৩৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকা শহরে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ বাসের উপযোগী হলেও সেখানে বাস করছে প্রায় দেড় কোটি মানুষ। ঢাকায় মোট সড়ক ২২০০ কিলোমিটার। শহরে প্রতিদিন ১ লাখ ৬০ হাজার যান চলাচল করে। নগর পরিবহনের এ সংকট নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও মেট্রোরেল বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত কারিগরি কমিটির সদস্য মোঃ শামসুল হকের সঙ্গে আলাপচারিতার পর নগর পরিবহন ব্যবস্থা ও গণমুখী পরিবহন মেট্রোরেল সম্পর্কে জানাচ্ছেন শরীফ আহমেদ
নগরের সকল উন্নয়ন কমর্কান্ডের মূলে মানুষ। নগর পরিবহন ব্যবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। এজন্য গাড়ি নয়, মানুষকেন্দ্রিক পরিবহন পরিকল্পনা প্রয়োজন। ঢাকা নগরীর পরিবহন ব্যবস্থার প্রধান সমস্যা যানজট। যানজট শুধু ঢাকা নয়, বিশ্বের অনেক শহরেরই দীর্ঘদিনের একটি সমস্যা। একটি শহরে সড়কের জন্য ২৫% জায়গা প্রয়োজন। ঢাকা শহরে সড়কের পরিমাণ ৮% হওয়ায় যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকায় যানজটের কারণে বছরে প্রায় ৭৭১ মিলিয়ন ডলার অপচয় হয়। যানজটের কারণে নষ্ট হচ্ছে মানুষের মূল্যবান সময়, ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন, বাড়ছে দূষণ, দুর্ঘটনা, তাপমাত্রা, জ্বালানিনির্ভরতা এবং যাতায়াত খরচ। ঢাকায় পঁচানব্বই ভাগ মানুষ যাতায়াতের ক্ষেত্রে অবহেলিত; যারা পাবলিক বাস, রিকশা, হেঁটে, সিএনজি-থ্রি-হুইলার, ট্যাক্সি, হিউম্যান হলারসহ অন্যান্য গণপরিবহন ব্যবহার করছে। অথচ শুধু ২ শতাংশ মানুষ যাদের প্রাইভেট গাড়ির মালিকানা রয়েছে তাদের ৫ শতাংশ ট্রিপ যাতায়াতের জন্য দেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ সুবিধা। মূলত প্রাইভেট কার নির্ভর পরিবহন ব্যবস্থায় বেশি বেশি সড়কের প্রয়োজন।
এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় আমেরিকান শহরগুলোতে প্রাইভেট গাড়ি নির্ভর যাতায়াত ব্যবস্থা হওয়ায় সড়কের পরিমাণ মাথাপিছু ১০ গুণ বেশি হলেও যানজট অনেক বেশি। ৩৩% সড়ক হওয়ার পরও লসঅ্যাঞ্জেলেস বিশ্বের মধ্যে অন্যতম যানজটপূর্ণ শহর। তদুপরি এশিয়ার শহরগুলোর তুলনায় আমেরিকান শহরগুলোতে পরিবহন খাতে জ্বালানি ব্যবহারের পরিমাণ মাথাপিছু ৮ গুণ বেশি। এছাড়া পরিবহন থেকে কার্বন উৎপাদনের পরিমাণ মাথাপিছু প্রায় সাড়ে ৫ গুণ। আমেরিকান শহরগুলোই বিশ্বে যানজটপূর্ণ শহরগুলোর শীর্ষে অবস্থান করছে। ২০০৯ সালে টেক্সাস ট্রান্সপোর্টেশন ইনস্টিটিউটের আরবান মবিলিটি রিপোর্টে দেখা যায়, লসঅ্যাঞ্জেলেসে যানজটের কারণে ৪৮,৫০,২২,০০০ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয় হয় ৩৬,৬৯,৬৯,০০০ গ্যালন। এর জন্য অপচয় হয় প্রায় ১০,৩২৮ মিলিয়ন ডলার ।
পরিবহন ব্যবস্থায় মাধ্যমগুলোর ক্রমনির্ধারণ করার পাশাপাশি প্রয়োজন সঠিকভাবে সমন্বয়ের। যেমনÑ মানুষকে বাসে চলাচলে উৎসাহী করতে সেবামান বাড়ানো এবং এর সঙ্গে অন্যান্য মাধ্যমের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। বাসা থেকে বাস স্টপেজে যাওয়ার জন্য সুবিধাজনকভাবে হেঁটে, সাইকেল ও রিকশায় চলাচলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। একইভাবে বাস স্টপেজ থেকে নেমে কর্মস্থলে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহৃত মাধ্যমের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা।
