ঢাকার বাতাসে বিভিন্ন দূষণ উৎস এবং মেটিওরোলজির ভূমিকা

শুরুর কথা

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিভিন্ন রকম দূষণের কারণে সর্বত্র আলোচিত। এসবের মধ্যে বায়ূ দূষণ অন্যতম এবং মানব দেহের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাবও বেশি। যানবাহন, কলকারখানা, ইটভাটার ধোঁয়া, রাস্তার ধুলাবালি প্রভৃতিকে বায়ু দূষণের প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়। বায়ু দূষণ কমানোর জন্য যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হলে দূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে কোন্টির ভূমিকা কতটুকু তা পরিষ্কারভাবে জানা দরকার। এসব জানার জন্য বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে কিন্তু ফলাফল পরস্পরবিরোধী। এই গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্যই হলো বায়ু দূষণের উৎসগুলোর ভূমিকাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। বায়ু দূষণের উপর বিভিন্ন মেটিওরোলজিক্যাল বা আবহাওয়াগত বিষয়গুলোর (বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, বায়ুপ্রবাহের তীব্রতা এবং এর প্রবাহের দিক, সোলার ভ্যারিয়েশন প্রভৃতি) প্রভাব কী, সেটা বের করাও এই গবেষণার আরেকটি উদ্দেশ্য। সাধারণত দেখা যায় যে, ঢাকার বায়ু শুষ্ককালের চেয়ে বর্ষাকালে ভালো থাকে। এই মৌসুম ভিত্তিক তারতম্যের কারণও অনুসন্ধান করা হয়েছে।

বায়ূ দূষণের জন্য দায়ী উপাদানসমূহ সংখ্যায় প্রচুর। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এসব উপাদানের মধ্যে পার্টিকুলেট ম্যাটার (সংক্ষেপে PM) এবং NOX ঢাকার বাতাসে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি। পার্টিকুলেট ম্যাটার হলো বাতাসে বহমান কণা, যা কঠিন ও তরল উভয় অবস্থায় থাকতে পারে এবং যাদের আকার খুবই ক্ষুদ্র (০.০০৫ মাইক্রোমিটার থেকে ১০০ মাইক্রোমিটার)। NOX হলো নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ। যেমন NO, NO2 প্রভৃতির সম্মিলিত রূপ। এই গবেষণায় বায়ু দূষণের উৎসগুলো দূষণের জন্য দায়ী কোন্ কোন্ উপাদানকে প্রভাবিত করে তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেখা গেছে যে, ইটভাটা পার্টিকুলেট ম্যাটারগুলোকে বাড়ায় কিন্তু তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র PMকে (PM 2.5) বেশি মাত্রায় বাড়ায়, যা ইতোপূর্বে বিভিন্ন গবেষণায় সঠিকভাবে উঠে আসেনি। এতদিন ধারণা ছিল যে, NOX, CO প্রভৃতিকে বাড়ানোর জন্য যানবাহনের ধোঁয়াই দায়ী। কিন্তু এই গবেষণায় উঠে এসেছে, ইটভাটার ধোঁয়াও এদের বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করে।

ইতোপূর্বে ধারণা করা হতো, ঢাকার বাতাসের মৌসুমভিত্তিক তারতম্যের জন্য প্রধানত বর্ষাকালের বৃষ্টিপাতই দায়ী। এই গবেষণায় দেখা যায়, বৃষ্টিপাত নয় বরং বর্ষাকালে ইটভাটাগুলো বন্ধ থাকার কারণেই মূলত বর্ষাকালে বাতাসের অবস্থা ভালো থাকে।

ঢাকার বাতাসের উপর মেটিওরোলজিক্যাল উপাদানগুলোর প্রভাব বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য বিষয় পাওয়া গেছে যা পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলোয় বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রারম্ভিকা

ঢাকা (অক্ষাংশ ২৩.৭৭ উত্তর, দ্রাঘিমা ৯০.৩৮ পূর্ব) বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শহর এবং দেশের সকল প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। অপরিকল্পিত নগরায়ন, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সেই সাথে শিল্পায়ন ঢাকাকে পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বায়ু দূষণের কারণে শারীরিক অসুস্থতা ও মৃত্যুর জন্য ঢাকা শহরে প্রতি বছর অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ২০০-৮০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার।

