ঘরের সাজসজ্জায় কাঠের ব্যবহার অনেকদিনের। বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরিতে ক্রমেই বাড়ছে এর ব্যবহার। অন্দরের আসবাব ও সাজসজ্জায় কাঠের বহুমুখী ব্যবহারে গাছ কাটার ফলে উজাড় হচ্ছে বৃক্ষ; বিপর্যয়ের সম্মুখীন পরিবেশ। আর তাই পরিবেশ রক্ষার্থে ও কাঠের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পাচ্ছে পার্টিকেল বোর্ড। এটি কাঠ সদৃশ বস্তু, যা তৈরি হয় কাঠের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে। সাধারণত স মিলে কাঠ চেরাইয়ের সময় পাওয়া স ডাস্ট এবং কাঠের ছোট ছোট টুকরো করে এর সাথে সিনথেটিক রেসিন বা বিভিন্ন কেমিক্যাল (Bonding chemicals) মিশিয়ে ছাঁচের মাধ্যমে উচ্চ চাপ প্রয়োগে যে বিশেষ কাঠের আদল তৈরি করা হয় সেটাই পার্টিকেল বোর্ড।
বৈশিষ্ট্য
- এটা কাঠের প্রতিস্থাপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা দামেও বেশ সস্তা।
- সাধারণত প্রাকৃতিক কাঠ বা প্লাইউড থেকে এর ঘনত্ব ও মসৃণতা অনেক বেশি।
- এটা বেশ হালকা, যা সহজেই বহন করা যায়।
- পার্টিকেল বোর্ডকে সুন্দর রঙ দ্বারা দৃষ্টিনন্দন করা যায়।
- লেমিনেশন করা যায়। ফলে এর স্থায়িত্ব বাড়ে।
- খুব কম খরচে ছোট ছোট ক্যাবিনেট, বক্স এবং বুক সেলফ তৈরি করা যায়।
- আর্দ্র আবহাওয়ায় এটি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইতিহাস এবং ক্রমোন্নতি/উত্তরোত্তর বিকাশ
অত্যাধুনিক প্লাইউডকে বলা যায় প্রাকৃতিক কাঠের বিকল্প ব্যবস্থা, যা ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবিষ্কার। কিন্তু ১৯৪০ সালের শেষের দিকে কাঠ চেরাই করা তক্তার অপ্রতুলতার জন্য প্লাইউড তৈরি বেশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে পার্টিকেল বোর্ড বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে চালু হয়। জার্মানির ম্যাক্স হিমেলহেবার পার্টিকেল বোর্ডের আবিষ্কারক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হয়েছিল জার্মানির ব্রিমেন কারখানাটি। সে সময় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হতো প্ল্যানার মেশিন থেকে পরিত্যক্ত টুকরো কাঠ ও কাঠের গুঁড়া। তখন হ্যামার মিলিং মেশিন দ্বারা ছোট ছোট টুকরো বা চিপসের সাথে ফেনোলিক রেসিন (সংক্রামক/সংক্রমণ রোধ করার জন্য ব্যবহৃত) মেশানো হতো। হ্যামার মিলিং মেশিন দ্বারা কাঁচামালগুলোকে এত ছোট ছোট টুকরো করা হতো যেন খুব ছোট চালনির ভেতর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। বর্তমানে বেশিরভাগ পার্টিকেল বোর্ড তৈরি হয় সেই একই পদ্ধতিতে। পার্থক্য শুধু রেসিন ব্যবহারের ভিন্নতায়। সে সময় প্রস্তুতকারকরা বিচ ফলের গাছের কাঠ, ভুজ জাতীয় গাছ ও পাইন কাঠ ব্যবহার করে ছোট ছোট হালকা টুকরা তৈরি করত। সেটা দিয়ে তিন স্তরের পার্টিকেল বোর্ড তৈরি হতো, যার বাইরের দিকটা থাকত খুবই শক্ত আর মসৃণ এবং মাঝখানের অংশটি হতো অমসৃণ। বর্তমানে অনেক গুণাগুণ সম্পন্ন ও অধিক পুরুত্ব আকারে পার্টিকেল বোর্ড তৈরি হচ্ছে। পার্টিকেল বোর্ড আকারেও যেমন ছোট হয়ে আসছে তেমনি মসৃণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে।