আমেরিকার শহরগুলোর তুলনায় এশিয়ার উন্নয়নশীল শহরতলিতে নগরবাসী পাবলিক পরিবহন, হেঁটে ও জ্বালানিমুক্ত যানে অনেক বেশি চলাচল করে। যে কারণে জ্বালানির ব্যবহার এবং দূষণ তুলনামূলক অনেক কম। ঢাকায় একই অবস্থা বিদ্যমান। তবে এ সকল মাধ্যমের সমন্বয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ।
নগর পরিবহন পরিকল্পনায় প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ জরুরী। পাশাপাশি পাবলিক পরিবহন, পথচারী, সাইকেল ও রিকশাকে প্রাধান্য দিতে হবে; যা যানজট নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে দূষণ, জ্বালানির ব্যবহার, দুর্ঘটনা, অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় ও যাতায়াত খরচ কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
নগর পরিবহন ব্যবস্থায় সবার প্রথমেই প্রাধান্য পাবে পথচারী। পথচারীদের পর অগ্রাধিকার পাবে বিভিন্ন অযান্ত্রিক যানবাহন (সাইকেল, রিকশা ইত্যাদি) যা স্বল্প দূরত্বে কার্যকরী বাহন হিসেবে কাজ করে। অযান্ত্রিক যানের পর নগর পরিবহন পরিকল্পনায় প্রাধান্য পাবে পাবলিক পরিবহন।
স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান বা এসটিপি
২০০৪ সালে সামগ্রিক ঢাকা নগরের পরিবহন ব্যবস্থার উপর সমীক্ষা চালানো হয় যেটা এসটিপি বা স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান নামে পরিচিত। যার সময়কাল ২০০৪-২০২৪ সাল। এতে থাকা প্রকল্পগুলো চারটি মেয়াদে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। মেয়াদগুলো হলো ২০০৫ থেকে ২০০৯, ২০১০ থেকে ২০১৪, ২০১৫ থেকে ২০২০ ও ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল। ঢাকা নগরীর ২০ বছরের পরিবহন চাহিদা কী ও এর সমাধানকল্পে করণীয়কে প্রতিপাদ্য করে ৭১টি প্রস্তাবনা সংবলিত এ কৌশলপত্রের ব্যয় ধরা হয় ৫.৫ বিলিয়ন ডলার। ২০০৮ সালে এসে এটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। এই কৌশলপত্রে যা ছিল উল্লেখ করার মতন তা হলো সমন্বিত ও পরিকল্পিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। যা নগরবাসীর জন্য হবে আরামদায়ক ও জনমুখী। কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) ছয়টি অতিগুরুত্বপূর্ণ রাস্তার কথা উল্লেখ করা হয়। এই ছয়টি রুটের মধ্যে তিনটি রুটের জন্য র্যাপিড বাস সেবা এবং বাকি তিনটি (এর মধ্যে দুটি পাতাল রেল) রুটের জন্য রেলসেবার মাধ্যমে এসটিপি বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। এর ফলে অধিকসংখ্যক যাত্রী দ্রæতগতিতে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে।
বিশ্বের জনবহুল শহর ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় পাবলিক বাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জাইকার সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, পাবলিক বাস প্রতিদিন প্রায় ১৯ লক্ষ যাত্রী নিয়ে ২০০ কিমি বাস রুট নেটওয়ার্কে ১০৩টি পৃথক রুটে নগরীতে চলাচল করে। এছাড়া গবেষণায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকার তিনটি করিডোরে পাবলিক বাসে যাতায়াতের জন্য গড়ে ৭৭ মিনিট করে সময় লাগে। যার মধ্যে ২৪ শতাংশ বাসের জন্য অপেক্ষা, ৪৪ শতাংশ বাসে ওঠা-নামা এবং বাস পরিবর্তন এবং ৩২ শতাংশ সময় বাসে চলন্ত অবস্থায় ব্যয় হয়। কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) উল্লেখ আছে, ঢাকা শহরে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালুর। বিআরটি হচ্ছে বিশেষ বাস সার্ভিস। উন্নত শহরগুলোতে এ ব্যবস্থা খুবই জনপ্রিয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিআরটির প্রথম ধাপে ছিল