ইতোমধ্যে বলা হয়েছে যে, PM এবং NOX ঢাকার বাতাসে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি। PM-এর দুটো অংশ নিয়ে মূলত সকল আলোচনা করা হয়। যাদের আকার ২.৫ মাইক্রোমিটার থেকে কম তাদের PM2.5 বলা হয়, আর যাদের আকার ২.৫ থেকে ১০ মাইক্রোমিটারের মধ্যে তাদের PM2.5-10 বলা হয়। PM2.5 আমাদের দেহের জন্য বেশি ক্ষতিকারক; এরা খুব ক্ষুদ্র বলে দেহের শ্বাসযন্ত্রের অনেক গভীরে পৌঁছায় এবং বিভিন্ন মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। এই গবেষণায় যেসব তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে তা সংসদ ভবন CAMS (Continuous Air Monitoring Station) এবং BMD (Bangladesh Meteorological Department)-এর সৌজন্যে পাওয়া।

গবেষণামূলক আলোচনা ও ফলাফল

বায়ূ দূষণ এবং এর উৎসসমূহের উপর ইতোমধ্যে বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে যেগুলোকে Source Apportionment Studies বলা হয়। কোনো কোনো গবেষণায় বলা হয়েছে, ইটভাটা প্রধানত PM2.5কে বাড়ায়, আবার কোনোটাতে বলা হয়েছে প্রধানত PM2.5-10কে বাড়ায়। কোনো কোনো গবেষণায় ইটভাটাকে PM-এর উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। এসব গবেষণা মূলত বিভিন্ন MODEL ব্যবহার করে করা হয়েছিল। এই গবেষণায় ইটভাটার ভূমিকা বোঝার জন্য বায়ুপ্রবাহের দিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ঢাকা শহরে শুষ্ককালে প্রধানত উত্তর-পশ্চিম দিক হতে বাতাস প্রবাহিত হয়ে আসে। আবার ঢাকা শহরের ইটভাটাগুলোর একটা বড় অংশ সেদিকেই অবস্থিত [Figure 1(b)] উত্তর-পশ্চিম দিকে গাজীপুর ও সাভারে যে ইটভাটাগুলো আছে সেগুলো সামগ্রিক ইটভাটার যথাক্রমে ৩৩% ও ২০%। এই গবেষণায় শুষ্ককালের (October ’০২-March ’০৩) প্রতিটি দিনে বায়ু কোন্ দিক হতে এসেছে সেটা চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেই দিনের PM2.5-এর মান কত ছিল সেটা দেখা হয়েছে। পরবর্তীতে PM2.5-এর মান এবং বায়ুপ্রবাহের দিককে একই সাথে গ্রাফে স্থাপন করা হয়েছে [Figure1(a)] গ্রাফ হতে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, যখন বাতাস উত্তর-পশ্চিম দিক হতে আসে, তখন ঢাকা শহরে PM2.5-এর মান তুলনামূলকভাবে বেশি। গ্রাফ হতে আরো দেখা যাচ্ছে যে, পশ্চিম-দক্ষিণ-পশ্চিম দিক হতে বাতাস এলেও PM2.5 বেশি, এর কারণ হলো সেদিকেও (রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ) বেশ কিছু ইটভাটা আছে।

একইভাবে PM2.5-10-এর গ্রাফ এঁকে তা PM2.5-এর গ্রাফের উপর বসানোর ফলে দুটি জিনিস লক্ষ করা যায় (Figure:2) প্রথমত PM2.5-10 বায়ুপ্রবাহের দিকের সাথে PM2.5-এর মতো একই সম্পর্ক দেখায়, দ্বিতীয়ত ইটভাটার কারণে ঢাকা শহরে PM2.5-10 থেকে PM2.5 বেশি আসে।

ঢাকা শহরে বর্ষাকাল (মার্চ-সেপ্টেম্বর) এবং শুষ্ককালে (অক্টোবর-ফেব্রুয়ারি) বাতাসে দূষণের মধ্যে ব্যাপক তারতম্য দেখা যায়। Figure : ৩তে PM2.5-এর এবং Figure 4-এর NOx-এর মান (তীব্রতা) পর্যায়ক্রমিক মাসে দেখানো হয়েছে। Figure দুটো হতে PM এবং NOx-এর মৌসুম ভিত্তিক তারতম্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতদিন পর্যন্ত মনে করা হতো বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের ফলে দূষণের উপাদানগুলো মাটিতে পড়ে যায় বলে এই সময়ে বাতাসে দূষণ কম হয়। এটা ছাড়া অন্য কোনো কারণ আছে কিনা, তা বের করার জন্য তিনটি পৃথক সময় বেছে নেওয়া হয়েছিল। 

১. পূর্ণ শুষ্ককাল (কোনো বৃষ্টিপাত নেই, তবে ইটভাটা চালু আছে)