নির্মাণ প্রক্রিয়া
কাঠের ছোট ছোট টুকরোর সাথে রেসিন মিশ্রিত করে উচ্চ চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে পার্টিকেল বোর্ড তৈরি করা হয়। কাঁচামাল হিসেবে কাঠের টুকরোকে প্রথমে ডিসক চিপারের মধ্যে ফেলা হয়, যেখানে ৪ থেকে ১৬টি কাটিং ব্লেড থাকে। প্রথমে কাঠের টুকরোগুলো শুকানো হয়। পরবর্তীতে বড় এবং ছোট আকারের কাঠের টুকরোগুলো পৃথক করা হয় ছাঁকনির মাধ্যমে। তরল রেসিন নজেলের সাহায্যে কাঠের টুকরোগুলোর উপর স্প্রে করা হয়। ইউরিয়া ম্যালামাইন রেসিন ব্যবহার করা হয় পানি রোধ করার জন্য। ফেনোল ফরমালডিহাইড ব্যবহার করে পার্টিকেল বোর্ড তৈরি করা হয়। এ কাজে ব্যবহৃত বোর্ড প্যানেলটির বাইরের দিকটা হতে হবে পানি রোধক। পার্টিকেল বোর্ডের প্যানেল তৈরি করার জন্য অনেক ধরনের রাসায়নিক মোম রঙ পানিযুক্ত কার্যনিযুক্তক (wetting agent) অব্যাহতি কার্যনিযুক্তক (Release agent) হিসেবে ব্যবহার করে পার্টিকেল বোর্ড তৈরি হয়, যা পানি রোধক, অগ্নিনিরোধ।
ওজন মাপার যন্ত্রের সাহায্যে ছোট ছোট হালকা পাতলা কাঠের টুকরোগুলো মাপা হয় এবং সেগুলো সঠিক স্থানে এসে জড়ো হয় ঘূর্ণায়মান র্যাকের মধ্যে। উন্নত মানের পার্টিকেল বোর্ড তৈরি করতে কাঠের টুকরো মিশ্রিত রেসিনকে মেশিনের মাধ্যমে ছোট আকারে ছুড়ে ফেলতে হবে, যাতে পার্টিকেলগুলো আরো বেশি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ জন্য দুটি জেট রাখা হয় পার্টিকেল ছুড়ে ফেলার জন্য, যাতে একটি বেশি পুরুত্বের (high density) বোর্ড তৈরি হয় এবং অন্যটি অপেক্ষাকৃত কম পুরুত্বের (low density) বোর্ড তৈরি হয়। সর্বশেষে যে শিটটি তৈরি হলো সেটা ঠান্ডা চাপের মাধ্যমে বোর্ডের পুরুত্ব কমানো হয়, যাতে পরিবহন সহজতর হয়। তখন তাপমাত্রা থাকে ১৪০ ডিগ্রি সে. হতে ২২০ ডিগ্রি সে.। পরিশেষে পার্টিকেল বোর্ডটি ঠান্ডা অবস্থায় কারখানা থেকে বেরিয়ে আসে এবং বাজারে বিক্রির জন্য কাঁচা বা Raw practical Board হিসেবে প্রস্তুত করা হয়। বোর্ডকে নান্দনিক রূপ দিতে বোর্ডের উপর লেমিনেটেড সুন্দর রঙ সদৃশ প্রলেপ দেওয়া হয়।
লেমিনেটেড পার্টিকেল বা ফাইবার বোর্ড
সাধারণত পার্টিকেল বোর্ডকে ডিজাইন পেপার দ্বারা উভয় তলেই যখন পেস্ট করা হয় তখন সেটাকে লেমিনেটেড পার্টিকেল বা ফাইবার বোর্ড বলা হয়। ডিজাইন পেপারটি উত্তপ্ত চাপে বোর্ডের উভয় দিকে প্রলেপ দেওয়ার ফলে লেমিনেটেড পার্টিকেল বোর্ডে পরিণত হয়। ডিজাইন পেপার বোর্ডের উভয় দিকে সংযোজিত হয় যেন ডিজাইন পেপারটি দীর্ঘদিন তাতে লেগে থাকে; যা পানি পড়লে নষ্ট হয় না। শিটের পুরুত্ব (thickness) সাধারণত ৬, ৮, ১০, ১২, ১৫, ১৮ এবং ২৫ মিলিমিটার হয়ে থাকে এবং বোর্ডের সাইজ সাধারণত ১.২২ মিটারঢ২.৪৪ মিটার, ১.৮৪ মিটারঢ২.৭৪ মিটার এবং ১.৮৪ মিটারঢ৩.৬৬ মিটার হয়। যখন ডিজাইন পেপারটি পার্টিকেল বোর্ডের একটি তলে আটকানো হয় তখন এটাকে একদিকের লেমিনেটেড বোর্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অপর দিকটিতে অপেক্ষাকৃত কম উজ্জ্বল রঙ দ্বারা পেস্ট করা হয়।
