পাহাড় কাটা বন্ধ না হওয়ার কারণ

পরিবেশ বিপর্যয়ের এখনকার অন্যতম প্রধান কারণ পাহাড় কাটা। কেননা পাহাড় কাটার ফলে আশপাশের এলাকায় হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা ইকো সিস্টেমের ভারসাম্য নষ্ট হয়। যার দরুন ওখানকার জলবায়ু, পরিবেশ, মাটি, পানি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়ে ভয়াবহ প্রভাব। এ বিষয়ের গবেষণা বলছে, যথেচ্ছভাবে পাহাড় কাটার ফলে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে দ্রুতই। একই সঙ্গে পাহাড় কাটার ফলে নিঃশেষ হচ্ছে সবুজ বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল।

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতা নেই আমাদের। আর তাই স্বল্প প্রাচুর্যের প্রাকৃতিক সম্পদ ঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে তা হবে দেশের জন্য অভিশাপ। কারণ, এই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভর করছে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়ন। জীববৈচিত্র্যগত দিক থেকে পাহাড়ি অঞ্চলসমূহ নানামুখী ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। কালের বহমান প্রবাহে সেখানে গড়ে উঠছে বৈচিত্র্যময় জীবনপ্রবাহ আর চমৎকার প্রাকৃতিক মেলবন্ধন। কারণ, জীবনধারণে একটি অপরটির পরিপূরক। এই দিক বিবেচনায় পাহাড়ি অঞ্চলের ভূমিকা দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এরপরও দিনের পর দিন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব। একদিকে সংবাদমাধ্যমগুলো প্রতিনিয়ত প্রচার করছে পাহাড় কাটার খবর, অন্যদিকে ভ্রুক্ষেপহীনভাবে প্রশাসনের নাকের ডগায় রাতের অন্ধকারে দ্রুতগতিতে চলছে পাহাড় কাটা। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় বরাবরই চোখে পড়ার মতো। জাতীয় দৈনিকগুলো যখন ‘পাহাড় কাটা’ নিয়ে প্রতিবেদন করে তখনই টনক নড়ে প্রশাসনের। এর মানে কি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ ব্যাপারে আগে থেকে কিছুই জানে না কিংবা খোঁজ রাখে না? এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা অবশ্যই প্রশ্নাতীত। দেশে এ ব্যাপারে আইন থাকলেও খুব কদাচিৎ দেখা যায় শাস্তি প্রদানের।

পাহাড় কাটায় ব্যস্ত শ্রমিকেরা

সাধারণত সিলেট-চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর গড় উচ্চতা ৬০ থেকে ১৫০ মিটার এবং এসব পাহাড়ে রয়েছে এমন কিছু জীববৈচিত্র্য, যা আমাদের পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে এগুলো। আমাদের দেশে পাহাড় কাটাসংক্রান্ত নিয়মনীতিতে স্পষ্টতই উল্লেখ আছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে পাহাড় কাটতে পারবে না, আইনের ব্যত্যয় হলে একই সঙ্গে নিম্ন ১০ বছরের জেল কিংবা ১০ লাখ টাকার জরিমানা প্রদানের বিধানও রয়েছে। যদিও এমন আইনের কার্যকারিতা পরিবেশ ধ্বংসের সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ তা বিবেচনার বিষয়। বাস্তবে কিন্তু এ ধরনের আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। পাহাড়গুলোর অবকাঠামো দিক বিবেচনায় গঠনশৈলীর দিক থেকে এখানকার পাহাড়ে অনেক স্তর বিদ্যমান। তাই না বুঝে কিংবা শুধু নিজেদের লাভের আশায় পাহাড় কাটতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে অনেকেই। তথাপি দিনের পর দিন দেখা যাচ্ছে পাহাড়গুলোর ওপরেই রাতারাতি নির্মিত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প; যেখানে নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রেও পাহাড়ের অবকাঠামোগত বৈশিষ্ট্য না মেনে পৃষ্ঠকে সমতল করে প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। যার দরুন পাহাড় আর পাহাড় থাকছে না। এমনকি পাহাড় কাটার কারণে ভূপৃষ্ঠের সামঞ্জস্যতা ভেঙে কোনো একদিকে হেলে যাচ্ছে, ভেঙে পড়ছে ড্রেনেজ সিস্টেম। অথচ এসব কাজের সঙ্গে দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি প্রভাবশালীরা যুক্ত। আর এভাবেই সিলেট, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য পাহাড়িয়া অঞ্চলের পাহাড় বিগত ১০ বছরে বিলীন হয়ে গেছে। সাধারণত মনিটরিংয়ের অভাবের পাশাপাশি পাহাড় সম্পর্কিত স্পষ্ট জ্ঞানের অভাবই এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। এ ছাড়া পাহাড় রক্ষা ও কাটা সম্পর্কিত যথোপযুক্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা না করা, সাধারণ মানুষের মধ্যে জনসচেতনতার অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যক্তিগত লাভালাভ, অদক্ষ শ্রমিক, পরিবেশ সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট আইন এবং এর প্রয়োগের অভাবই এ অবস্থার জন্য বহুলাংশে দায়ী। রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট অরাজকতা আর অস্থিরতার কারণে পাহাড় কাটতে দেখেও অনেকেই থাকে নিশ্চুপ। কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে ভয় পায়। কারণ, এই অবৈধ কাজে কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা জড়িত। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে, তবে তা করতে চাইলে সরকারকে হতে হবে আরও কঠোর। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আইনের শাসন। অপর দিকে পরিবেশসংশ্লিস্ট সংস্থা কিংবা প্রতিষ্ঠানগুলো খুব সহজেই পরিবেশ পরিবর্তনের চিত্র পর্যবেক্ষণ করতে পারে প্যানরিমিক ছবি তোলার মাধ্যমে, যা করতে হবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর। এতে দৃশ্যমান পরিবর্তন ধরা পড়বে খুব সহজেই। অনেক সময় পাহাড়ে বিভিন্ন প্রকার গাছ লাগানো হয়। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, এমন কোনো গাছ লাগানো ঠিক নয়, যার শিকড় পাহাড়ের স্তরবিন্যাসের জন্য ক্ষতি বা হুমকির কারণ হয়। পাহাড়ি মাটির ওপরের স্তর নষ্ট হয়ে ঘটতে পারে পাহাড়ধসের মতো ঘটনা।

