স্থাপত্যশিল্পে নির্মাণসামগ্রী হিসেবে কংক্রিটের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। সেই সঙ্গে দারুণ জনপ্রিয়ও। যেকোনো ধরনের কাঠামো তৈরিতে কংক্রিটের তুলনা নেই। এটি উচ্চমাত্রার সংকোচনে (Compression) পারদর্শী। কিন্তু আমরা কমবেশি অনেকেই জানি যে কোনো কাঠামোতে সংকোচনের পাশাপাশি রয়েছে প্রসারণের (Tension) উপস্থিতিও। কংক্রিটের প্রসারণ সহনশীলতা অত্যন্ত কম হওয়ায় সংগত কারণেই কংক্রিটের তৈরি কাঠামোতে প্রায়ই ফাটল বা চির ধরতে দেখা যায়, যা তার সংকোচন ক্ষমতার প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ। আর এই ফাটলের কারণে কংক্রিটের স্থায়িত্ব ক্রমেই কমে যায়। কেননা ফাটলের ফাঁক দিয়ে তরল পদার্থ, গ্যাস ও নানাবিধ ক্ষতিকারক পদার্থ প্রবেশের সুযোগ পায়। যদি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফাটল তৈরি হয়ে তা কংক্রিটে অবস্থিত রড পর্যন্ত পৌঁছার সুযোগ পায়, তবে তা শুধু কংক্রিটেই নয়, রডেও মরিচা ধরায়। আর এ কারণে যেকোনো কাঠামোতে ফাটল বা চির ধরলে তা দ্রুতই মেরামতের ব্যবস্থা করা দরকার। তা না হলে যত ভালোভাবেই তৈরি করা হোক না কেন, যেকোনো কাঠামোই ব্যর্থ হবে তার দীর্ঘস্থায়িত্ব অর্জনে। কংক্রিটের ফাটল মেরামত-প্রক্রিয়া অনেক সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ হলেও যথাসময়ে দ্রুততার সঙ্গে তা সংস্কার করা অতীব জরুরি।
চির প্রতিরোধ
কংক্রিট পৃথিবীতে সর্বাধিক ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রী হলেও বহুল ব্যবহৃত এই নির্মাণসামগ্রীর সবচেয়ে বড় ত্রুটি প্রসারণের প্রভাবে এটিতে খুব সহজেই চির বা ফাটল ধরে। আর যদি এই ফাটল বেশি বড় আকার ধারণ করে তবে শুরু হয় রডে মরিচা ধরা। এই ফাটল শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, এর ফলে কাঠামোর গুণগতমানেও পড়ে বড় ধরনের প্রভাব। আর এ জন্যই সাইট ইঞ্জিনিয়াররা প্রয়োজনের তুলনায় কিছু বেশি রড ডিসাইন এতে যুক্ত করেন, যাতে করে এই ফাটল ক্ষতিকর রূপ ধারণ করতে না পারে। এই অতিরিক্ত রডের কাঠামোগত কোনো ভূমিকা নেই; তার ওপর এটি আবার ব্যয়সাপেক্ষ পদ্ধতি। কেননা রডের বাজারমূল্য বর্তমানে অনেক বেশি। চির প্রতিরোধের অন্যতম উপায় এর মেরামতকরণ। কিন্তু ভূগর্ভস্থ ও তরল ধারণকৃত কাঠামোর ফাটল মেরামত করা অত্যন্ত কঠিন।
এমন যদি হতো ফাটল আপনাআপনি ঠিক হয়ে যাবে, তবে কতই না ভালো হতো! ভেবে দেখুন, এমন কংক্রিট দিয়ে আপনার শখের কাঠামোটি তৈরি যাতে ফাটল ধরেছে আর আপনি এ নিয়ে অনেক চিন্তিত না-জানি কবে এ ফাটল ভয়াবহ রূপ নেয়। আপনি হিসাব করছেন মেরামতের খরচ নিয়ে, হঠাৎ করেই তাকিয়ে দেখলেন সেখানে কোনো ফাটল নেই। ভাবছেন ব্যাপারটি কাকতলীয়। অবাক করা কিছু ঘটেছে হয়তো। আসলে এসবের কিছুই নয়। আশ্চর্য হলেও সত্য, অধুনা এ বিষয় নিয়ে নানা জায়গায় চলছে নানা গবেষণা। আর পরীক্ষাগারে বেশ কিছু সার্থক পরীক্ষায় দেখা যায় স্বনিরাময়যোগ্য কংক্রিট (Self-healing Conctete-এর ধারণা অসম্ভব কিছু নয়। আর এ পদ্ধতিটি সার্থকভাবে প্রযুক্ত হলে কংক্রিটের কাঠামো হয়ে উঠবে আরও বেশি জনপ্রিয় ও টেকসই।
ফাটল প্রতিরোধের জন্য বিশেষ কতকগুলো পদ্ধতি নিয়ে করা বিস্তারিত গবেষণা-
১. প্রথমত কংক্রিটের স্বয়ংজাত নিরাময় (autogenous healing) ক্ষমতা রয়েছে। কারণ কংক্রিট কাঠামোতে থাকে কিছু আনহাইড্রেটেড (unhydrated) সিমেন্ট, যা কিনা পানির সংস্পর্শে আসা মাত্র পানি শুষে নেওয়া শুরু করে, একই সঙ্গে দ্রবণীয় CO2, Ca2+ এর সঙ্গে বিক্রিয়া করে CaCO3-এর ক্রিস্টাল তৈরি করে। এর ফলে ফাটল আপনাআপনি মেরামত হয়ে যায়। কিন্তু এ পদ্ধতিতে কেবল ক্ষুদ্র ফাটল দূর হয়। কিন্তু বৃহদাকৃতির ফাটল রয়ে যায়। এ জন্য কংক্রিটের মেরামত ক্ষমতা বাড়াতে অতিক্ষুদ্র আঁশজাতীয় পদার্থ সংযোজন করা হয়, যাতে করে একটি বড় ফাটল তৈরির পরিবর্তে একাধিক ক্ষুদ্র ফাটল তৈরি হতে না পারে। আর কংক্রিট সহজে এই ক্ষুদ্র ফাটল মেরামত করতে সক্ষম।
