ অধিদফতর থেকে প্রকাশিত National 3R Strategy for Waste Management থেকে নেওয়া হয়েছে।
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৯ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১২