চলছে পাহাড় কাটার মহাযজ্ঞ

সর্বাগ্রে সাধারণ মানুষকে পাহাড় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। স্থানীয় জলবায়ুর ওপর পাহাড়ের প্রভাব, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও খাদ্যের ওপর নির্ভরশীলতাকে বিবেচনায় নিতে হবে। পাহাড়ি অঞ্চলে বেড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীকুল ও বৃক্ষরাজি সম্পর্কিত জ্ঞান কর্মশালার মাধ্যমে দেওয়া যেতে পারে। পাহাড় সংরক্ষণের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে এর বৈচিত্র্যতা প্রকাশের জন্য জাদুঘর তৈরি মতো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। তবে সেটি পাহাড় রক্ষার জন্য হবে গুরুত্বপূর্ণ  পদক্ষেপ। এ ছাড়া পাহাড়ধসের ভয়াবহতার বাস্তব চিত্রগুলো সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজে আসতে পারে। কারণ, পাহাড় কাটা মানে পৃথিবীর কোনো এক অংশের প্রাকৃতিক সামঞ্জস্যতা নষ্ট করা, যার দরুন সমগ্র পরিবেশমণ্ডল এর বিরূপ প্রভাব নষ্ট করে দিতে পারে পারিপার্শ্বিক ভারসাম্য। এ বিবেচনায় সিলেট-চট্টগ্রামের অবস্থান খুব বেশি সুখকর নয়। এসব জায়গায় বর্তমানে পাহাড়ের ওপর বিভিন্ন প্রকার স্থাপনার কাজ চলছে যে কারণে সেখানে মাটি খনন ও পাইলিং করা হচ্ছে, যা যেকোনো সময় ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও পাহাড় কাটা রোধকল্পে গঠিত বিশেষ কমিটিকে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অনুমোদন না দিলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তিবিশেষ উচ্চপর্যায় থেকে ক্ষমতার মাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে বিশেষ কারও সান্নিধ্যে থেকে কাজগুলো করে থাকে। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন নিরুপায়। আর তাই এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঞ্চলকে সংরক্ষণ আইনে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে এবং বর্তমান আইনকে যুগোপযোগী করে পাহাড় কাটা কিছুটা রোধ করা সম্ভব। তবে যে বিষয়টি একান্তভাবে প্রয়োজন সেটি হচ্ছে, জনসচেতনতার পাশাপাশি বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং তা জনসাধারণের সামনে প্রকাশ করা। যারা রাতের আঁধারে পাহাড় কাটে, কর্তৃপক্ষ তাদের চিহ্নিত করতে পারলেও আইনের আওতায় শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যর্থ।

টিলা কাটতে ব্যবহৃত স্ক্যাভেটর

বৈচিত্র্য আর ঐতিহ্যের দেশ বাংলাদেশ। এখানে রয়েছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, যাদের রয়েছে আলাদা আলাদা নিজস্ব সংস্কৃতি। পাহাড়ি অঞ্চলে একদিকে যেমন রয়েছে প্রথাগত ঐতিহ্য-জীববৈচিত্র্য, তেমনি পর্যটনশিল্প বিকাশে রয়েছে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যেখান থেকে বাংলাদেশের অর্জন হবে অনেক। এদিক বিবেচনায় পাহাড় আমাদের বড় সম্পদ এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সবার মধ্যে। গড়ে তুলতে হবে পাহাড় রক্ষার জন্য ‘হিল কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’, যার দরুন কিছুটা হলেও সমাধান হতে পারে দেশের বেকার সমস্যার। সরকার এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টরকেও বিশেষ নীতিমালার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। পাহাড় কাটার কারণগুলোকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে সেখান থেকে বিরত থাকার জন্য প্রয়োজনবোধে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মশালার পাশাপাশি পোস্টারিং করা যেতে পারে। সচেতনতা বোধ থেকে তবেই নিজেদের বিবেকের তাড়নায় বন্ধ হবে পাহাড় কাটা।

সজল চৌধুরী

শিক্ষক ও পরিবেশবিষয়ক গবেষক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

[email protected]

প্রকাশকাল: বন্ধন ৪৯ তম সংখ্যা, মে ২০১৪

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top