২. অত্যধিক শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন পলিমার (Superabsorbent polymer, SAP) অথবা হাইড্রোজেল (hydrogel), এদের নিজ আকৃতি ঠিক রেখে ও পানিতে দ্রবীভূত না হয়ে অনেক বেশি পরিমাণে পানি শোষণে সক্ষম (প্রায় এদের নিজ ওজনের ৫০০ গুণ)। কংক্রিটে যদি এটি প্রয়োগ করা হয় তবে ফাটল ধরার সময় এরা আর্দ্র পরিবেশে উন্মুক্ত হয় ও পানিশোষণ করে ফুলে ওঠে। আর এর ফলে ফাটল ধরা স্থান বন্ধ হয়ে ক্ষতিকারক পদার্থ প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। এরপর CaCO3 উৎপন্ন হওয়ার পর ফাটল মেরামত সম্পন্ন হয়।
কিন্তু প্রধান সমস্যা হচ্ছে কোনোভাবে ফাটল ধরার আগেই যদি এটি পানির সংস্পর্শে আসে তবে উপকারের বদলে ক্ষতি হতে পারে। যেহেতু ফাটল ধরলে কংক্রিটের pH 12.8 থেকে কমে ৯-১০ এ এসে পৌঁছায়, তাই এমন হাইড্রোজেল ব্যবহার করা উচিত, যা কেবল এই pH-এ কাজ করবে।
৩. বিভিন্ন গবেষণার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বনেট অধঃক্ষিপ্ত অতি অণুবীক্ষণিক জীব (Calcium carbonate precipitating micro-organisms) (যেমন- ব্যাকটেরিয়া) ব্যবহার করে ফাটল মেরামত। এদের দ্বিআণবিক মাটিতে (diatomaceous earth) সুপ্ত অবস্থায় রূপান্তর করে কংক্রিট ম্যাট্রিক্সে বসানো হয়। যখন পানির সংস্পর্শে আসে তখন এরা কার্যকর হয়ে বংশবিস্তারের মাধ্যমে ফাঁকা জায়গা দখল করে। একই সঙ্গে এদের ওপর ক্যালসিয়াম কার্বনেটের আস্তরণ তৈরি হয়, তখন এরা মৃত অবস্থায় ফাটল মেরামত করে।
ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহার
ডেল্ফট প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (Delft University of Technology)-এর একদল গবেষক ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে কংক্রিটের ফাটল মেরামতের ওপর বিস্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের গবেষণা মতে, ক্যালসাইট অধঃক্ষিপ্ত ব্যাকটেরিয়া কংক্রিট মিশ্রণে ব্যবহার করে কংক্রিটের স্ব মেরামত ক্ষমতার আবির্ভাব ঘটানো সম্ভব। যেহেতু কংক্রিটের pH-এর মান অনেক বেশি, তাই শুধু ক্ষারীয় পরিবেশে বাঁচতে পারে এমন ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করতে হবে।
বাস্তব ব্যবহার
তত্ত¡ অনুসারে ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহার অনেক বেশি সাশ্রয়ী হতে পারে, বিশেষ করে যেসব কংক্রিটে রড ব্যবহার করা হয়। এর মানে কংক্রিটের স্থায়িত্বের যে সমস্যা দেখা দেয়, ফাটলের ফলে তা কম খরচে ও সহজে সমাধানযোগ্য। ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ কংক্রিট ভূগর্ভস্থ কাঠামো, পানির কন্টেইনার ও ক্ষতিকারক আবর্জনা ধারক কাঠামো নির্মাণে সহায়ক হতে পারে। কেননা এসব কাঠামো সহজে মেরামত করা সম্ভব নয় আর করতে গেলেও ব্যয়সাপেক্ষ ও কষ্টকর হয়ে ওঠে। তাই স্বক্রিয় মেরামত ক্ষমতাবিশিষ্ট কংক্রিট এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শেষের আগে
ফাটল ধরার কিছু সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত কোনো পদক্ষেপ ছাড়াই যদি কংক্রিটের ফাটল মেরামত করা যায়। তবে অনেক পরিমাণের অর্থ ও সময় দুটোরই সাশ্রয় হয়। তদুপরি কাঠামোর স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় কাঠামোটি দেখতে অন্যদের তুলনায় সুন্দর ও নিরাপদ হিসেবে সাধারণের চোখে ধরা পড়ে। যদিও বিষয়টি এখনো গবেষণাধীন, কিন্তু সেদিন আর বেশি দূরে নয় যখন মানুষকে ফাটল মেরামতের জন্য মেরামতসামগ্রী নিয়ে আর দৌড়াতে হবে না, হবে না অতিরিক্ত টেনশনের বোঝা মাথায় নিতে।
মোঃ নূর বাসিত জামান
প্রভাষক, পুরকৌশল বিভাগ, সোনারগাঁ ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।
প্রকাশকাল: বন্ধন ৫২ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৪