প্রকৃতির দানে নান্দনিক শিল্পের ছোঁয়ায়

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকেরা সাধারণত শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করে থাকলেও, স্থাপত্য বিভাগে এমনটি করা হয় না। বিভাগটির শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে মাঝে মধ্যে শিক্ষকরা বের হন খুব কাছ থেকে কিছু পর্যবেক্ষণ করাতে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের চিন্তাশক্তি বাড়িয়ে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের মূল ভবন প্রাঙ্গণে শ্রেণীকক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীদের এভাবেই পরখ ও চিন্তা করতে বলা হয়েছিল, যাতে স্থানটিকে আরও সুন্দর ও ব্যবহারোপযোগী করা যায়। শিক্ষক কমনরুম ও অফিসরুমের কাছাকাছি এ মুক্ত প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীরা তৈরি করবে টিচার-স্টুডেন্ট কমিউনিকেশন জোন। ক্লাসের বিরতির সময় এ প্রাঙ্গণ মুখরিত হবে শিক্ষার্থীদের একে অপরের ভাব বিনিময় আর আড্ডায়। জায়গাটির কার্যকর ব্যবহারকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্থাপত্য বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ফাংশনাল ডিজাইনের অংশ ছিল সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট উইথ ব্যাম্বু প্রজেক্টটি। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা ছয়টি গ্রুপে ভাগ হয়ে জায়গাটির বিভিন্ন অংশ নিয়ে সম্পন্ন করেছে বাঁশের নান্দনিক ছয়টি সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট। প্রকল্পটির প্রতিটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ছিল পাঁচ জন। 

শুরুতেই শিক্ষার্থীরা প্রকল্পটির ডিজাইন ও মডেল তৈরি করে। তা সম্পন্ন করার পর তারা শুরু করে রিয়েল স্কেলে অর্থাৎ মডেল ডিজাইনটির বাস্তব রূপদানে। বাঁশ, বেত, পাটের দড়ি প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপকরণ নিয়ে করা এ প্রজেক্টের কাজগুলো করেছে শিক্ষার্থীরা নিজ হাতে। কাজটিতে তারা একে অপরের সাথে অভিজ্ঞতা, সৃজনশীলতা ও দক্ষতা বিনিময় করেছে। বাঁশ কাটা, বাঁশ মসৃণ করা, বাঁশের বিভিন্ন প্রকার সমন্বয় জয়েন্টের খাঁজ কাটাÑ সবই শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে করেছে। মডেল কাঠামোটির ভার বহন কাঠামো সমাধান করা এবং এতে মানুষের বসার ভঙ্গিতে বিদ্যমান মাপজোখগুলোকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করেছে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। বাঁশে ছিদ্র করে নাট-বোল্ট জয়েন্ট, ছিদ্রের মধ্য দিয়ে দড়ির বুনন, কিংবা দড়ি দিয়ে বাঁশে বাঁশে বিভিন্ন ধরনের বাঁধন যেন সূ²তম পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখে। বাঁশের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ ও মডিউলকে তারা তাদের নির্মাণে প্রাধান্য দিয়েছে। আবার বাঁশগুলোকে ঘুণ ও পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে বিভিন্ন প্রকার কেমিক্যাল ট্রিটমেন্টও প্রয়োগ করা হয়েছে। সর্বোপরি মূল আসন ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে নান্দনিকতার ছোঁয়া রয়েছে। এভাবে এক ঝাঁক তরুণ স্থপতি ছয়টি সুদৃশ্য আসন ব্যবস্থার সমন্বয়ে বদলে দিল একটি স্থানকে, শোভাবর্ধন করল একটি প্রাঙ্গণের। 

প্রাকৃতিক উপকরণে তৈরি এ ধরনের আসবাবপত্র যেমন আরামদায়ক, তেমনি পরিবেশবান্ধব। প্রাকৃতিক এই সম্পদের সঠিক ও সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবেলায় ভ‚মিকা রাখতে পারে। তরুণ এই স্থপতিরা প্রাকৃতিক উপকরণের ব্যবহার ও প্রয়োগ করে ভবিষ্যতে নিশ্চিত করবে সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব, বাসযোগ্য ও টেকসই আবাসন ব্যবস্থার, এমনই মত প্রকাশ করলেন প্রকল্পটির পরিচালনাকারী শিক্ষকরা। এ প্রকল্পের নির্দেশনা প্রদানকারী শিক্ষক হিসেবে ছিলেন সৈয়দা জেরিনা হোসাইন, সজল চৌধুরী ও তাজিয়া রহমান। শিক্ষার্থীদের কাজ সম্পর্কে সৈয়দা জেরিনা হোসাইন জানান, প্রকল্পের কাজে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই অনেক উদ্যমী।শিখেছে হাতে-কলমে। এই পরিশ্রম তাদের জন্য অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা অর্জনে সহায়ক হবে। তারা শিখবে তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে।

দুই সপ্তাহব্যাপী এ প্রজেক্টে শিক্ষার্থীরা শিখেছে নতুন অনেক কিছু। করাত দিয়ে বাঁশ কাটা কিংবা দড়ির প্যাঁচে বাঁশ বাঁধা আমাদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন কাজ। সবাইকে যখন আমাদের তৈরি আসনগুলোতে বসে গল্প করতে দেখি তখন নিজের কাছে কত যে ভাল লাগে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।Ñ জানাল ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মায়েশা মাহমুদ বিনতু। একই বর্ষের শিক্ষার্থী ইয়াসিন ইমরান রনি জানায়, কেবল ডিজাইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, বাস্তব ক্ষেত্রে কাজ করতে গেলে কী কী অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় তা একজন স্থপতিকে জানতে হয়। আর আমরা এ প্রকল্পটি থেকে সেই চিন্তা করতে শিখেছি।

রাশেদুল আলম, ২য় বর্ষ

স্থাপত্য বিভাগ, চুয়েট

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৭ তম সংখ্যা, জুলাই ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top