নির্দিষ্ট কোম্পানির বাস নির্দিষ্ট রুটে চলবে যার থাকবে নিজস্ব রঙ। সার্ভিসটা হবে বাস রুট ফ্যাঞ্চচাইজিং (বিআরএফ)। ২০১০ সালের প্রথমার্ধে এর শুরুটা হয়েছিল সূচনা পরিবহনের নতুন পুরনো ১০০টি বাসের মাধ্যমে আজিমপুর-আবদুল্লাহপুর রুটে। বাসের রঙ ছিল সবুজ-লাল। শুরুতেই পরিবহন কোম্পানিটি প্রায়োরিটি না পাওয়ায় এ পরিকল্পনাটি মুখ থুবড়ে পড়ে। এর কারণ সঠিকভাবে বাস রুট ডিজাইন ও বরাদ্দ না দেওয়া, বাস স্টপেজে আসা যাওয়ার জন্য অন্যান্য মাধ্যমের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি না করা, বাস রুটগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এই রুটে নামিয়ে দেওয়া হলো মিনিবাস। মিনিবাস গণপরিবহন হিসেবে অনুপযোগী। কেননা এতে যাত্রী যেমন কম ধরে, তেমনি এটি হয়ে দাঁড়াল কাউন্টার ট্রান্সপোর্ট। রাস্তা জনপরিবহনের জন্য তৈরি হলেও নগরীতে তা এখন যান পরিবহনের ক্ষেত্র হয়ে গেছে। এসব কারণেই সফলতা আসেনি সূচনা পরিবহন নামানোর পরও।
এসটিপি বা স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানের দ্বিতীয় ধাপটি ছিল ইটোডাকশন অব বিআরটি (বাস র্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেম)। বাস যেভাবে চলে তাকে দ্রæত পরিবহন বলা যায় না। জনগণ দ্রæত পরিবহন চায় তা সস্তায় হলে আরো ভালো। পুরো পৃথিবীতে বাসের পরিবহনকে দ্রæত করার জন্য ট্রেনের যে তিনটি ভূমিকা রয়েছে সেই সক্ষমতা পরিবহন হিসেবে বাসের অর্জন করা। এই তিনটি সক্ষমতা হলো একক পরিবহন রুট, নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ থেকে যাত্রীদের বাসে ওঠা ও রেডলাইট ট্র্যাকে চলা। অর্থাৎ বাসের অবাধ, বাধাহীন ও দ্রæত যাতায়াত নিশ্চিত করাটাই বাস র্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেম (বিআরটি)। এ ব্যবস্থায় বাসের জন্য পৃথক লেন থাকবে। অন্য কোনো বাহন এ লেনে ঢুকে বাস চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না। যেখানে শুধু জরুরী বাহন যেমনÑ অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এবং পুলিশ ভ্যান ঢুকতে পারবে। বিআরটি লেন ডিভাইডার ছাড়াও হয়। শুধু দাগ দিয়ে বাসের জন্য লেন বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে বিআরটির সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে ডিভাইডার দিয়ে পৃথক লেন তৈরি করা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থায় বাসের সঙ্গে পথচারী, সাইকেল এবং রিকশার সমন্বয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রাইভেট কারকে যতটা সম্ভব নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ঢাকার প্রেক্ষিতে খুব সহজেই কাজটি করা সম্ভব। এই বিআরটি আবার তিন ধরনেরÑ বিআরটি-১, বিআরটি-২ ও বিআরটি-৩। বাংলাদেশে এখন বিআরটি-৩ তথা তৃতীয় ধাপের গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষা চলছে।
এ নগরীতে পুরোপুরি বিআরটি সিস্টেমে চলা সম্ভব নয়। তবে এ সিস্টেম পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা নিয়ে এলো। বাসের মাধ্যমে যাত্রী পরিবহনে যোগ করল নতুন মাত্রা। এর পরবর্তী ধাপটাই এমআরটি (রেল বেইড র্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেম) বা মাস্ র্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেম। এখানে রয়েছে তিনটি এমআরটি। যথাক্রমে এমআরটি-৪, এমআরটি-৫ ও এমআরটি-৬। মেট্রোরেল এমআরটি-৬-এর সমীক্ষার ফল। এর সুবিধা হলো এটি স্বল্পসময়ে বেশি সংখ্যক যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। মেট্রোরেল