এ সময়ের নতুন ক্যারিয়ার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ বিজ্ঞান

দিন দিন পৃথিবী বদলাচ্ছে। সেই সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানুষের কাজের ধরনও। আগেকার মানুষেরা যখন কাজ করত, শুধু অর্থ উপার্জনকেই মুখ্য মনে করত। এখনকার মানুষেরা শুধু অর্থতেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না। জীবিকা নির্বাহে অর্থের পাশাপাশি সম্মান আর সৃজনশীলতাও থাকা চাই। তাই সময়ের তাগিদে ব্যবসা-বাণিজ্য আর চাকরির মতো সনাতন পেশার সঙ্গে মানুষের কাজের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নানা সৃজনশীল ও প্রশংসনীয় কাজ। ‘অর্থ, সম্মান আর সৃজনশীলতা’ সবই আছে সে রকম নতুন একটি কাজের ক্ষেত্র হলো ‘পরিবেশ’। কল-কারখানার বর্জ্য, গাড়ির কালো ধোঁয়ার কার্বন-ডাই অক্সাইড মিলে বিপন্ন করে তুলছে পরিবেশ। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে মানুষ যে পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠে সেই পরিবেশই হয়ে উঠছে বিপন্ন, বিপর্যস্ত। কিন্তু এর মাঝে তো আর থেমে থাকলে চলবে না। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কাজ করতে হবে নিজেদেরই। আপনি যা-ই করুন না কেন কোনো কাজ করতে গেলে পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের আগেকার সময়ের মানুষেরা শুধু আদর্শলিপি পড়েই পড়াশোনাটা শেষ করে ফেলতেন, সে পড়াশোনায় এখন এসেছে আমূল পরিবর্তন। যুগ বদলের সাথে সাথে দিন বদল হয়েছে। বদলেছে আমাদের পড়াশোনার ধরন ও সিলেবাস। প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন নতুন বিষয়। যেমন তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পড়ার বিষয়ের নাম ‘ইলেকট্রনিক অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ আবার আবাসন নিয়ে পড়ালেখা করার বিষয়ের নাম ‘রিয়েল এস্টেট’। তাই পরিবেশ বিপর্যয়ের এই সময়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যারা কাজ করতে চান তারা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ বিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারেন। আর পড়াশোনা শেষে কাজ করতে পারেন ধরিত্রীকে বাঁচাতে। যারা কাজ করে অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি সম্মান আর সৃজনশীলতা চান তারা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে পারেন। রুগ্ণ-বিপন্ন পরিবেশকে বাঁচিয়ে তুলতে মানুষই আবার তৎপর হওয়ায় বর্তমান সময়ে এ বিষয়টিতে কাজের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাজের সুযোগ হওয়ায় এখন দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে পড়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। 

পড়বেন যেখানে

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ফাহমিদা রফিক জানান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশবিজ্ঞান বিষয়ে দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশবিজ্ঞানে পড়তে পারেন। আর উচ্চতর ডিগ্রি ও পড়াশোনার জন্য খোলা রয়েছে বাইরের দুয়ারও। বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিষয়টি নিয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ রয়েছে।

যা পড়ানো হয়

স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পরিবেশবিজ্ঞান বিষয়ে মূলত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের ব্যবহারিক ও কৌশলগত নানা দিক পড়ানো হয়। হাতে কলমে শেখাটাও এ বিষয়ে পড়ালেখার অন্তর্ভুক্ত। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কৌশল, ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিজ্ঞান, দুর্যোগকালীন প্রতিরক্ষা, দুর্যোগকালীন প্রতিক‚লতা প্রতিরোধ, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশনীতি, পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ ও মোকাবেলার উপায়, পানি ব্যবস্থাপনা, পানিদূষণ রোধ, বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রতিরোধ, পরিবেশ অর্থনীতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ রসায়নসহ পরিবেশের নানা দিক পড়ানো হয়।

চাহিদা কেমন

‘বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ তথা পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। তবে দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে এখন পর্যন্ত বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন তথা পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে তোলপাড় হওয়ায় এ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। তাই তরুণ প্রজন্মের যারা বেকার বসে আছে অথবা যারা নিজের কাজের মাধ্যমে দেশকে কিছু দিতে চায় তাদের জন্য পরিবেশ বিষয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।’ কথাগুলো বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) সভাপতি সৈয়দ রিজওয়ানা হাসানের। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগে কাজ করার নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। এ ধরনের কাজের বেশির ভাগই হলো প্রকল্পভিত্তিক। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে প্রচুর লোকবলের দরকার। তাই বলা যায়, বর্তমান সময়ে পরিবেশ বিষয়ে কাজের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।

কাজের সুযোগ যেখানে

এ বিষয়ে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষকতা সহযোগী আশিকুর রহমান জানান, পরিবেশবিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা শেষে একজন শিক্ষার্থী দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং পরিবেশ বিষয়ক প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পান। আবার কেউ ইচ্ছা করলে শিক্ষকতা বা গবেষণার মতো কাজও করতে পারবেন অনায়াসে। পড়াশোনা শেষে একজন শিক্ষার্থী দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থা, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারবেন।

কাজটা কী

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ে কাজ করতে গেলে মাঠপর্যায়ে দুর্যোগকালীন প্রতিরোধ, পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, পরিবেশ বিপর্যয় রোধে ভূমিকা রাখা, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নতুন ও টেকসই পন্থা তৈরি করা, পরিবেশ বিষয়ক আইনের খোঁজখবর রাখতে হয়। এখানে কাজের ধরন দুই রকমÑ গবেষণা ও বাস্তবায়ন। কাজের ধরন দুই রকম হলেও কাজ কিন্তু মাঠপর্যায়েই সম্পন্ন করতে হয়।

এ পেশায় ভালো করতে হলে

‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করে ভালো ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে শুধু পুঁথিগত জ্ঞান থাকলেই চলবে না। বইয়ের জ্ঞানের পাশাপাশি থাকতে হবে ব্যবহারিক দক্ষতাও।’ এমনটাই মনে করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্বপন কুমার সাহা। পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে গেলে অফিসে বসে কাজের চেয়ে মাঠপর্যায়েই বেশি কাজ করতে হয়। তাই পরিবেশ খাতে ভালো ক্যারিয়ার বা কর্মজীবন গড়তে চাইলে মাঠপর্যায়ে কাজ করার মানসিকতা ও দক্ষতা থাকতে হবে। দেশের বিদ্যমান পরিবেশ আইন জানা ও পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা থাকা বাধ্যতামূলক। আর ছাত্রাবস্থায় পরিবেশ বিষয়ক কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকাটা পরবর্তীকালে অনেক ফল দেবে বলে মনে করেন আশিকুর রহমান।

জিয়াউর রহমান চৌধুরী

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৮ তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top