সাইজ ও পুরুত্ব
পার্টিকেল বোর্ড তিন স্তরবিশিষ্ট বোর্ড। এটির সবচেয়ে মসৃণ তল উপরে ও নিচের দিকে থাকে এবং বোর্ডের মাঝখানে কাঠের বড় টুকরোগুলো থাকে।
সাধারণ গ্রেডের পার্টিকেল বোর্ড :
১. মানসম্পন্ন
২. আর্দ্রতা প্রতিরোধকারী
ফ্লোরিং
আর্দ্রতা প্রতিরোধ পার্টিকেল বোর্ড খুব ধীরে ধীরে বাতাসের জলীয় বাষ্প শুষে নিতে পারে স্ট্যান্ডার্ড পার্টিকেল বোর্ডের তুলনায়। কাঠের গুঁড়ার সাথে আর্দ্রতা প্রতিরোধকারী রেজিন মিশানো হয়। রেজিনের সাথে মোমও মিশ্রিত করা হয়, যাতে পানি প্রতিরোধ গুণাগুণ বিদ্যমান থাকে।
সুবিধা ও অসুবিধা
প্রাকৃতিক কাঠ বা প্লাইউডের তুলনায় এর খরচ অনেক কম।
পার্টিকেল বোর্ড পিচ্ছিল, মসৃণ এবং খুব বেশি সমতল। তাই বোর্ড মেঝের জন্য খুব বেশি ব্যবহার করা হয় এবং গ্লু দ্বারা আটকানো খুব সহজ ও ভালো ফল পাওয়া যায়। শুধু একটি মাত্র অসুবিধা এবং তা হচ্ছে পার্টিকেল বোর্ড খুব সহজেই বাতাসের আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং সহজেই পানি শোষণ করতে পারে।
এটি বেশ পরিবেশবান্ধব। কারণ তা পুনরায় রিসাইকেল পদ্ধতিতে নতুন করে ব্যবহার করা যায়।
প্রাকৃতিক কাঠের তুলনায় এটা সাধারণত হালকা হয়। ফলে অনেক সময় দেখা যায় ভার না রাখতে পেরে বা দীর্ঘদিন ওজন রাখার পর তা ভেঙে, বেঁকে অথবা জোড়া স্থানটি খুলে যায়।
পার্টিকেল বোর্ডে যদি কখনো স্ক্রু দিয়ে আটকানোর প্রয়োজন হয় তখন খুব সাবধানতা অবলম্বন না করলে পার্টিকেল বোর্ডটি হয়তো ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রাকৃতিক কাঠের ক্ষেত্রে তেমনটি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
প্রাকৃতিক কাঠ solid wood) দীর্ঘস্থায়ী পার্টিকেল বোর্ডের তুলনায় যদি কখনো নষ্ট বা ফেটে যায় বা এ ধরনের কিছু হয় তখন তা মেরামত করা যায়। কিন্তু পার্টিকেল বোর্ডের উভয় তল মসৃণ হওয়ায় মেরামত করা বা জোড়া লাগানো সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ পার্টিকেল বোর্ড প্রতিস্থাপন করা ছাড়া উপায় থাকে না।
পার্টিকেল বোর্ডের মেশিনিং করার সময় প্রচুর কাঠের গুঁড়ার ধুলা বের হয়। এমন অনেক দেশ আছে যেখানে কাঠের গুঁড়ার দ্বারা পরিবেশ দূষিত হচ্ছে বিধায় সেখানে পরিবেশবান্ধব অনেক নিয়মকানুন বেঁধে দেওয়া হয়।
বাড়ি তৈরিতে যে শুধু পার্টিকেল বোর্ড ব্যবহার হয় তা নয়। এটার সাথে বিল্ডিং উপাদান হিসেবে ইউরিয়া ফরমালডিহাইড, ফোম, ইনসুলেশনও ব্যবহার করা হয়। ফরমালডিহাইড কেমিক্যালটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) শ্রেণী বিন্যাস করে দিয়েছে, যা মানুষের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
প্রকৌশলী মহিউদ্দীন আহমেদ
প্রাক্তন অতি. প্রধান প্রকৌশলী বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন
প্রকাশকাল: বন্ধন ২৮ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১২