প্রকৃতপক্ষে এসটিপির বিআরটি ও এমআরটি মাস্টার প্ল্যানেরই ফল। যত ধরনের গণপরিবহন রয়েছে, তার মধ্যে মেট্রোরেল সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা। কেননা এর ধারণক্ষমতা সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে বেশি যাত্রী স্থানান্তর করতে পারে। ঢাকা শহরে বাস বা এ ধরনের গণপরিবহন চলতে পারে এমন পর্যাপ্ত সড়ক নেই। একদিকে শহরটি জনবহুল, রাস্তার সংখ্যা কম ও অন্যদিকে সব রাস্তা বাস চলাচলের উপযোগী নয়। বিশ্বের সব আধুনিক শহরে বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহন রয়েছে। গণপরিবহন ব্যবস্থার চ‚ড়ান্ত ধাপই মেট্রোরেল।
মেট্রোরেল
প্রায় প্রতিটি উন্নত দেশে মেট্রোরেল আছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৭২টি শহরে মেট্রোরেল সার্ভিস রয়েছে, আরও ৩৪টি শহরে এ ব্যবস্থা সংযোজিত হতে যাচ্ছে। এটা চালু হলে ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। আমাদের দেশে মানুষের গড় আয় কম। বিভিন্ন কারণে বাসভাড়া বৃদ্ধির জন্য মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মেট্রোরেল চালু হলে তাদের সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে। সর্বস্তরের মানুষ এটা সহজে ব্যবহার করতে পারবে। একবারে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ বহন করা যাবে। এতে মোট ব্যয় হবে প্রায় ১২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (১৮০ কোটি ডলার)। এর জন্য সরকারকে খুব বেশি পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে না। কারণ জাপানের আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এ প্রকল্পে ০.৫ শতাংশ বার্ষিক সুদে অত্যন্ত সহজ শর্তে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেবে। মেট্রোরেল ও তার পথ তৈরির জন্য প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন ও জরিপের কাজ করেছে জাইকা ও ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (ডিইউটিডিএস) বিভাগ।
স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানের এমআরটি-৬
এ মেট্রোরেলের জন্য উত্তরা-পল্লবী-সায়েদাবাদ (সংশোধিত রুটে এখন মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত) লাইন সবচেয়ে উপযোগী বিবেচিত হয়। এখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির পরিমাণ খুবই কম। এ লাইনে ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা যাবে। অন্য কোনো এমআরটি লাইনে এত অধিক সংখ্যক যাত্রী পরিবহনের সুযোগ নেই। অপর দুটি লাইন হচ্ছে এমআরটি-৪ গুলশান-মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি-পান্থপথ-সোনারগাঁও-বাড্ডা ২০ কিলোমিটার এবং এমআরটি-৫ উত্তরা-সায়েদাবাদ লাইন ২২ কিলোমিটার। এর মধ্যে পল্লবী-মতিঝিল (বাংলাদেশ ব্যাংক) রুট সব দিক থেকে উপযোগী। এমআরটি ৬-এর পক্ষে জোরালো মত দিয়ে জাইকা বলছে, সকল কি-পয়েন্ট ইনস্টলেশনের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রেখেই এ এলাইনমেন্ট করা হয়েছে। যে কোনো মোড়ে ৬৫০ ফুট ব্যাসার্ধের বেশি প্রয়োজন হবে না। এমআরটি ৬-এর প্রতিটি ল্যান্ডিং স্টেশনের দূরত্ব হবে এক বর্গকিলোমিটার। ২০ কিলোমিটার লাইনে মোট স্টেশন হবে ১৫টি। স্টেশনগুলো হচ্ছে উত্তরা উত্তর, উত্তরা মধ্য, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, চন্দ্রিমা উদ্যান, ফার্মগেট, সোনারগাঁও মোড়, জাতীয় জাদুঘর, বাংলা একাডেমী, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম ও বাংলাদেশ ব্যাংক। ঢাকা