২. বর্ষাকালের মধ্যস্থ একটা সময় যখন কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি (এ সময়ে কোনো বৃষ্টিপাত নেই এবং ইটভাটাগুলোও বন্ধ)

৩. বর্ষাকালের মধ্যস্থ একটা সময় যখন প্রতিনিয়ত বৃষ্টিপাত হয়েছে

প্রথম দুটো সময়ে PM-এর মানের পার্থক্য ইটভাটার প্রভাব তুলে ধরে, অপরদিকে শেষ দুটো সময়ে PM-এর মানের পার্থক্য বৃষ্টিপাতের প্রভাব তুলে ধরে (টেবিল ১) টেবিল ২ হতে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় PM2.5 কমানোর ব্যাপারে ইটভাটা বন্ধ থাকাটাই মূল কারণ। অপরদিকে বৃষ্টিপাত বড় PM i.e PM2-5-10 কে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমাতে পারে।

মেটিওরোলজিক্যাল বিষয়গুলোর মধ্যে দেখা যায়, আপেক্ষিক আর্দ্রতা বাড়লে PM-এর দুটো অংশই উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় (Figure 5) আবার দেখা যায় PM-এর মান যত বাড়তে থাকে, তাপমাত্রা তত কমতে থাকে (Figure 6) এটা মূলত হয় PM-এর negative radioactive forcing-এর কারণে। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, সোলার র‍্যাডিয়েশন বাড়লে ফটোকেমিক্যাল প্রক্রিয়ায় তুলনামূলক বড় নাইট্রেট কণা তৈরি হয় অর্থাৎ PM2-5-10 তৈরি হয়।

এতদিন মনে করা হতো বাতাসে NOX, CO প্রভৃতি বাড়ার জন্য প্রধানত গাড়ির ধোঁয়াই দায়ী। কিন্তু কিছু গ্রাফ বিশ্লেষণ করলে মনে হয় যে, শুধু গাড়ির ধোঁয়াই নয় বরং অন্য কোনো উৎস থেকেও NOX, CO আসছে। NOX-এর সাথে PM-এর গ্রাফ স্থাপন করলে দেখা যায় যে, এরা সকল মৌসুমে পরস্পরের সাথে ভালো কোরিলেশন দেখাচ্ছে (Figure7)। শুষ্ককালে PM এবং NOX-এর সকল উৎসই চালু থাকে। বর্ষাকালে ইটভাটা বন্ধ হয়ে গেলে, অর্থাৎ PM-এর একটা বড় উৎস কমে যাচ্ছে। ফলে বর্ষাকালে তাদের কোরিলেশন খারাপ হয়ে যাবার কথা, কিন্তু দেখা যাচ্ছে খারাপ হচ্ছে না। এর মানে হলো NOX-এরও এমন কোনো উৎস আছে যা বর্ষাকালে বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা শহরে ইটভাটা ছাড়া আর কোনো উৎস নেই যা বর্ষাকালে বন্ধ হয়ে যায়। তা ছাড়া PM-এর মতো NOX-এরও তিনটি পৃথক সময়ের মান নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এর ক্ষেত্রেও মৌসুম ভিত্তিক তারতম্যের জন্য বৃষ্টিপাতের তুলনায় ইটভাটা বন্ধ হওয়াটাই বেশি ভূমিকা রাখে (টেবিল ৩ ও ৪) CO-ও NOX-এর মতো একই গ্রাফ প্রদর্শন করে। সুতরাং বলা যায়, ইটভাটা NOX এবং COকে বাড়াতেও ভূমিকা রাখে।

উপসংহার

এই গবেষণা দ্বারা বোঝা গেল যে, ইটভাটা শুধু PM2.5 ই নয় বরং NOX, COকে বাড়াতেও ভূমিকা রাখে। ঢাকা শহরের জন্য ইটভাটাগুলো বেশি ক্ষতিকর, বিশেষ করে তাদের অবস্থানের কারণে। কেননা ইটভাটাগুলো চালু থাকে শুষ্ককালে, তাদের একটা বড় অংশের অবস্থান উত্তর-পশ্চিম দিকে আর ঢাকা শহরে শুষ্ককালে বাতাসও প্রবাহিত হয় উত্তর-পশ্চিম দিক হতে। সুতরাং ঢাকা শহরের বাতাসকে দূষণ হতে রক্ষা করতে ইটভাটাগুলোর অবস্থান পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই।

মোঃ ম্যাক্সিমুল ইসলাম

 প্রভাষক,  পুরকৌশল বিভাগ

 বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

সাদিয়া আফরিন

 প্রভাষক, পুরকৌশল বিভাগ

 বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

প্রকাশকাল: বন্ধন ২৯ তম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১২

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top