স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানের ভিত্তিতেই ফিজিবিলিটি স্টাডি করে জাইকা এই সংশোধিত এলাইনমেন্ট করেছে। মেট্রোরেলের রেললাইন দুটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ মিটার উঁচু পিলারের ওপর বসানো হবে। প্রতিটি চওড়ায় হবে ৯ দশমিক ২ মিটার। পাশাপাশি দুটি রেললাইনের প্রতিটির প্রস্থ হবে ২ দশমিক ৮ মিটার। বিপরীতমুখী লাইন দুটির মাঝখানে আবার ৩ দশমিক ৬ মিটার ফাঁকা জায়গা থাকবে। নির্মাণকাজের সুবিধার জন্য মোট তিনটি ধাপে কাজ শেষ করা হবে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে রয়েছে পল্লবী থেকে হোটেল সোনারগাঁও মোড়। দ্বিতীয় ধাপে হবে হোটেল সোনারগাঁও মোড় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত কাজ আর তৃতীয় ধাপে থাকছে উত্তরা থেকে পল্লবী।
এমআরটি-৬ পরিকল্পনার প্রাথমিক নকশা অনুযায়ী, প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩৩ হাজার ৬০০ জন যাত্রী বহন করতে পারবে মেট্রোরেল। প্রতিটি ট্রেনে থাকবে ১০টি বগি। এতে মোট এক হাজার ৭৭৮ জন যাত্রী বসতে পারবে। ৬৫ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে চলবে মেট্রোরেল। পুরো রেললাইনে ১৫টি স্টেশন থেকে তিন মিনিট ২০ সেকেন্ড পরপর যাত্রীরা ওঠানামা করতে পারবে। মেট্রোরেলের সামনে ও পেছনে দুই দিকেই ইঞ্জিন থাকবে। এগুলোই হবে বাংলাদেশের প্রথম বিদ্যুৎচালিত ট্রেন। এ জন্য ব্যবহৃত হবে ইলেকট্রনিক মাল্টিপ্ল্যান ইউনিট (ইএমইউ) পদ্ধতি। ২০১৩ সালে শুরু হয়ে ২০১৬ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হবে। ২০১৭ সালে রাজধানীতে শুরু হবে আধুনিক পরিবহন মেট্রোরেলের চলাচল।
মেট্রোরেলের সবচেয়ে বড় সুবিধা, এতে যে পরিমাণ যাত্রী বহন করা যায় সে তুলনায় ভাড়া ও জ্বালানি তেলের ব্যবহার অনেক কম। এর পার্কিং ও যাত্রী ওঠানামার জন্য ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। এতে অধিক পরিমাণ যাত্রী বহন করা যায়, যানজট হয় না। ঢাকা শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত মেট্রোরেলের প্রস্তাবিত রুট গড়ে উঠেছে। এটা কার্যকর হলে পল্লবী থেকে মতিঝিল যেতে ১০ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না।
ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় এত সব সংকটের মধ্যে আশার আলো এই মেট্রোরেল। যেখানে ঘণ্টায় ৪০ হাজার যাত্রী কোনো রকম যানজট ছাড়াই শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাতায়াত করবে অনেক কম খরচে ও সময়ে। অনেকের কাছেই এটা স্বপ্নের মতো শোনালেও এটাই বাস্তব হতে যাচ্ছে। মেট্রোরেল হচ্ছে ঢাকার যানজট নিরসনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
যে শহরে জনসংখ্যা বেশি এবং ঘনত্বও বেশি, সেখানে মেট্রোরেল সবচেয়ে কার্যকর ও জরুরী পরিবহন মাধ্যম। অন্য যে কোনো গণপরিবহনের চেয়ে এর কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশি। ঢাকা একটি মেগা সিটি, শুধু বাস দিয়ে এ শহরের গণপরিবহন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। মেট্রোরেল প্রতি ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৬০ হাজার লোক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিতে পারে, তা ছাড়া এই যাতায়াত বাধাহীন। বাসের মাধ্যমে যা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যানজটের নগরী ঢাকার জন্য তাই গণমুখী পরিবহন হিসেবে মেট্রোরেলের কোনো বিকল্প নেই।
প্রকাশকাল: বন্ধন ২১ তম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১২